• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

দেশি মাছের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১২ জুন ২০২১  

দেশে এক যুগে দেশি ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে অন্তত চার গুণ। বিলুপ্তপ্রায় ৬৪টি প্রজাতির মধ্যে ২৯টির মাছের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে। সর্বশেষ সফলতায় যুক্ত হয়েছে বিলুপ্ত প্রজাতির পিয়ালি মাছ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এ মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি পর্যায়ক্রমে চাষাবাদে নিয়ে আসা হবে।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) বাংলাদেশের হিসাবমতে, দেশের ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। এর মধ্যে ৯ প্রজাতির মাছ অতিবিপন্ন, ৩০ প্রজাতির বিপন্ন এবং ২৫ প্রজাতির শঙ্কাগ্রস্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণায় পিয়ালিসহ ২৯ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে পাবদা, গুলশা, টেংরা, বাটা, ফলি, মহাশোল, খলিশা, বৈরালী, ঢেলা, বাতাসি ইত্যাদি অন্যতম। বাজারে এসব মাছের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই। গত ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশি ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। দেশি প্রজাতির ছোট মাছ সুরক্ষায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশে প্রথমবারের মতো একটি ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশি মাছ রক্ষায় ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম সাম্প্রতিককালে জোরদার করা হয়েছে। সব দেশি মাছকে সুরক্ষা করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ দেশব্যাপী এ মাছ ছড়িয়ে দেওয়াই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। চলতি বছর ইনস্টিটিউট ১০টি দেশি প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে ঢেলা, বাতাসি, লইট্যা, ট্যাংরা, পুইয়া ও পিয়ালি মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। আরও কিছু চমক শিগগিরই আসছে।’ জানা যায়, পিয়ালি মাছ এলাকাভেদে জয়া, পিয়ালি বা পিয়াসী নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Aspidoparia jaya। এ মাছটি সিপ্রিনিডি (Cyprinidae) পরিবারভুক্ত মিঠাপানির একটি মাছ। বাংলাদেশ (পদ্মা ও যমুনা এবং এগুলোর শাখা নদীতে), ভারত (আসাম, উত্তরাঞ্চল, উত্তর প্রদেশ), নেপাল, ইরান, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও আফগানিস্তানে এ মাছের বিস্তৃতি রয়েছে। পিয়ালি মাছ দৈর্ঘ্যে ৫ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। এদের দেহ লম্বা ও পার্শ্বীয়ভাবে চাপা। পরিপক্ব পুরুষ মাছের পেট হলুদাভ থাকে এবং এরা স্ত্রী মাছের চেয়ে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। স্ত্রী মাছের পেট ধবধবে সাদা ও হালকা স্ফীতাকার। প্রতি বছর এ মাছের শরীরের আইশ ঝরে যায় এবং নতুন আইশ তৈরি হয়। সুস্বাদু এ মাছটি বর্তমানে বাংলাদেশের সংকটাপন্ন মাছের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। মৎস গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানান, যমুনা ও পদ্মা বিধৌত এলাকায় বসবাসরত মানুষের কাছে পিয়ালি মাছ অতি পরিচিত। এ মাছের স্বাদ মানুষের মুখে মুখে। একসময় যমুনা ও পদ্মায় পিয়ালি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। কিন্তু পরিবেশগত বিপর্যয় ও অতি আহরণের ফলে এ মাছও বর্তমানে সংকটাপন্ন মাছের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিয়ালি মাছকে প্রকৃতিতে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বগুড়া জেলার সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণা পরিচালনা করে দেশে প্রথমবারের মতো এর প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি এখন চাষের উপযোগী করে নিয়ে আসা হচ্ছে। জানা যায়, গবেষক দলে ছিলেন উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ডেভিড রিন্টু দাস, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ও মালিহা খানম।

জানা যায়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতাধীন সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র থেকে যমুনা, বাঙালি, আত্রাই নদীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পিয়ালি মাছের পোনা সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে তা নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করা হয়। এ সময় পিয়ালি মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। প্রাকৃতিক জলাশয়ে এরা মূলত প্লাঙ্কটনভোজী। গবেষণাকালে একটি ৬ গ্রাম ওজনের পিয়ালি মাছ বিশ্লেষণ করে এর পেটে ৮০ দশমিক ৭১ শতাংশ ফাইটোপ্লাঙ্কটন এবং ১৯ দশমিক ২৯ শতাংশ জুপ্লাঙ্কটন পাওয়া যায়। এ ছাড়া বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে পিয়ালি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। এ প্রজাতির মাছ সাধারণত বর্ষাকালে অগভীর জলাশয়ে প্রজননে অংশগ্রহণ করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মে থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে নদীতে প্রজননক্ষম পরিপক্ব স্ত্রী মাছ পাওয়া যায়। জুন থেকে সেপ্টেম্বরে জলাশয়ে পিয়ালির পোনার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এতে প্রমাণিত হয়, পিয়ালি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-আগস্ট ও ডিসেম্বর-জানুয়ারি। পিয়ালির ডিম-ধারণক্ষমতা আকারভেদে ১৫০০ থেকে ৩৫০০টি। একটি পরিপক্ব স্ত্রী পিয়ালি মাছ ৩.৫ থেকে ৬ গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন-উপযোগী হয়। প্রজনন-উপযোগী পুরুষ পিয়ালি মাছ আকারে অপেক্ষাকৃত বড় (৪ থেকে ৬ গ্রাম) হয়। ইনস্টিটিউটের চলমান এ গবেষণায় পাঁচ জোড়া পিয়ালি মাছকে চলতি জুনে ১:১.৫ অনুপাতে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। হরমোন প্রয়োগের ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পর ডিম ছাড়ে এবং ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা পর নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। ডিম নিষিক্ততার পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৬ ভাগ। উৎপাদিত রেণু বর্তমানে ইনস্টিটিউটের প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে।

গবেষক দলের প্রধান ড. ডেভিড রিন্টু দাস বলেন, ‘পিয়ালি মাছ দ্রুতবর্ধনশীল এবং খেতে খুবই সুস্বাদু। এ মাছ আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম ও লোহাসমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম পিয়ালি মাছে মেথিয়োনিন ৭৫০ মিলিগ্রাম, সিস্টিন ৪২০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৪৩০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬৭০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ১৫০ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ১২.৮ মিলিগ্রাম, আয়রন ২৫ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ৮.২১ মিলিগ্রাম এবং ১.৪০ শতাংশ কপার রয়েছে, যা অন্য অনেক দেশি ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণে এ মাছ অত্যন্ত কার্যকর।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ