• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

নুসরাত হত্যা ॥ বার্তাবহ একটি রায়

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০১৯  

দেশব্যাপী আলোচিত ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন মামলার প্রধান আসামি ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাসহ সব আসামি আদালত প্রাঙ্গণে বেশ হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। মামলার ১৬ আসামিকে প্রিজনভ্যানে করে ২৪ অক্টোবর সকালে যখন আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয় তখন সকল আসামিই ছিলেন খোশ মেজাজে। হাসতে হাসতে তারা আদালতের ভেতরে যান। তাদের ভাবসাব ছিল এমন, যেন রায়ে তাদের কিছুই হবে না। এত বড় একটি পাপাচার করার পরও তাদের মনে কোন অনুশোচনাই যেন ছিল না। অন্তত তাদের মুখাবয়ব দেখে তাই মনে হচ্ছিল। তবে আদালতের রায়ে সকলের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা হলে তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ হয়ে যায় বাংলার পাঁচ। আদালতের কাঠগড়াতেই কাঁদতে শুরু করেন অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলাসহ সব আসামি। আলোচিত এ মামলার আসামি নুসরাতের খুনীরা হাসতে হাসতে আদালতে প্রবেশ করলেও কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসেন। সকল আসামির জন্য মৃত্যুদন্ড ঘোষণার রায় ছিল প্রত্যাশিত।

নুসরাত নামের মাদ্রাসাছাত্রীর পরিবারের আশা ছিল সে এক সময় সমাজের উন্নত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। নুসরাতও তার পরিবারের প্রত্যাশা পূরণে এগোচ্ছিল সঠিক পথে। কিন্তু নুসরাত ও তার পরিবারের প্রত্যাশার এ যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মানুষরূপী হায়েনা সিরাজউদদৌলা। গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলা নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় তাঁর মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করলে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপরই সিরাজউদদৌলার লোকজন মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে। এতে রাজি না হলে ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসা চলাকালে অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের করুণ মৃত্যু হয়। আলোচিত এ মামলায় অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার রায় দিয়েছে আদালত। রায়ে নুসরাতের পরিবারের পক্ষে তাকে হারানোর যন্ত্রণা কতটা উপশম হবে তা কারও জানা নেই। এমনকি এটিও কারও জানা নেই যে, নুসরাত নামের প্রাণবন্ত মেয়েটি জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর জীবনের শেষ দিনগুলো হাসপাতালের শয্যায় কতটুকু শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেছে। আলোচ্য এ রায়ে একটি ফুল না ফুটতেই তাকে সরিয়ে দেয়ার যন্ত্রণা হয়তো তার পরিবারের জন্য কিছুটা হলেও উপশম হতে পারে।

আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার ঐতিহাসিক এ রায়ের পর একটি কথা প্রমাণ হলো, আমাদের দেশে বিচারহীনতার যে পরিবেশ গড়ে উঠেছিল তা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে যাচ্ছি। এ মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন প্রয়োগ করতে যতটুকু সক্রিয় ছিল তা একটি দৃষ্টান্ত। আপাতত নুসরাতের পরিবার মেয়ে হত্যার সুবিচার পেয়েছে এ কথা ভেবে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকবে। রায় কার্যকর হওয়ার পর তারা হয়তো পুরোপুরি নির্ভার হবেন।

নুসরাত হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায়ের ফলে অনেক বার্তা দেশবাসীর সামনে দেয়া হয়েছে। ঘটনা ঘটার মাত্র ৩৩ দিনেই সম্পন্ন হয় মামলাটির তদন্ত কাজ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মামলাটির তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের পর মামলাটির সমুদয় সাক্ষী, জেরা সম্পন্ন করে আদালত মাত্র ৬১ দিনে মামলার রায় ঘোষণা করল। অর্থাৎ ঘটনা ঘটার মাত্র ৩ মাস পরই রায় ঘোষণা করল। আলোচিত এ ঘটনা ঘটার মাত্র ৯৪ দিনের মধ্যে নুসরাতের পরিবার বিচার পেয়েছে। শুধু নুসরাতের পরিবারই বলব কেন, বলা যায় পুরো দেশবাসী এ মামলায় যে রায় প্রত্যাশা করেছিল সাক্ষী-প্রমাণসাপেক্ষে সে রায়ই দিয়েছে আদালত। এক কথায় এ রায়ের মধ্য দিয়ে দেশের আপামর মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে।

অতীতের কিছু মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রত্যাশিত রায় প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন বাদীপক্ষ। অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার রায় এখনও ঝুলে আছে। এমনও দেখা গেছে, অনেক আলোচিত বা চাঞ্চল্যকর মামলা থেকে সাক্ষী ও প্রমাণের অভাবে আসামিরা খালাস পেয়ে গেছে।

আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যাকান্ড ছিল একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। মামলাটিকে রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাত হত্যাকান্ডের পর যেখানে যে নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন তা দিয়েছেন। ফলে মামলাটির তদন্ত, আসামি গ্রেফতার, অভিযোগপত্র গঠন সকল ক্ষেত্রেই পুলিশ ও প্রশাসন অত্যন্ত দক্ষতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। এজন্য মামলার শুরু থেকে রায় পর্যন্ত যারা কাজ করেছেন তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

এ রায়ের মাধ্যমে কয়েকটি সতর্ক বার্তার ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছে। দেশবাসীর কাছে এ রায়ের মাধ্যমে প্রথমেই যেটি প্রতীয়মান তা হলো, অপরাধী যতই প্রভাবশালী বা শক্তিশালী হোক না কেন এ ধরনের জঘন্যতম অপরাধ করে কেউই পার পাবে না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে। এ মামলায় বর্তমান সরকারদলীয় লোকজনও শাস্তির আওতায় আসায় প্রমাণ হয় রাজনৈতিক পরিচয় অপরাধীর ক্ষেত্রে মুখ্য নয়, একেবারেই গৌণ।

আমরা সাধারণত মনে করে থাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান। সেই নিরাপদ স্থানে নুসরাতের মতো একটি প্রাণবন্ত মেয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার মধ্য দিয়ে আমাদের ধারণার স্থানটিকে পুরোপুরি নড়বড়ে করে দিয়েছিল ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। এ রায়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আরও সতর্ক হবে। দেশের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমে আসবে। তবে সরকারের উচিত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা। এতে দেশের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের সুযোগ থাকবে কম।

নুসরাত হত্যাকা-ের ঘটনায় সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ দুটি মাধ্যম প্রতিনিয়তই নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকা-ের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিয়ে সরব ভূমিকায় ছিল। সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সঠিক পথে চালিত হলে অপরাধী চিহ্নিত ও শাস্তি নিশ্চিত করা সহজসাধ্য হয়। রায়ের পর্যালোচনায় আদালত সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রশংসা করেছে।

নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে দেশবাসী খুশি। ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রায় ঘোষণার পর মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আনন্দ মিছিলও হয়েছে। এতেই বোঝা যায় মানুষের আস্থার জায়গাটি সমৃদ্ধ হয়েছে এ রায়ে। এবার নিম্ন আদালতে ঘোষিত নুসরাত হত্যাকান্ডের রায় দ্রুত কার্যকর হবে- এটাই জনপ্রত্যাশা। এ রায় বাস্তবায়নে ধীরগতি যেন না আসে সেটাই চায় দেশবাসী। তবে এটাও সত্য, যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে তাদেরও নাগরিক অধিকার রয়েছে আপীলের। উচ্চ আদালতেও যেতে পারেন তারা। এ মামলার তদন্ত থেকে রায় পর্যন্ত প্রক্রিয়াগুলো যত দ্রুতগতিতে হয়েছে পরবর্তী স্তরগুলো সেভাবেই দ্রুতগতিতে হবে সেটাই এখন দেশবাসীর প্রত্যাশা।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ