• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

চুলোর ধোঁয়ায় নারীদের ক‌্যানসার

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩ জানুয়ারি ২০২০  

দেশে বর্তমানে ১৪ থেকে ১৫ লাখ ক‌্যানসারের রোগী রয়েছে। সেই সাথে প্রতিবছর নতুন করে দেড় থেকে দুই লাখ ক‌্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। গত দুই তিন বছরে ব্রেস্টক‌্যানসারের তুলনায় নারীদের ফুসফুস ক‌্যানসারের হার বেড়েছে। আর এজন‌্য বিশেষজ্ঞরা চুলার ধোঁয়াকে দায়ি করছেন।

একটু সচতেন থাকলে ৪০ শতাংশ ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ক‌্যানসারের লক্ষণ, নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে মহাখালী ক‌্যানসার হাসপাতালের মেডিক‌্যাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অ‌ধ‌্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

ক‌্যানসারে লক্ষণ

রফিকুল ইসলাম : ক‌্যান্সারের কিছু লক্ষণ আছে। যেমন-হঠাৎ করে আপনার শরীরে যদি দেখেন একটা চাকা কিংবা পিণ্ড তৈরি হচ্ছে। বা যেটা আগেও ছিল, কিছুদিন ধরে বাড়ছে, দুই তিনমাস ধরে বাড়ছে, ব‌্যাথা হচ্ছে, রংয়ের পরিবর্তন হচ্ছে, আপনার। অথবা টয়লেট করতে কোনো সমস‌্যা হচ্ছে। যেমন-আগে আপনার প্রতিদিন সকালে হতো, এখন দিনে দুই তিনবার পাতলা পায়খানা হচ্ছে। পায়খানার রং পরিবর্তন হচ্ছে। পায়খানার সময় পেটে প্রচন্ড ব‌্যাথা হচ্ছে, পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাচ্ছে, কিংবা প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাচ্ছে।

অথবা দেখলেন, আপনার শরীরে একটা ঘাঁ আছে, যেটা শুকাচ্ছে না। দীর্ঘ তিন সপ্তাহ চার সপ্তাহ চিকিৎসা করছেন, শুকাচ্ছে না কিংবা দেখলেন আপনার কাশি হচ্ছে, কাশি ভালো হচ্ছে না। অ‌্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন, ডাক্তারের পরামর্শেও ভালো হচ্ছে না। বুকে ব‌্যাথা হচ্ছে বা কাশির সাথে রক্ত আসছে।

অথবা দেখলেন গলায় কোনো জায়গায় চাকা হচ্ছে, মহিলাদের ক্ষেত্রে স্তনে কোনো চাকা হচ্ছে, মাসিক অনিয়মিত হচ্ছে, অনেক ব্লিডিং হচ্ছে, তলপেট অনেক ব‌্যাথা হচ্ছে, তলপেটে কোনো চাকা অনুভূত হচ্ছে।

আপনি এই লক্ষণ গুলো যদি দেখেন, সাথে সাথে অন্তত একজন এমবিবিএস ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হবেন। মনে রাখবেন, ক‌্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এখন আমাদের দেশে আছে। তাদের সঠিক পরামর্শ কিন্ত আপনাকে একটা সুন্দর জীবন ব‌্যবস্থা দিতে পারে। সুন্দর চিকিৎসা পদ্ধতি গাইড করতে পারবে। তাই ক‌্যান্সার হলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ক‌্যান্সার হলেই চট করে অন‌্য কোনো দেশে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের দেশে যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের পরামর্শ নিন। ক‌্যান্সার হলে জাতীয় ক‌্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউটে আসুন। হয় তো লাইন একটু দীর্ঘ হবে। তবু সঠিক চিকিৎসা পাবেন।

বর্তমানে দেশে ক্যান্সারের চিত্র

রফিকুল ইসলাম : বর্তমানে দেশে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ লাখ ক‌্যান্সার রোগী আছে। এই ১৪-১৫ লাখের মধ‌্যে নতুন করে দেড় থেকে দুই লাখ নতুন রোগী যোগ হচ্ছে।

ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের উপায়

রফিকুল ইসলাম : কিছু বিষয় যদি আমরা পরিবর্তন করতে পারি, তাহলেই ৪০ ভাগ ক‌্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আপনি যদি চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন, মাংস খাওয়া কমিয়ে দেন, তাহলে আপনার কিন্তু অনেকাংশে কোলন ক‌্যান্সারের ঝুঁকি কমে যাবে। আপনার স্তন ক‌্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। আপনি যদি শাকসবজি রঙিন ফলমূল বেশি খান, আপনার কোলন ক‌্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে। আপনি যদি ধুমপান ছেড়ে দেন, আপনার কিন্তু ফুসফুস ক‌্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।

আপনি যদি পান, জর্দা, তামাক খাওয়া ছেড়ে দেন, আপনার কিন্তু খাদ‌্যনালী ক‌্যান্সার, মুখ গহ্বরের ক‌্যান্সারের ঝুঁকি অনেক অনেক কমে যাবে। আপনি যদি জাঙ্ক ফুড খাওয়া কমিয়ে দেন, অতিরিক্ত গরম পানি, চা বা বিভিন্ন ধরনের ড্রিঙ্ক কমিয়ে দেন খাদ‌্যনালী ক‌্যান্সার, মুখগহ্বর ক‌্যান্সার, পাকস্থলী ক‌্যান্সার এগুলো থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। অর্থাৎ আমাদের অভ‌্যাসগত পরিবর্তনের কারণে আমরা কিন্তু ৪০ ভাগ ক‌্যান্সার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।

ক্যান্সার হলে করণীয় ও নিরাময় যোগ্য ক্যান্সার

রফিকুল ইসলাম : যারা ক‌্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চট করে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভাবার কিছু নেই যে, আমার ক‌্যান্সার হয়েছে আমি মারা যাব। বেশ কিছু ধরনের ক‌্যান্সার আছে, একেবারেই পুরোপুরি নিরাময় যোগ‌্য।

নিরাময় যোগ‌্য ক‌্যান্সার যেমন- ছেলেদের অন্ডকোষে ক‌্যান্সার। এটাকে আমরা বলি টেস্টিকুলার ক‌্যান্সার। যদি জার্মেসের লাইন হয়, এটা নিরাময় যোগ‌্য। অনেক লিংফোমা নিরাময় যোগ‌্য, আর্লি স্টেজে অনেকগুলো ক‌্যান্সার আছে, সেগুলো নিরাময় যোগ‌্য। ব্লাড ক‌্যান্সারের কিছু ধরন আছে, সেগুলো নিরাময় যোগ‌্য।

বর্তমানে যেসব ধরনের ক্যান্সার বেশি হচ্ছে

রফিকুল ইসলাম : বিগত তিন চার বছর ধরে মহিলাদের ফুসফুস ক‌্যান্সারের হার বেড়েছে। আমরা এ নিয়ে গবেষণাও করেছি। কিছু তথ‌্য উপাত্ত নিয়ে কাজ করেছি। মহিলাদের ফুসফুস ক‌্যান্সারের একটা কারণ, বিশেষ করে বয়স্ক মহিলা যারা ৬০ বছর বয়স হয়ে গেছে-তাদের এ ধরনের ক‌্যান্সারের প্রবণতা বেশি।

মহিলাদের ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ

রফিকুল ইসলাম : আমাদের দেশে একটা ধারণা আছে যে, মহিলারা তো ধুমপান করে না- তাহলে তাদের কেন ফুসফুস ক‌্যান্সার হয়? এটা আসলে ধুমপায়ীদের একটা যুক্তি। মূলত তারা পরোক্ষ ধুমপানের শিকার। তার পরিবারের যেমন- স্বামী, ছেলে, শ্বশুর বা অন‌্য কেউ ঘরে বসে ধুমপান করছে, আর সেখানে সে বসে আছে বা কাজ করছে। এটাকে প‌্যাসিভ স্মোকিং বলে। নিজের ক্ষতি করছেন তো করছেন, পাশের জনেরও ক্ষতি করছেন।

আরেকটা কারণ হচ্ছে চুলার ধোঁয়া। বেশিরভাগ গ্রামে মহিলারা ‍চুলায় রান্না করেন। অনেকক্ষণ চুলার কাছে বসে আছেন। তাদের ফুসফুস ক‌্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি। তারা কিন্ত প্রথমে বুঝতে পারেন না। উপসর্গ হিসেবে কাশি দেখা দেয়। স্থানীয় দোকান থেকে একটা সিরাপ এনে খাইয়ে দিলো। কিন্তু এই অবহেলার কারণে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এমন একটা পর্যায়ে আমাদের কাছে আসে তখন বেশি কিছু করার থাকে না। শুধু মহিলাদের ক্ষেত্রেই নয়, কিছু কিছু ফুসফুস ক‌্যান্সার আছে যেগুলোতে কেমো বা রেডিও থেরাপি লাগে না। মুখে খাওয়ার অষুধ দিয়েই নিরাময় যোগ‌্য না হলেও নিয়ন্ত্রণযোগ‌্য। এটাকে টার্গেটেট থেরাপি বলে।

টার্গেটেট থেরাপির সুবিধা

রফিকুল ইসলাম : টার্গেটেট থেরাপির সুবিধা হচ্ছে– কেমো থেপারিতে যেমন চুল পড়ে যাওয়া, খেতে না পারা- এগুলো হয় না। কেমো থেরাপির চেয়ে টার্গেটেট থেপারির ভালো রেজাল্ট। টার্গেটেট থেরাপি বহির্বিশ্বে সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি। আমাদের দেশে এই ওষুধগুলি সহজলভ‌্য বলব না, তবে আছে। আপনি চিকিৎসার মধ‌্যে আসতে পারেন।

কেমো থেরাপির আর টার্গেটেট থেপারির যদি তুলনা করেন- তাহলে দেখবেন কেমো থেরাপিতে যদি কারো ছয় মাস বাঁচার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে টার্গেটেট থেরাপিতে এক থেকে দেড় বা কারো কারো ক্ষেত্রে পাঁচ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে। কাশি হলে অবহেলা না করে গ্রামীণ মহিলাদের যদি চিকিৎসকের কাছে আনতে পারি তাহলে এই হার কমে আসবে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ