• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

গোপালগঞ্জে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে অনাস্থা

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১২ মে ২০২৩  

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার মহারাজপুর ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও টিউবয়েল দিয়ে টাকা নেয়ার অভিযোগে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে পরিষদের ৯ মেম্বার। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ভিত্তিহীন দাবি করেছেন অভিযুক্ত চেয়ারম্যান। আর প্রশাসন বলছে বরাদ্ধ সংকটের কারণে এবং পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি। তদন্ত করে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।

মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২ জন নারী ও ৭ পুরুষ সদস্য স্বাক্ষরিত অনাস্থা পত্র সূত্রে জানা গেছে, বিগত ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর মুকসুদপুরের মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মোঃ সালাহউদ্দিন মিয়া। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পরিষদের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সকল সদস্যকে নিয়ে পরিষদ পরিচালনা করেন তিনি। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে পুরুষ ও নারী সদস্যদের সাথে চেয়ারম্যানের অসদাচারণ শুরু হয়। পছন্দের দুই একজনকে সাথে নিয়ে তিনি গোপনে পরিষদের উন্নয়ন কর্মকান্ড করতে শুরু করেন। এই ঘটনায় অন্যরা বাধ সাধলে চেয়ারম্যানের সাথে মেম্বারদের মতবিরোধ দেখা দেয়। এরপর চেয়ারম্যান তার পছন্দের ২/৩ জন সদস্যকে সাথে নিয়ে সরকারের দেয়া বিভিন্ন প্রকল্প ও অনুদান ইচ্ছা মাফিক জেনতেনভাবে বাস্তবায়ন করে আসছে। এছাড়া ইউনিয়নের একটি সড়কের প্রায় ৪ কিলোমিটার এলাকার ইট তুলে বিক্রি করে দেন। বিভিন্ন সড়কের প্রায় ৩৫টি গাছ কেটে বিক্রি, টিউবওয়েল বরাদ্দ দিয়ে টাকা নেয়া, বিধবা ও বয়স্কভাতা প্রদানে টাকা আদায় করেছে বলে পরিষদের মেম্বাররা অভিযোগে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক ও মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে অভিযোগ করেছেন।

এছাড়া এলাকার বিভিন্ন বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দেয়ার জন্য অনলাইন বাবদ সরকার নির্ধারিত ৫০ টাকার স্থলে ৩/৫শ টাকা আদায় করছে ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা ও চেয়ারম্যানের কাছের লোক রাকিব হোসেন মিয়া। টাকা দিতে গড়িমশি করলে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও গালমন্দ করারও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

মহারাজপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও লোহাচুড়া গ্রামের রবিউল মুন্সীর স্ত্রী নাসিমা বেগম। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের লোক উদ্যোক্তা মোঃ রাকিব শেখ ভিজিডি কার্ড করার জন্য অনলাইন বাবদ আমার কাছ থেকে পাঁচশত টাকা নিয়েছে। পরে জানতে পারলাম এটা করতে ৫০ টাকা লাগে। এছাড়া সাদা কাগজে দুইটা স্বাক্ষর নিয়েছে।

একই ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের সত্তার মুন্সীর মেয়ে আছিয়া বেগম। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা রাকিব আমাকে রুমে আটকে বলে, কার মাধ্যমে কার্ড করেছো কতটাকা দিয়েছো। আমি বলি কোন টাকা দেইনি তখন আমাকে কিলঘুষি মারে এবং জোর করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয় ও সাদা কাগজে দুইটা স্বাক্ষর নিয়ে ভিজিএফের চাল দেয়। রাকিব আমার গায়ে হাত তুলেছে এই ঘটনার আমি বিচার চাই।

৩নং ওয়ার্ড মেম্বার ইমান আলী (ফেলন) বলেন, বনগ্রাম থেকে রামচন্দ্রপুর সড়কের ৯টি, মাটিয়া ব্রীজ থেকে বনগ্রাম পর্যন্ত ২০টি, বনগ্রাম থেকে মিলিকশ্রীরামপুর পর্যন্ত ১৫টি গাছ কেটে চেয়ারম্যান বিক্রি করে দিয়েছেন। এর সঠিক তদন্ত দাবি করছি।

নারায়নপুর গ্রামের শতবর্ষি আবুল কাশেম ফকির বলেন, আমার বাড়ির পাশে বট গাছটি যখন লোকজন কাটতে আসে তখন আমি জিজ্ঞাসা করি তোমরা গাছ কাটছো কেন। তখন তারা আমাকে বলে এটা চেয়ারম্যান কাটতে বলেছে। পরে মেম্বার এসে ঠেকায়। তার মধ্যে গাছের সমস্ত ডাল কেটে নিয়ে গেছে।

একই গ্রামের সুজন মুন্সী বলেন, মহারাজপুর ইউনয়নের বিভিন্ন সড়কে অনেক গাছ কাটা হয়েছে। এসব গাছ আমাদের ছায়া দিত। আমরা সড়কে চলার সময় এসব গাছের নিচে বিশ্রাম নিতাম। গাছ কাটার সময় এলাকার মানুষ মুকসুদপুরের ওসি, এসিল্যান্ড ও ইউএনওকে জানায় কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

ওই গ্রামের আব্দুল গফুর জানিয়েছেন, চেয়ারম্যানের কাছে কোন কাজে গেলে আমাদের বিশ্রি ভাষায় গালাগালি করে তাড়িয়ে দেয়। এসবের একটা সমাধান হওয়া উচিৎ।

মহারাজপুর ইউনিয়নের সংরক্ষিত ১নং ওয়ার্ডের নারী সদস্য রেহানা আক্তার লাকী বলেন, আমরা যখন পরিষদে ঢুকি তখন চেয়ারম্যানের আচার আচরণ খুব খারাপ হয়ে ওঠে। কথায় কথায় নিজের পায়ের জুতা উঠিয়ে মেম্বারদের পিটাতে যায়। নারী সদস্যদের ডাকে এই মহিলারা। আমাদের কোন সম্মান দেয়া হয় না। অসম্মানজনক আচরণ সব সময়ই করে আসছেন। পরিষদ গঠনের পর একটা মাত্র মিটিং হয়েছে। এর পর কোন মিটিং হয়নি। তাই এভাবে কোন পরিষদ চলতে পারে না। জনগণের কাছে তো আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। তাই প্রতিকারের জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছি।

১নং ওয়ার্ডের পুরুষ সদস্য মোঃ কবির মোল্লা বলেন, মেম্বাররা যে একজন জনপ্রতিনিধি সেরকম কোন ইজ্জত আমরা চেয়ারম্যানের কাজ থেকে পাইনি। তার পছন্দের জনগনকে চেয়ারম্যানের পায়ের চেন্ডেল খুলে দিয়ে বলে এটা দিয়ে মেম্বারদের পিটিয়ে আয়। যদি পিটাতে পারিস তাহলে টিসিবি মাল দিব ফ্রি। এই হেন আচরণের জন্য আমরা ৯ জন মেম্বার প্রশাসনের দারস্থ হয়েছি। আশা করি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এর সমাধান করবেন।

চেয়ারম্যান মোঃ সালাহউদ্দিন মিয়া তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ইউনিয়নে যে বরাদ্দ আসে তার তুলনায় জনগণ অনেক বেশী তাই সব অনুদান মেম্বার ও মানুষের চাহিদা মাফিক দিতে পারি না। এর জন্য জনগণ আমাদের আরো উল্টোপাল্টা কথা শুনায়। মেম্বাররা তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণের যে যে অভিযোগ তুলেছে সেটা ঠিক না। আর গাছকাটার যে অভিযোগ এসেছে সেটাও ঠিক না। লোহাচুড়া বাজারে একটি গাছকাটা হয়েছে। সেটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। আমাকে অবহিত করে গাছটি কাটা হয়েছে এটা সত্য। টিউবওয়েল দেয়া বা অনলাইন বাবদ টাকা নেয়ার যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার কোন ভিত্তি নেই। বরং পুরুষ ও নারী মেম্বাররা এইসব অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত। আমি এসব অন্যায় কাজে রাজি হই না বিধায় আজ তারা আমার বিরুদ্ধে এই অনাস্থা দিয়েছে।

এ ব্যাপারে মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম ইমাম রাজী টুলু বলেন, প্রাথমিকভাবে যেটা জানতে পেরেছি সেটা হলো, পাওয়া না পাওয়ার বিষয় নিয়ে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ হয়েছে তার তদন্ত কাজ চলছে। আশাকরি দ্রুততম সময়ে সমস্যা সমাধান হবে এবং ইউনিয়নের সকল কার্যক্রম স্বাভাবিক হবে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ