• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

মহেশখালীতে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বড় হাব তৈরি করছে সরকার

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১  

কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বড় হাব তৈরি করছে সরকার। এখানে নির্মিত হচ্ছে ২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ৫টি এলএনজি ও এলপিজি টার্মিনাল, তেল সংরক্ষণাগার ও শোধনাগার, সাগর থেকে জ্বালানি তেল খালাসে স্থাপন করা হচ্ছে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে চারটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই উপজেলার দুটি দ্বীপ মাতারবাড়ি ও ধলঘাটায় বেশিরভাগ প্রকল্পের অবকাঠামো স্থাপনের কাজ চলছে। তবে পুরো মহেশখালীতেই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আনতে সমুদ্রে প্রসস্ত ও গভীর চ্যানেল খনন, জেটি নির্মাণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধার্থে স্থানীয়ভাবে নির্মিত রাস্তা-ঘাট, সেতুসহ অবকাঠামোগত নানা উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে এই উপজেলায় বাস্তবায়নাধীন ও পরিকল্পনাধীন সরকারি-বেসরকারি ৩৭টি প্রকল্প।

লবণ উৎপাদন, পান চাষ, মাছ ধরা আর শুঁটকি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা প্রত্যন্ত এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের চোখেও এখন নতুন আশা, অদূর ভবিষ্যতে উন্নত জীবনের স্বপ্ন।

বাস্তবায়ন শেষে মহেশখালীর এসব প্রকল্পের এই অঞ্চলের অভূতপূর্ব উন্নয়নের পাশপাশি দেশের অর্থনীতিতেও বহুমাত্রিক অবদান রাখবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাগরের কোল ঘেঁষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল অবকাঠামো। ঘাট থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেতে প্রয়োজন মাফিক রাস্তা ও সেতুর নির্মাণ এবং উন্নয়ন করা হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার বিঘা জমিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় চার বছর আগে। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জাপান। পরিকল্পনা রয়েছে প্রথম ধাপে দুটি ইউনিট চালুর। যার প্রতিটি থেকে আসবে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এরকম আরও দুটি ইউনিট করতে চায় কোল পাওয়ার কোম্পানি, তাহলে এখান থেকে আসবে দুই হাজার চারশ মেগাওয়াট। দেশি-বিদেশি সাড়ে সাত হাজার শ্রমিক-প্রকৌশলী এখানে কাজ করছেন। এরই মধ্যে প্রথম ইউনিটের ৫৫ ভাগের বেশি কাজ শেষ বলে জানিয়েছেন মাতাবাড়ি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন।

সমুদ্রপথে কয়লা আমদানির সুবিধার্থে ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, ২৫০ মিটার প্রস্থ এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীরতার চ্যানেল খননের কাজ প্রায় শেষ। প্রস্তুত করা হয়েছে ‘শক্তিশালী’ দুটি জেটি। এর একটিতে বড় জাহাজে করে কয়লা, অন্যটিতে খালাস হবে প্ল্যান্টের তেল।

এদিকে মহেশখালীতে জ্বালানি হাব গড়ে তুলতে বাস্তবায়িত হচ্ছে বেশ কয়েকটি প্রকল্প। এরমধ্যে রয়েছে একাধিক তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) টার্মিনাল, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) টার্মিনাল, তেল সংরক্ষণাগার, তেল শোধনাগার। এ ছাড়া এখান থেকে দেশের সব আমদানি করা তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পাঠানোর জন্য স্থাপন করা হচ্ছে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন।

ইতোমধ্যে সাগরে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ৯০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে জাতীয় সঞ্চালন পাইপলাইনে। এছাড়া, আরও তিনটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ধলঘাটের স্থলভাগে দুটি আর সাগরে আরেকটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল করবে সরকার। তিনটি টার্মিনালের সম্মিলিত ক্ষমতা হবে দৈনিক ৩৫০ কোটি ঘনফুট। দেশে গ্যাসের চাহিদার বড় অংশই এখানকার এলএনজি দিয়ে পূরণ হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মালিকানায় মাতারবাড়ীর ধলঘাটে একটি এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

মহেশখালীর কালারমারছড়াতে তেল মজুদের বিশাল অবকাঠামো গড়ে তুলছে জ্বালনি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এক লাখ টনের একটি জাহাজ থেকে তেল খালাস করতে সময় লাগে ১১ দিন। এ সময় জাহাজকে বাড়তি ভাড়া দিতে হয়। তেল খালাসের এই সনাতন ব্যবস্থা থেকে এবার বাংলাদেশ মুক্তি পেতে যাচ্ছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের (এসপিএম) মাধ্যমে।

বর্তমানে বিদেশ থেকে তেল আমদানি করার পর তা চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে করে খালাস করা হয়। অপরিশোধিত বা ক্রুড তেল হলে তা পরিশোধন করে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য ডিপোতে পাঠানো হয়। এতে তেলের অপচয় ও চুরি হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ভিড়তে না পারায় মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটার জাহাজে করে তেল পরিবহন করায় অপচয় হয়, বাড়ে পরিবহন খরচ।

এসপিএমের অবকাঠামো হিসেবে গভীর সমুদ্রে স্থাপন করা হচ্ছে বিশেষ একধরনের বয়া, যার ভেতর থাকবে পাইপলাইন। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে স্থলভাগের তেল সংরক্ষণাগারে আসবে তেল। এসপিএমের মাধ্যমে একটি জাহাজ থেকে ১ লাখ টন তেল খালাস করতে মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগবে।

এসপিএমের মাধ্যমে তেল খালাস করতে পাইপলাইন স্থাপন করা লাগবে মোট ২২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সমুদ্রের তলদেশে ১৩৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। দুটো পাইপলাইন থাকছে, একটি দিয়ে অপরিশোধিত তেল অন্যটি দিয়ে পরিশোধিত তেল পরিবহন করা হবে। এতে করে বছরে কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছেন বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ। তিনি বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জ্বালানি মজুদে বাংলাদেশের সক্ষমতা অনেকটাই বাড়বে, যা জ্বালানি নিরাপত্তায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

এ ছাড়া বিপিসির মালিকানায় ধলঘাটায় এলাকায় একটি তেল শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানও এখানে তেল শোধনাগার তৈরি করবে।

মহেশখালীকে নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, ‘দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বড় বলয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এখানে। বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি, এলপিজি টার্মিণালসহ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এই দ্বীপ উপজেলাটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূণ ভূমিকা রাখবে।

উল্লেখ্য, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়েল অধীনে মাতারবাড়ীতে নির্মিত হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্রবন্দরের পণ্য আনা-নেয়ার জন্য রেল ও সড়কপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। নির্মিত হবে তিনটি ‘ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল’। এ অঞ্চলে হবে তিনটি অর্থনৈতিক জোন (ইজেড)। এছাড়া, সোনাদিয়া দ্বীপে একটি ইকোপার্কে স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ