• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

ফিলিপিনো ব্যাংকারের সাজা হলেও ঢিমেতালে দেশীয় তদন্ত

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯  

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকের ঘটনা তিন বছরে গড়িয়েছে। বিশ্বে সাড়া জাগানো সবচেয়ে বড় সাইবার চুরির ঘটনায় এখনো পর্যন্ত মামলার প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের তৈরি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও জনসমক্ষে আসেনি। ২০১৬ সালে সেই ঘটনার পর ফিলিপাইনের একটি সংবাদপত্রে এ বিষয়ে তদন্তের খবর বের হয়। পরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে অবগত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছোটাছুটি করে কিছু অর্থ উদ্ধার করার বিষয়ে জানালেও বেশির ভাগ অর্থ উদ্ধার হয়নি। ইতোমধ্যে অর্থ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের এক ব্যাংক কর্মকর্তার সাজা ঘোষণা করেছে ফিলিপাইনের আদালত কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলায় সিআইডি বারবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিচ্ছেন।

ঘটনার সূত্রপাত

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ লেনদেনকারী হিসাব হতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে মোট ৭০টি ভুয়া পেমেন্ট বার্তা পাঠানো হয়। এরমাধ্যমে সর্বমোট ১৯২ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার স্থানান্তরের প্রচেষ্টা চালায় হ্যাকারা। এর মধ্যে ১টি বার্তার বিপরীতে শ্রীলংকায় ২ কোটি মার্কিন ডলার এবং ৪টি বার্তার মাধ্যমে মোট ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ফিলিপাইনের একটি ব্যাংকের চারজন গ্রাহকের হিসাবে প্রেরণ করা হয়।

জুয়ার টেবিলে চলে যায় অর্থ

শ্রীলঙ্কার প্যান এশিয়া ব্যাংকিং করপোরেশনে চলে যাওয়া অর্থ আটকে যায় একটি বানান ভুলের কারণে। শ্রীলঙ্কায় শালিকা ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিওর অ্যাকাউন্টে ২ কোটি ডলার পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু হ্যাকার অর্ডারে foundation এর জায়গায় fandation লিখেছিল। তাতেই ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। স্থানান্তর আটকে দেওয়া হয়। পরে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ‘স্টপ পেমেন্ট রিকোয়েস্ট’ ম্যাসেজ পাঠানোর পর ২ কোটি ডলার আটকে দেয় সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০ মিলিয়ন ডলার চলে আসলেও ৮১ মিলিয়ন ডলার চলে যায় ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে। ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) ৪টি হিসাবে জমা হয় সেই অর্থ। যা পরবর্তীতে একটি মানি রেমিটেন্স কোম্পানি হয়ে ফিলিপাইনে পরিচালিত ক্যাসিনোতে চলে যায় এবং পরবর্তীতে তা একজন ফিলিপিনো-চাইনিজ ব্যবসায়ী কর্তৃক তুলে নেওয়া হয়। মোট ৮১ মিলিয়ন ইউএস ডলার আরসিবিসির জুপিটার স্ট্রিট, মাকাতি সিটি শাখায় পরিচালিত ভূয়া হিসাবে স্থানান্তর হয়। ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংক আরসিবিসির বিরুদ্ধে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের ভার তাদের এন্টি মানিলন্ডারিং বিভাগের উপর অর্পণ করে। পরে রিজল ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখাসহ তিনটি ব্যাংকের হিসাবসমূহ স্থগিতকরণসহ আনুষ্ঠানিক তদন্তের নির্দেশ জারি করা হয়। ফিলিপাইনের সিনেটের ব্লু রিবন কমিটিতে মোট ৭টি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে অর্থ চুরির বিষয়ে ফিলিপিনো চাইনিজ ব্যবসায়ী কিম, রিজল ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মানি রেমিটেন্স কোম্পানি ফিলমোর সার্ভিসেস কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো উন্মোচিত হয় এবং এর ভিত্তিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে ফিলিপাইনের আইনি প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

ফিলিপিনো-চাইনিজ ব্যবসায়ী কিম অং কর্তৃক নগদে ফেরতকৃত ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশকে ফেরত প্রদানের জন্য এন্টি মানিলন্ডারিং কাউন্সিল ও কিম অং কর্তৃক আদালতে একটি জয়েন্ট মোশন দাখিল করা হয়। এরমাধ্যমে দেড় কোটি ডলার বাংলাদেশ ফিরে পাবে বলে আশা করা হয়েছে। কিন্ত উদ্ধার করা যায়নি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার।

গভর্নরের পদত্যাগ

রিজার্ভ চুরির এই ঘটনা ঘটার এক মাস অতিবাহিত হলেও সরকার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে গোপন রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেসময় দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে পদত্যাগ করেন। ১৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিকট তার পদত্যাগ পত্র জমা দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা জড়িত

তদন্ত প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানাগেছে, রিজার্ভ চুরির বিষয়ে ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্তকারী দলের দেয়া চুড়ান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ জনের নাম এসেছে। এরা হলেন, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা, উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান ভূঁইয়া, জিএম আব্দুল­াহ ছালেহীন, শেখ রিয়াজউদ্দিন ও রফিক আহমেদ মজুমদার, গভর্নর সচিবালয় বিভাগে কর্মরত মইনুল ইসলাম।

চুরির ঘটনায় মায়ার সাজা

ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের তখনকার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস-দেগুইতোকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দিয়েছে দেশটির আদালত। গেলো ১০ জানুয়ারি মায়ার বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিটি অপরাধে তাকে চার থেকে সাত বছরের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে ফিলিপাইনের মাকাতির আঞ্চলিক আদালত। একই সঙ্গে ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানা পরিশোধ করারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। মাকাতির আঞ্চলিক আদালত ২৬ পৃষ্ঠার রায়ে বলা হয়েছে, ওই ঘটনার সময় আরসিবিসি জুপিটার শাখার দায়িত্বে ছিলেন মায়া। সুতরাং অর্থপাচারের দায়ে অবশ্যই তিনি অপরাধী। চারটি অজানা ও কাল্পনিক হিসাবে কোটি ডলার অর্থ জমা এবং তা তুলে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন মায়া। এ অর্থ একটি রেমিট্যান্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পেসোতে রূপান্তর করে জুয়ার বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়।

ফেরেনি অর্থ

ফিলিপাইনে যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে এখনো উদ্ধার করা যায়নি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের জন্য আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রে গমনও করেন। দফায় দফায় সরকারি ঊর্ধতন কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্র গমন করলেও তিনবছর পার হয়েগেছে। এদিকে এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দায়িত্ব পাওয়ার পর সিআইডি বারবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ