• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

উন্নত জীবনের আশায় সর্বস্বান্ত মাদারীপুরের শত পরিবার

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩০ ডিসেম্বর ২০২১  

মাদারীপুর জেলাসহ পাশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও শরীয়তপুরের নড়িয়া এলাকার ১৫৭ যুবক লিবিয়ার একটি জেলখানায় বন্দি জীবন যাপন করছেন। দালালের হাতে লাখ লাখ টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত এখন তাদের পরিবার। টাকা গেলেও ফিরে পেতে চান প্রিয়জন ও স্বজনদের। তাই দেশে ফিরিয়ে আনতে কয়েক দফা মানববন্ধন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তাদের পরিবার। 

এদিকে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এতে মাদারীপুর জেলাজুড়ে বেড়েছে দালালদের দৌরাত্ম্যও। বিদেশ নেওয়ার কথা বলে অভিনব পন্থায় ধাপে ধাপে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। তাদের খপ্পরে পড়ে শুধু অর্থ নয়, প্রাণও দিতে হচ্ছে বিলাসী জীবনের স্বপ্নে মরীচিকায় পা দিচ্ছেন অনেক যুবককে।

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, প্রথমে চক্রের সদস্যরা ইতালিতে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে আগ্রহী যুবকদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুলে দেয় মাফিয়াদের হাতে। এরপর পাশবিক নির্যাতনের ভিডিও পরিবারে কাছে পাঠিয়ে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। পরিবার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে জীবন দিতে হয় চক্রের হাতে।

যারা টাকা দেয়, দালালরা তাদের ছাড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে ছেড়ে দেয়। এ সময় নৌকাডুবিতে অনেকের সলিলসমাধি হচ্ছে সাগরেই। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ ইতালিতে পৌঁছালেও বেশির ভাগ যাত্রী হয় লিবিয়ার কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে জেলখানায় বন্দি হচ্ছেন আবার নৌকাডুবিতে প্রাণ যাচ্ছে। তারপর জেল থেকে ছাড়ানোর আশ্বাস দিয়ে দালালরা পরিবারের কাছ থেকে আরেক দফায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এভাবেই চক্রের ফাঁদে পড়ে ভিটেমাটি সোনাদানা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ পরিবারগুলো।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো থেকে জানা যায়, প্রায় এক বছর আগে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন মাদারীপুরসহ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও শরীয়তপুরের নড়িয়ার দুই শতাধিক যুবক। স্থানীয় বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে চার লাখ টাকার বিনিময়ে তারা প্রথমে লিবিয়ায় পৌঁছান। এরপর তাদের তুলে দেওয়া হয় লিবিয়ায় থাকা অন্য দালালদের হাতে।

সেখানে শুরু হয় আরেক দফা নির্যাতন। তাদের নৌকায় (গেম) করে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে পারিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় আরও ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। তারপর দালালরা ভুক্তভোগীদের নৌকায় তুলে দেয়। কিছু দূর যাওয়ার পর লিবিয়ার মাফিয়াদের দিয়ে আটক করায়। পরে ছাড়ানোর নাম করে আবার ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। সন্তান বা স্বজনকে বাঁচাতে এভাবে তিন দফা দালালদের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিতে বাধ্য হন প্রতিটি পরিবার।

সর্বশেষ তিন মাস আগে নৌপথে ইতালিতে পাড়ি দেওয়ার পথে কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে যায় তারা। পরে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় লিবিয়ার ‘আল-জাহারা খামছাখামছিল ৫৫’ নামক কারাগারে। এসব যুবক এখন জেলখানায় অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের ছাড়িয়ে আনার জন্য লিবিয়ার স্থানীয় দালালদের টাকা দিয়েও প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত এখন পরিবারগুলো। দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতিটি পরিবারকে গুনতে হয়েছে প্রায় ১৫ খেকে ২০ লাখ টাকা।

কোনো উপায় না থাকায় স্বজনদের দেশে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়ে ভুক্তভোগী ১৫৭ পরিবার মাদারীপুর প্রেসক্লাব ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কয়েক দফা মানববন্ধন করেছে। এ নিয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করেছেন তারা।

পরিবারগুলোর অভিযোগমতে, ভুক্তভোগীদের ইতালি নেওয়ার জন্য লিবিয়ায় অবস্থানরত দালাল চক্রের মূল হোতা সোহেল নামক এক ব্যক্তি তাদের থেকে টাকা নেন। পরে ভুক্তভোগীরা ধরা পড়লে তাদের ছাড়ানোর জন্য সোহেল পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেন। কয়েক দফায় তিনি প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। সোহেলের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নগরপুর উপজেলার কনোরা নামক এলাকায় এলাকায়। কনোরা ৯ নং ওয়ার্ডের সদস্য আফজাল হোসেন সোহেলের সহযোগী হিসেবে টাকা সংগ্রহ করেন বলে জানা যায়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদারীপুরসহ পাশের জেলাগুলোতে এখনো সক্রিয় রয়েছে বেশ কয়েকটি দালাল চক্র। এলাকার চিহ্নিত মানব পাচারকারী দালালদের মধ্যে রয়েছেন মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগিরা কুমারের ট্যাক এলাকার আম্বিয়া বেগম, সদর মিঠাপুর এলাকার আলমগীর মুন্সী, সদর পেয়ারপুর ইউনিয়নের বরাইল বাড়ি এলাকার সবুজ মিঞা, রাজৈর মহিষমারি এলাকার সজীব, রাজৈর বলগ্রাম এলাকার মাসুদ ও মিরাজ মাদবর। শরীয়তপুর নড়িয়া উপজেলার রফিক মাদবর। টাঙ্গাইল নাগরপুর উপজেলার কনোরা এলাকার সোহেল ও তার সহযোগী আফজাল হোসেনসহ শত শত দালাল নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তবে এসব বন্ধে প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন সাধারণ মানুষ।

এদিকে ভুক্তভোগী পরিবারের চাপে পড়ে ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। মুঠোফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা বিষয়টি অস্বীকার করেন। অভিযুক্তদের পরিবারের সঙ্গে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা কিছুই জানেন বলে দাবি করেন। এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়ে অনেকে ঘরে তালা দিয়ে উধাও হয়েছেন।

তবে মাদারীপুর সদর চরমুগিরা কুমারের ট্যাক এলাকার চিহ্নিত দালাল ইউপির সাবেক মহিলা সদস্য আম্বিয়া বেগমকে পাওয়া যায় তার বাড়িতে। দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে আপনার বিরুদ্ধে, এবং আপনার মাধ্যমে লিবিয়ায় গিয়ে ওই এলাকার ১৪ জন যুবক বর্তমানে লিবিয়ার জেলে আটক রয়েছেন, এমন প্রশ্নে আম্বিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কাছে লিবিয়া যাওয়ার জন্য কেউ টাকা দেয়নি। আমি শুধু আমার বোনজামাইকে পাঠানোর জন্য টাকা নিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা অভিযোগ করছেন।

শুধু লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার নামেই নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে ইতালি যাওয়ার নামেও চলছে দালালদের প্রতারণা। চলতি বছরের ৩ আগস্ট মাদারীপুরের পাঁচ যুবককে রোমানিয়ায় আটকে রেখে ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে ১০ লাখ টাকা করে দাবি করেছিল দালাল চক্র। ভুক্তভোগী পরিবার থানায় অভিযোগ করলেও পরে দালালদের সঙ্গে সমঝোতা হলে মামলা তুলে নেন তারা। সংগত কারণেই দালাল চক্রটি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।

মাদারীপুর জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বিদেশে যেতে নিয়মিত প্রতারিত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও মামলা করতে আগ্রহ দেখায় না অধিকাংশ ভুক্তভোগী পরিবার। আবার মামলা করলেও পরে সমঝোতা করে নেয় পরিবার। তবে সম্প্রতি মানব পাচার আইনে মামলা করার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে মানব পাচার আইনে মামলা হয় দুটি। পরের বছর হয় মাত্র একটি। এ দুই বছরে কেউ গ্রেফতার হননি। ২০১৯ সালে তিনটি মামলায় তিনজন গ্রেফতার হন। পরের বছর মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১টিতে, আর গ্রেফতার হন ৩৫ জন। এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু গ্রেফতারের কিছুদিন পরেই অধিকাংশই জামিনে বের হয়ে আবার মানব পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন।

দালালদের প্রলোভনে আগ্রহী হয়ে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা গিয়েছেন মাদারীপুর জেলার অনেক যুবক। কেউ কেউ অবৈধভাবে বিদেশ গিয়েও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আবার অনেক যুবক নিখোঁজ আছেন বছরের পর বছর ধরে। পরিবারের লোকজন এখনো তাদের আশার পথ চেয়ে বসে আছেন।

চলতি বছরের ১৬ মে ৮৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী লিবিয়া থেকে নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়া সিমান্তে আসার পর নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এরপর তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে ৩৩ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে জীবিত উদ্ধার করে। পরে জনা যায়, ৩৩ জনের মধ্যে ৩০ জনই ছিলেন মাদারীপুরের। কিন্তু সে সময় নিখোঁজ থেকে যান মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের নয়াচর গ্রামের সেন্টু মন্ডল। তার পরিবারের লোকজন জানান, এখন পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি সেন্টু মন্ডলের।

স্থানীয় রাজীব হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, সাগর পাড়ি দিতে ঝুঁকি আছে, এ কথা জেনেও সবাই যান। কিন্তু সবাই দালালের প্রলোভনে পড়ে সব ভুলে যায়। পরে দালালরা তাদের জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দেয় পুরো পরিবার। দালালদের ফাঁসি হওয়া উচিত। প্রশাসনের তৎপর ভূমিকা থাকলে এ ধরনের অপরাধ অনেক কমে যেত।

লিবিয়ার জেলখানায় বন্দি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বলগ্রামের বাসিন্দা সামিউলের (২১) মা রেবা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বলগ্রাম এলাকার মিরাজ নামের এক দালালের মাধ্যমে ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছি। সেখান থেকে ইতালি যাওয়ার গেম করানোর জন্য শিপন নামের এক দালালকে টাকা দিই। এ পর্যন্ত আমার ১৫ লাখ টাকা গেছে। এখন আমি আমার ছেলে সামিউলকে জেল থেকে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই।

মাদারীপুর সদর রাজারহাট এলাকার লিমা বেগমের স্বামী সুজন মাতুব্বর বন্দি রয়েছেন লিবিয়ার একটি কারাগারে। লিমা বেগম বলেন, আমরা মোশারফ নামের এক দালালের মাধ্যমে লিবিয়া পাঠিয়েছি আমার স্বামী সুজন মাতুব্বরকে। ইতালি যাওয়ার পথে তিনবার পুলিশের কাছে ধরা খাইছেন তিনি। তিনবারই অনেক টাকার বিনিময়ে তাকে ছাড়ানো লাগছে। এখনো তিনি জেলে আছেন। আমি আমার স্বামীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের সহযোগিতা চাই।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইতালি যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি মাদারীপুর জেলায়। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশের কাছে আসেন পরিবারের লোকজন। এর বাইরে সাধারণত কেউ অভিযোগ করেন না। তবে পুলিশ নিজস্ব উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে মামলা করার জন্য উৎসাহী করা হয়।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, আমরা দালাল চক্রের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে আছি। লিবিয়ায় যারা বন্দি আছে, তাদের অধিকাংশই অবৈধ পথে সেখানে গিয়েছে। তারপরও তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে চেষ্টা করছি। তাদের স্বজনরা লিখিত দিয়েছে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি জানানো হয়েছে। দেখা যাক কী করা যায়।

কেউ যাতে অবৈধ পথে বিদেশ যেতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা সবাইকে সচেতন করছি। আমরা দালালদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ