• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা কোবাদের শিকলবন্দী জীবন

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০২২  

১৯৭১ সালের রণাঙ্গণে অস্ত্র হাতে বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নিলেও আজ শিকলবন্দী জীবনযাপন করতে হচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা কোবাদকে (৭২)।  

বাধ্য হয়ে একমাত্র সন্তানকে স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি ইজি বাইক চালিয়ে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।

পারিবারিক অস্বচ্ছলতা ও অজ্ঞতার কারণে বিনা খরচে চিকিৎসার সুযোগ থাকলেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করাতে পারছেন না পরিবার। নিরুপায় হয়ে দীর্ঘ ৬ মাস এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শিকল পরিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে।  

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা কোবাদের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার জালালাবাদ ইউনিয়নের খালিয়া গ্রামে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা নম্বর ০১৩৫০০০৪৭৫৩। বাবার নাম তোফাজ্জেল হোসেন মোল্লা। ৭১ এর রণাঙ্গণে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান ও নিজ জেলায় একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি। সৎ, সদালাপী ও স্পষ্টবাদী হওয়ায় এলাকায় তাঁর ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এক সময় তিনি জালালাবাদ ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে অসুস্থ থাকায় এখন বাকশক্তিও হারিয়েছেন। ব্রেন স্ট্রোকের রোগী হওয়ায় অনেক কিছু বুঝতে পারেন না। মাঝেমধ্যে যেখানে সেখানে চলে যান, তাই পরিবারের সদস্যরা তাকে বেঁধে রেখেছেন।  

তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক এই মুক্তিযোদ্ধা। তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে আদনান মোল্লা এলাকার খালিয়া ইউনাইটেড একামেডির দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সম্প্রতি ওই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হেলেনা বেগম স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতার বিপরীতে ১০ লাখ টাকা ব্যাংক লোন করে ছেলেকে ইজিবাইক কিনে দিয়েছেন। কিছু টাকা খরচ করে স্বামীর চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে স্বামীর সঠিক চিকিৎসা করাতে পারছে না তারা।

মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হেলেনা বেগম জানান, ৬ বছর আগে তার স্বামী ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তখন তাকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। গত ৬ মাস হলো তার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। তাই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে। বেঁধে না রাখলে এখানে সেখানে চলে যায়, পরে খোঁজাখুজি করে আনতে হয়।  

তিনি আরও জানান, তার স্বামী মাসে ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। এই ভাতার বিপরীতে প্রথমে ২ লাখ টাকা লোন করেছেন। ওই টাকা স্বামীর চিকিৎসা ও সংসার চালাতে খরচ করেছেন। সম্প্রতি আবার ১০ লাখ টাকা লোন করে লোনের ২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন আর ছেলেকে একটি ইজিবাইক কিনে দিয়েছেন। বাকি টাকা স্বামীর চিকিৎসার জন্য খরচ করছেন। লোন থাকায় ভাতার টাকা থেকে প্রতি মাসে ১৪ হাজার টাকা কেটে নেয়। হাতে ৬ হাজার টাকা পান। ওই ৬ হাজার আর ছেলের আয় দিয়ে কোনো রকম সংসার চলছে।  

বাড়ির জায়গা ছাড়া মাঠে কোনো জমি নেই তার। বাড়িতে ছোট একখানা টিনের ঘর ছিল। সরকার সেই ঘর ভেঙে বিল্ডিং করে দিচ্ছে।  

এ জন্য সরকারের প্রতি তিনি মহাখুশি জানিয়ে বলেন, এখন অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে বিপদে আছি। সরকার আমার স্বামীর চিকিৎসার উদ্যোগ নিলে আরও উপকৃত হতাম।
 
ছেলে আদনান মোল্লা বলে, আমার মা লোন করে ইজিবাইক কিনে দিয়েছেন। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি সেই ইজিবাইক চালিয়ে সংসার ও অসুস্থ বাবার চিকিৎসায় খরচ করি। তাই সরকারের কাছে আমার আবেদন আমার বাবাকে চিকিৎসা করিয়ে যেন সুস্থ করে দেয়।

আদনানের সহপাঠি মাহমুদ হাসান বলে, আমি আর আদনান একই স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র। আদনান পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ইজিবাইক চালায়। আমার খুব খারাপ লাগে। ওর বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাই আমরা আশা করবো ওর বাবার চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার নেবে।  

কলেজছাত্র রাজু মল্লিক বলেন, আমি বিষয়টি শোনার পর আদনানদের বাড়িতে গিয়ে দেখি ওর বাবাকে শিকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। বিষয়টি আমার খুব খারাপ লেগেছে। তাই সরকার ও বিত্তবানদের ওর বাবার চিকিৎসায় এগিয়ে আসার আহবান জানাই।

ওই এলাকার মধুমতি বাজারের ব্যবসায়ী মো. মনিরুজ্জামান মানি বলেন, মোল্লা কোবাদ খুব ভালো মানুষ। সব সময় আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ছিলেন তিনি। কিন্তু কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেননি। এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তাকে সরকার থেকে একটি বিল্ডিং করে দিচ্ছে এতে এলাকাবাসী অনেক খুশি। তার চিকিৎসায়ও সরকার এগিয়ে আসবে এটা আমরা আশাকরি।  

মো. মোজাফ্ফর মোল্লা বলেন, উনার সংসারে এখন স্ত্রী ও ছোট একটি ছেলে রয়েছে। উনার স্ত্রী অজ্ঞতার কারণে স্বামীর চিকিৎসা করাতে পারছেন না। ৩ মাস আগে খুলনায় গিয়ে প্রাইভেটভাবে ডাক্তার দেখিয়েছেন। কোনো কাজ হচ্ছে না। সঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে পারলে উনি ভালো হয়ে যাবেন। কোনো প্রতিষ্ঠান বা হৃদয়বান মানুষ তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।
 
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোহসিন উদ্দিন বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। সব সময় আমরা তাদের পাশে আছি। আগামীতেও থাকবো।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ