• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

ঘূর্ণিঝড় বৃষ্টিতে যে আমল করবেন

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০ মে ২০২০  

দুনিয়ায় মানুষের প্রতিটি অবস্থার জন্য রয়েছে করণীয়। বিশেষ করে মুমিন মুসলমানের জন্য সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদে করণীয় কী হবে সে সম্পর্কে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঠিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। মুলিম উম্মাহ কোন অবস্থায় কোন কাজ কববো আর কোন কাজ করবো না তার বর্ণনা রয়েছে সুন্নাহর এসব নির্দেশনায়।

সুতরাং যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বিপর্যয় ঘূর্ণিঝড়, তুফান ও বৃষ্টি হবে তখন মানুষের করণীয় কী হবে? কী আমল করতে হবে? সে সম্পর্কে সুন্নাহর নির্দেশনাই বা কী?

- প্রবল বৃষ্টিতে উপকারের দোয়া

প্রবল বৃষ্টিতে যেন মানুষের ক্ষতি না সে জন্য প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবল বষ্টি হতে দেখলে ৩ শব্দের ছোট্ট একটি দোয়া পড়তেন। আর তাহলো-
اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা সাইয়্যেবান নাফিআ।' (বুখারি)
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারি হয়।'

- প্রবল ঘূর্ণিঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতি থেকে মুক্তি দোয়া
প্রবল ঘূর্ণিঝড়-বৃষ্টিতে যদি মানুষের জন জীবনের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে কিংবা ফসল নষ্ট হয় কিংবা চলাচলের রাস্তা-ঘাট পানিতে তলিয়ে যায়, তবে সে অবস্থায় প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরেকটি দোয়া আছে। আর তাহলো-
اَللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلَا عَلَيْنَا
উচ্চারণ : `আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা আলাইনা।’ (বুখারি)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমাদের থেকে (ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টি) ফিরিয়ে নাও, আমাদের ওপর দিয়ো না।’

একবার মদিনায় অনাবৃষ্টি ও খড়ার কবলে পড়লে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃষ্টির জন্য দোয়া করলেন। তারপর এত অধিক পরিমাণ বৃষ্টি হলো যে, সাহাবায়েকেরাম প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানালেন- হে আল্লাহর রাসুল! বৃষ্টিতে রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাচ্ছে, বাড়ি-ঘর ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা। তখন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দোয়া পড়লেন। আর আল্লাহ তাআলা বৃষ্টির ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন।

- প্রচণ্ড বাতাস ও তুফানে আল্লাহকে ভয় করা
ঘূর্ণিঝড় কিংবা ঘূর্ণি বৃষ্টির আগে যদি প্রবল বাতাস বা তুফানের সৃষ্টি হতো তখন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভিত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন- আমার আশঙ্কা হয়, এ প্রবল বাতাস বা তুফানের ফলে না জানি আল্লাহর আজাব নেমে আসে কিনা। সে কারণে (যেন আজাব নাজিল না হয়) তিনি আল্লাহকে বেশি বেশি ভয় করতেন এবং অন্যদের ভয় করতে বলেছেন। আল্লাহর ভয় লাভে এ দোয়া পড়া যেতে পারে-
اَللَّهُمَّ اِنِّى اَسْئَلُكَ الْهُدَى وَ التُّقَى وَ الْعَفَافَ وَالْغِنَى
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা ওয়াত্তুক্বা ওয়াল আফাফা ওয়াল গিনা।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে হেদায়েত (পরিশুদ্ধ জীবন) কামনা করি এবং আপনার ভয় তথা পরহেজগারি কামনা করি এবং আপনার কাছে সুস্থতা তথা নৈতিক পবিত্রতা কামনা করি এবং সম্পদ-সামর্থ্য (আর্থিক স্বচ্ছলতা) কামনা করি।

- ঘূর্ণিঝড়, প্রবল বৃষ্টি ও তুফান চলাকালীন বলা-
যখন প্রবল বৃষ্টি, তুফান কিংবা ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে যাবে তখন এক শব্দে আল্লাহর তাআলার রহমত কামনা বলা-
رَحْمَةَ
উচ্চারণ : 'রাহমাতান।'
অর্থ : '(হে আল্লাহ! আপনার) অনুগ্রহ (চাই)।'

কুরআনুল কারিমের বিভিন্ন স্থানে যে বৃষ্টি বর্ষণের কথা এসেছে যে, আল্লাহ তাআলা আসমান থেকে পানি নাজিল করেন, তাহলো রহমতের বৃষ্টির বর্ণনা। সতরাং সব সময় বৃষ্টি ও তুফান চলাকালীন সময়ে রহমত বা অনুগ্রহ লাভে এ আমল করা। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এ আমলটি করেছেন। বৃষ্টি হলে তিনি 'রাহমাতান' বলতেন।

- বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টির পর বলা
বৃষ্টি চলাকালীন সময়ে কিংবা বৃষ্টি থেকে যাওয়ার পর এ ছোট্ট একটি দোয়া পড়া সুন্নাত। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এ দোয়া পড়তেন এবং অন্যদেকেও পড়তে বলেছেন।
আর তাহলো- 'মুত্বিরনা বি-ফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহি।'
অর্থ : 'আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে আমরা বৃষ্টি পেয়েছি।'
মানুষের এ বিষয়টি জানার কোনো সক্ষমতা নেই যে, কোন বৃষ্টি মানুষের জন্য উপকারি। আর কোন বৃষ্টি ক্ষতিকর। তাই বৃষ্টির সময় রমহত কামনা করা। কিংবা বৃষ্টির পর তার দয়া আসমান থেকে বৃষ্টি এসেছে এমনটি বলা।

- বৃষ্টির পানি শরীরে লাগানো
বৃষ্টির পানি গায়ে লাগানো সুন্নাত। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বৃষ্টিতে নেমে পড়েন এবং শরীরে বৃষ্টির পানি লাগান। তবে বৃষ্টিতে বেশি পরিমাণ ভেজা কিংবা অসুস্থ হয়ে যান এমনটি যেন না হয়। হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসলিমে এসেছে-
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃষ্টিতে একবার বের হয়েছিলেন এবং শরীরে পানি লাগিয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেন তিনি এমনটি করেছেন? তখন তিনি বলেছিলেন, 'বৃষ্টিকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বরকত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।'

সুতরাং বৃষ্টির পানি শরীরে লাগানোর জন্য বৃষ্টির মধ্যে নেমে যাওয়ার দরকার নেই। সম্ভব হলে দু'এক ফোটা পানি শরীরে লাগানো। আ তাতেই এ আমলের হক আদায় হয়ে যাবে।

- বৃষ্টির সময় দোয়া কবুলের প্রার্থণা করা
হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। এ জন্য মুমিন মুসলমানের উচিত নিজেদের সব চাওয়াগুলো পূরণে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করা। হাদিসের বিখ্যাত সব গ্রন্থের বর্ণনায় এসেছে-

যে সময়গুলোতে দোয়া কবুল হয় তন্মধ্যে বৃষ্টি নাজিল হওয়ার সময়েও আল্লাহ তাআলা বান্দার দোয়া কবুল করেন। সুতরাং বৃষ্টি বর্ষণের সময়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা।

মুমিন মুসলমানের উচিত, ঘূর্ণিঝড়, প্রবল বৃষ্টি ও তুফানের সময় উল্লেখিত ৬টি আমল কর। আর তাতে আল্লাহ যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে যেমন হেফাজত করবেন। তেমিন তার কল্যাণ দান করবেন এবং বান্দার দোয়া কবুল করবেন।

ঘূর্ণিঝড়, প্রবল বৃষ্টি ও তুফানের সময় এমন কিছু কাজ মানুষ করে থাকে। যা কোনোভাবেই করা উচিত নয়। এগুলো থেকে বিরত থাকা। আর তাহলো-

- বৃষ্টিকে গালাগাল দেয়া
অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে মানুষ একে গালাগাল দিতে থাকে। অতিরিক্ত ঝড়-বৃষ্টি হলে মানুষ 'অমুক-তমুক' বৃষ্টি-ঝড় বলে গালাগাল দিতে থাকে। মারাত্মক ধরনের বাজে মন্তব্য করে থাকে। হাদিসে এসেছে-
মানুষ যদি এমন কোনো কিছুকে গালি দেয়, যেগুলো গালি পাওয়ার উযুক্ত নয়, সেগুলোকে গালি দিলে, সে গালি নিজের দিকে ফিরে আসে। অতএব যত বৃষ্টি, তুফান বা ঘূর্ণিঝড় হোক- এগুলোকে গালি দেয়া যাবে না। হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী যত বৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগই হোক না কেন, আল্লাহর কাছে তার ক্ষতি থেকে বাঁচার দোয়া করা। এর রহমতের কামনায় দোয়া করা। এগুলোকে গালি দেয়া যাবে না।

- ঝড়-বৃষ্টিতে গজবের কথা না বলা
প্রবল ঝড় বৃষ্টি শুরু হলেই অনেকে বলে থাকে যে, আল্লাহর গজব শুরু হয়েছে। সেব কথা না বলা। কিংবা অমুক ব্যক্তির কারণে দেশে বা অঞ্চলে গজব নাজিল হয়েছে, এসব না বলা। কারণ আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন যে, এর মধ্যে কি রয়েছে। বরং কুরআনের সে দোয়া করা। আল্লাহ বলেন-
رَبَّنَا اكْشِفْ عَنَّا الْعَذَابَ إِنَّا مُؤْمِنُونَ
উচ্চারণ : 'রাব্বানাকশিফ আন্নাল আজাবা ইন্না মুমিনুন।' (সুরা দুখান : আয়াত ১২)
অর্থ : 'হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপর থেকে আপনার শাস্তি প্রত্যাহার করুন, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করছি।'

- ঘূর্ণিঝড় তুফানে আজান
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বেড়ে গেলে ঘরে ঘরে আজান দেয়ার প্রচলন দেখা যায়। ঘরের মুরব্বিরা নিজের আজান দেন অনেক সময় অন্যকে আজান দিতে বলেন। আসলেই কি ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে আজান দেয়া যাবে কি?

ঘূর্ণিঝড় কিংবা প্রবল ঝড়-তুফানে আজান দেয়া সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহর কোনো দিক-নির্দেশনা নেই। তবে কুরআনুল কারিমে মেঘের গর্জনে আল্লাহর তাসবিহ-এর বর্ণনা রয়েছে এবং ফেরেশতার আল্লাহ ভয়ে তাসবিহ পাঠ করতে থাকে। এ কারণে অনেক ওলামায়ে কেরাম ঝড়-বৃষ্টিতে আল্লাহর স্মরণে আজান দেয়ার কথা বলেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং ফেরেশতারা তাঁর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে তাসবিহ পাঠ করে; তিনি বজ্রপাত করেন এবং (অনেক সময়) তাকে যার ওপর চান, ঠিক সে যখন আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত তখনই নিক্ষেপ করেন। অথচ আল্লাহ তাআলার শক্তি কৌশল ও শক্তি বড়ই জবরদস্ত।’ (সুরা রাদ : আয়াত ১৩)

যদিও নামাজের জন্য আজান দেয়া সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। আর সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে আজান দেয়া তথা আল্লাহর তাসবিহ ঘোষণা মোস্তাহাব আমল বলে উল্লেখ করেছেন ওলামায়ে কেরাম। তবে সরাসরি আজান দেয়াকে কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনা বা আমল বলা যাবে না।

আল্লাহ তাআলা সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে উল্লেখিত আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করে আল্লাহর ক্ষতি থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন। আর যাতে রয়েছে কল্যাণ ও উপকার তা লাভ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ