• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

মৃত্যুর ২৪১৫ বছর পরে আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত সক্রেটিস!

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২১  

সক্রেটিস। একজন বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক। বিশ্বে যত বড় বড় দার্শনিকের জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম সক্রেটিস। এই গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে চেনেন না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।

ইউরোপের দেশ গ্রিসে তার জন্ম। উইকিপিডিয়ায় সক্রেটিস সম্পর্কে জেনেছি বহু আগেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রেটিসকে বন্দি করে রাখা সেই জেলখানার ছবি দেখেছি অনেক। তখন থেকেই মনে আগ্রহ জাগে কোনোদিন গ্রিসে গেলে বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের শেষ ঠিকানায় যাব। সেই আগ্রহ থেকেই একদিন গিয়েছিলাম সক্রেটিসের জেলখানায়। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। পাহাড়ের ওপর থেকে যেন পুরো এথেন্স ক্যামেরাবন্দি করা যায়। সবমিলিয়ে খুবই চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

 

ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে সক্রেটিসের শৈশব সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তবে উনার শিষ্য প্লেটোর লেখনিতেই সক্রেটিস সম্পর্কে জানা যায়। পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে মহান দার্শনিক সক্রেটিসের (জন্ম খ্রি.পূ. ৪৬৯-মৃত্যু খ্রি.পূ. ৩৯৯, জন্মস্থান: এথেন্স, গ্রিস) নাম উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে। প্লেটোর বর্ণনামতে সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস, যিনি পেশায় একজন স্থপতি (অন্য মতে ভাস্কর) এবং মায়ের নাম ফিনারিটি, যিনি একজন ধাত্রী ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম জ্যানথিপ। সংসার জীবনে তাদের তিন ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। অভাবের সংসার বলে সংসার জীবনে খুব একটা সুখী ছিলেন না। সংসারের জ্বাল-যন্ত্রণা ভুলতে তিনি বেশিরভাগ সময় দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তার নাক নাকি ছিল থ্যাবড়া। দেখতেও ছিলেন অনেকটা কুৎসিত। তবে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। তর্কে ছিলেন তুখোড়। তর্ক করে কেউ তাকে হারাতে পারতো না। তার প্রিয় বাক্য ছিল ‘নিজেকে জানো’।

সক্রেটিস তার নিজ দর্শন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার প্রভৃতি যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সঙ্গে বিনামূল্যে তিনি দর্শন আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন।

সোফিস্টদের মতো তিনি শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণকে ঘৃণা করতেন। দার্শনিক আলোচনার প্রতি তার এত বেশি ঝোঁক ছিল যে, তিনি প্রায়শই বলতেন- “নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়াই আমার অভ্যাস, আর এজন্যই এমনিতে না পেলে পয়সা-কড়ি দিয়ে হলেও আমি দার্শনিক আলোচনার সাথী সংগ্রহ করতাম।”

তিনি নিজেকে কখনও সোফিস্টদের মত জ্ঞানী ভাবতেন না। তিনি বরং বলতেন- “আমি জ্ঞানী নই, জ্ঞানানুরাগী মাত্র। একটি জিনিসই আমি জানি; আর সেটি হলো এই যে, আমি কিছুই জানি না।”

জ্ঞান, শিক্ষা দিয়ে তিনি এথেন্সের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার প্রিয় শিষ্য প্লেটো প্রচার করতে থাকেন গুরুর শিক্ষা-দীক্ষা। কিন্তু দেশটির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সক্রেটিসের এ খ্যাতি মেনে নেয়নি। পছন্দ করেনি তার শিক্ষা-দর্শন।

একপর্যায়ে তারা অভিযোগ করেন, সক্রেটিস নাকি যুব সমাজকে বিপথগামী করছেন। এ অভিযোগে তাকে ঢোকানো হলো কারাগারে। কিন্তু এতেও তাকে থামানো যায়নি। তাই সিদ্ধান্ত হয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার।

সত্য ও জ্ঞানের প্রতি অবিচল সক্রেটিসকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত অভিযোগে তাকে হেমলক বিষপানে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সক্রেটিস নিজ হাতে বিষাক্ত হেমলকের রস পান করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েন। তার নশ্বর দেহটা এথেন্সে মাটিতে মিশে গেলেও তার আদর্শ ও চিন্তা যুগ যুগ মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার প্রেরণা জুগিয়েছে। মৃত্যুর আগে তাকে পালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি পালাননি।

এদিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ২৪১৫ বছর পরে গ্রিসের একটি আদালত জানালেন, সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন।

এথেন্সের তৎকালীন আরাধ্য দেবতাদের নিয়ে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলেছিলেন সক্রেটিস। তার বিরুদ্ধে অত্যাচারী শাসকদের সমর্থনেরও অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও বলা হয় যে, সক্রেটিস নির্দোষ হলেও মুখ বুজে বিচারকদের রায় মেনে নিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে পালানোর সুযোগ পেলেও এথেন্স ছেড়ে যাননি তিনি।

হেমলক বিষপান করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মাথা পেতে নিয়েছিলেন সক্রেটিস। তিনি সত্যিই দোষী ছিলেন কিনা, সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য এথেন্সের ওনাসিস ফাউন্ডেশনের একটি আদালতে ফের নতুন করে বিচারব্যবস্থার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই বিচারেই সক্রেটিসকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে রায় দিয়েছে ওই আদালত।

সক্রেটিসের সমর্থনে তার আইনজীবী বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির অভিমত অপরাধ হতে পারে না। সক্রেটিস সত্যের সন্ধান করতেন। আর তা করতে গিয়েই তিনি তার নিজস্ব মত তুলে ধরতেন। তবে আমার মক্কেলের একটাই দোষ, তিনি উস্কানিমূলক কথা বলে মানুষকে খ্যাপাতেন। আর সবসময় বাঁকা বাঁকা কথা বলতেন। যেমন- তিনি বলতেন, দেখাও তোমাদের গণতন্ত্র কতটুকু খাঁটি ও বিশ্বাসযোগ্য ইত্যাদি।’ কিন্তু তিনি আরও বলেন যে, সাধারণ মামলাকে জটিল করার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দেওয়াটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

সক্রেটিসের হয়ে এই মামলায় ফ্রান্সের এই বিখ্যাত আইনজীবী সওয়াল করেন। উল্টোদিকে গ্রিসসহ বেশ কয়েকটি দেশের আইনজীবীরা সক্রেটিসের বিরোধিতা করেন। এই মামলার বিচারের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল তৈরি করা হয়। দীর্ঘ বাদানুবাদের পরে সক্রেটিসের আইনজীবীর যুক্তিতেই সিলমোহর দেন বিচারকরা। ২০১৬ সালে নিউইয়র্কের একটি আদালতেও সক্রেটিস নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।

তিনি এমন এক দার্শনিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রবর্তক যা কিনা পাশ্চাত্য সভ্যতা, সংস্কৃতি ও দর্শনকে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রভাবিত করেছে।

সক্রেটিসের কয়েকটি উক্তি:
* ‘বিস্ময় হলো জ্ঞানের শুরু।’
* ‘টাকার বিনিময়ে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে অশিক্ষিত থাকা ভালো।’
* ‘জ্ঞানের শিক্ষকের কাজ কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে উত্তর জেনে দেখানো যে জ্ঞানটা তার মধ্যেই ছিল।’
* ‘বন্ধু হচ্ছে দুটি হৃদয়ের একটি অভিন্ন মন।’
* ‘পোশাক হলো বাইরের আবরণ, মানুষের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে তার জ্ঞান।’
* ‘নিজেকে জানো।’
* ‘তুমি কিছুই জান না এটা জানা-ই জ্ঞানের আসল মানে।’
* ‘তুমি যা হতে চাও তা-ই হও।’
* ‘কঠিন যুদ্ধেও সবার প্রতি দয়ালু হও।’
* মৃত্যুই হলো মানুষের সর্বাপেক্ষা বড় আশীর্বাদ।

সক্রেটিসকে যদি হেমলক পানে হত্যা করা না হতো তাহলে জগৎ হয়তো আরো অনেক মহৎ জ্ঞান পেতে পারত। কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার নশ্বর দেহের শেষ হলেও চিন্তার শেষ আজও হয়নি। তার প্রিয় শিষ্য প্লোটো এবং প্লোটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলের মধ্য দিয়ে সেই চিন্তার এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হলো, যা মানুষকে উত্তেজিত করছে আজকের পৃথিবীতে।
 

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ