• শুক্রবার ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ||

  • অগ্রহায়ণ ২৩ ১৪৩০

  • || ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

ঢাবি শিক্ষার্থী ফিরোজের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না বাবা-মা

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

বেশ কয়েকদিন যাবৎ ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থী ফিরোজ কাজী (২২)। গোপালগঞ্জ সদরের নিজ গ্রামের বাড়িতে চিকিৎসা শেষে গত শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বাড়ি থেকে ঢাকায় যান ফিরোজ। কিছুদিন ধরে প্রেমঘটিত একটি বিষয়ে হতাশায় ভুগছিলেন ফিরোজ। ঢাকায় যাওয়ার আগে মাকে কথা দিয়েছিলেন আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটাবেন না কখনো। কিন্তু মাকে দেওয়া সেই কথা রাখতে পারলেন না তিনি।

নিহত ফিরোজ কাজী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচারাল বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়াউর রহমান হলের ২০৩ নম্বর কক্ষে থাকতেন। মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় ৭১ হলের ছয় তলা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন ফিরোজ।

ফিরোজ কাজীর মৃত্যুতে তার গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। ছেলের এমন মৃত্যুতে শোকে কাতর ফিরোজের মা নিপা বেগম। ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক দিনমজুর বাবা চুন্নু কাজী। বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে গ্রামের বাড়িতে ফিরোজের মরদেহ পৌঁছানোর পর শুরু হয় এক হৃদয় বিদারক গল্পের। কান্নায় ভেঙে পড়েন ফিরোজের স্বজনসহ এলাকাবাসী। বাদ আসর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে ফিরোজের মরদেহ দাফন করা হয়।

ফিরোজের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুখুরিয়া গিয়ে দেখা যায়, ছেলে ফিরোজের মরদেহ সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে নির্বাক দিনমজুর চুন্নু কাজি। ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর ফিরোজের মা নিপা বেগম।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরোজের বাবার কাছে ফোন আসে। বলা হয় ফিরোজ আত্মহত্যা করেছে। এরপর ঢাকায় ছুটে যান পরিবারের সদস্যরা। তারা গিয়ে জানতে পারেন মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা ৪০ মিনিটে ফিরোজের কক্ষে গিয়ে টেবিলে রাখা একটি প্যাডে কিছু লেখা দেখতে পান তার বন্ধুরা। এ সময় তার টেবিলে মুরগির মাংস ও ভাত রাখা ছিল। বন্ধুরা তার জন্য খাবার রুমে এনে রেখেছিলেন। ফিরোজ তা না খেয়েই হঠাৎ রুম থেকে বেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পরই বিজয় ৭১ হলের ভবন থেকে পড়ে যাওয়ার খবর পান তার বন্ধুরা। তবে তিনি বিজয় ৭১ হলে কার কাছে গিয়েছিলেন তা জানেন না বন্ধুরা। এরপর ফিরোজের পরিবারের সদস্যদের কাছে ফোন করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত ফিরোজ কাজী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। নিজ গ্রামের একটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৪.৯১ ও গোপালগঞ্জ শহরের একটি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.৩৩ পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ফিরোজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এলাকায় দিনমজুরি করে ফিরোজসহ তিন সন্তানের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাবা চুন্নু কাজী। তিন ভাইয়ের মধ্যে ফিরোজ দ্বিতীয়।

এদিকে ফিরোজের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না সহপাঠীসহ এলাকাবাসী। দাফনে অংশ নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ ৬৩ সদস্যের একটি দল আসে ফিরোজের বাড়িতে। শিক্ষার্থী ও সহপাঠীকে হারিয়ে নির্বাক তারাও। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তারা।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল ফিরোজের। কিছুদিন আগে সেই মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ফিরোজের মা। কিন্তু ফিরোজের বাবা দিনমজুর হওয়ায় ফিরোজের মায়ের সঙ্গে আর দেখা করেনি সেই মেয়ে। পড়ে মাকে নিয়ে নিজ গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে ফিরে আসেন ফিরোজ। সেখানে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। বাড়িতে চিকিৎসা শেষে গত শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় যায় ফিরোজ। এ বিষয়ে হতাশায় ভুগছিলেন ফিরোজ। ঢাকায় যাওয়ার আগে মাকে কথা দিয়েছিলেন এমন ঘটনা ঘটাবেন না। কিন্তু সেই কথা আর রাখলেন না ফিরোজ।

নিহত ফিরোজের মা নিপা বেগম বলেন, ‘আমার ছাওলডা কাল রাত ৯টার সময় ফোন দিয়েছিল। আমাকে ফোন দিয়ে বলে, মা আমি ভালো আছি। তুমি আমারে নিয়া চিন্তা কইরো না। আমি এখানে খুব ভালো আছি। এইডাই  আমার বাবার সাথে আমার শেষ কথা হইছে। আমার বাবা আমারে আর কিছু বইলে যাই নাই।’

নিহত ফিরোজের বড় ভাই ফেরদৌস কাজি বলেন, রাত ২টার  সময় আমাকে ফিরোজের বন্ধুরা ফোন দিয়ে বলে ফিরোজ আত্মহত্যা করেছে। আমরা বাসা থেকে রওনা হয়ে রাত ৪টার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে আমার ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই।

স্থানীয় বাসিন্দা রাফিন মোল্লা  বলেন, ফিরোজের বাবা চুন্নু কাজী এলাকায় কৃষি কাজ করেন। অনেক কষ্ট করে ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ যোগান।  তিন ছেলের মধ্যে ফিরোজ কাজী ছিলেন দ্বিতীয়। মা-বাবার স্বপ্ন ছিলো ছেলে লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করবে। সেদিন হয়তো তাদের কষ্ট ঘুচবে। লেখাপড়া শেষ করার আগে লাশ হয়ে ফিরলো। বাড়িতে এখন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

ফিরোজ কাজীর বাবা চুন্নু কাজী বলেন, ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। প্রায়ই  বাড়িতে কথা বলতো। আমাদের খোঁজ নিতো। আমার বুকের ধন চলে গেল। আর কারও সন্তানের যেন এমন মৃত্যু না হয়।

তিনি বলেন, গতকাল রাত ৯টার সময় ফিরোজের সাথে কথা হয়েছিল আমাদের। তখন আমার ছেলে আমাদের সাথে ভালোভাবে কথা বলছিল। আমাদেরকে সে বলেছিল তাকে নিয়ে যেন আমরা চিন্তা না করি। কিন্তু রাত আর পার হলো না। রাত শেষ হওয়ার আগেই চিন্তা শেষ করে দিছে।

প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় ৭১ হল থেকে লাফিয়ে পড়েন ফিরোজ কাজী (২২)।  তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত ঘোষণা করেন।

জিয়াউর রহমান হলের ২০৩ নম্বর কক্ষে ফিরোজের টেবিলে রাখা প্যাডে কিছু লেখা পাওয়া যায়। সেখানে লেখা ছিলো, ‘মানুষ বাঁচে তার সম্মানে। আজ মানুষের সামনে আমার যেহেতু সম্মান নাই। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোনো অধিকার নাই। আমারে মৃত্যুর দায়ভার একান্ত আমার। সরি মা! বাড়ি থেকে তোমাকে দিয়ে আসা কথা রাখতে পারলাম না। আমার জীবন নিয়ে হতাশ।’ এই পৃষ্ঠার উপরে ১৯/০৯/২৩ তারিখ এবং নিচে ফিরোজের নাম ও রাত ১১টা ৩ মিনিট সময় উল্লেখ করা ছিলো। তবে এটি ফিরোজের হাতের লেখা কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পৃষ্ঠার বাকি অর্ধেকে রাত ১১টা ৫ মিনিট সময় উল্লেখ করে লেখা ছিল, ‘আমার ওয়ালেটের কার্ডে কিছু টাকা আছে। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রইলো মায়ের হাতে দিতে। আমার লাশের পোস্টমর্টেম না করে যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোনো আইনি ঝামেলায় কাউকে যেন জড়ানো না হয়। সবাই বাঁচুক, শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না।’ এই লেখার নিচে আবারও লেখা ‘ফিরোজ।’

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ