• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

সাফল্য, সুখ, নাকি দুটোই!

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০১৯  

কবিতা দিয়েই না হয় শুরু হোক। ‘সুখ সুখ করি কেঁদো না আর, যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে, ততই বাড়িবে হৃদয়ভার’। সত্যিই তাই। সুখপাখি ধরে আনতে গিয়ে আমরা অনেকেই সারা দিনমান অকারণ ব্যস্ত থাকি, অথচ আমরা জানি না সুখ আসলে কেমন! ‘সুখবিশারদ’ যারা তারা বলেন এটা হল একরকম মানসিক অবস্থা বা স্টেট অফ মাইন্ড, যা কিনা আমাদের একটি ভালো অনুভূতি দেয়। এই ভালোর আবার রকমফের অছে। কে যে কীসে সুখী, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এটা অনেকটাই নির্ভর করে একটি মানুষের চাওয়া-পাওয়া, যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থান, উচ্চাভিলাষ ইত্যাদির উপর।

একটু ভেবে দেখুন না, যে মানুষ দিনে তিনবেলা পেটপুরে খেতে পায় না, রাতে যার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই বা ফুটপাতে ঘুমায়, তাকে যদি আপনি ভরপেট বিরিয়ানি বা তার পছন্দের খাবার খেতে দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার জন্য ঘর, একান্তই নিজের- তখন তার মতো সুখী আর কে হবে বলুন তো! অন্যদিকে এমন অনেকেই আছেন, যারা এই ঢাকা শহরেই ডজনখানেক বাড়ি, অথচ ঘুমাবার লোক নেই, সে নিজেও ঘুমের বড়ি না খেয়ে ঘুমোতে পারেন না, এমন লোকের সুখী হবার আদৌ কোনো কারণ আছে কি!

 ‘সুখ নিয়ে মিছে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। জীবন মানেই, না না, জি বাংলা নয়, এটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র। আসুন, আমার শুধু নিজের জন্যে নয়, অপরের জন্যও কাজ করি। তাতেই প্রকৃত সুখের সন্ধান পাবো। শরীর ও হৃদয় দুটোই ভালো থাকবে। আর একজন সুস্থ সবল মননশীল মানুষের অসুখী হবার তো কোনো কারণ নেই।’

বস্তুত, যার লোভ-লালসা বা চাহিদার অন্ত নেই, যত ইচ্ছে দামি দামি খাবার খায়, পোশাক পরে, দামি গাড়ি হাঁকায়, যা খুশি তাই কিনতে পারে, এমন লোকের পক্ষে সুখের অনুসন্ধান করা একটু কঠিন বৈকি। কারণ তার চাহিদার ব্যাপ্তি বেশি, ফিরিস্তি অনেক বড়। খুব সহজে তার মন ভরে না। তার আরো চাই, অনেক বেশি বেশি চাই। একটি সামজিক সমীক্ষায় দেখা যায়, সুখ যদিও অর্থের মানদণ্ডে বিচার্য নয়, তারপরও ধনীদের তুলনায় মধ্যবিত্ত, এমন কি গরবিরা বেশি সুখানুভূতি পেয়ে থাকে। এখানেও কথা রয়েছে। সুখ কি চলক, নাকি ধ্রুবক। অর্থাৎ একবার যিনি মনে করেন যে তিনি সুখের দেখা পেলেন, তার সেই সুখ কি চিরস্থায়ী হবে! নাকি সময়ের পরিক্রমায় একই রকম সামজিক অবস্থান ও আর্থিক সুবিধাদি ভোগ করার পরেও তার সুখানুভূতি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এই যেমন, অর্থনীতির ভাষায় ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগবিধি।

তার আগে আসুন, বাস্তবিক পক্ষে সুখের আকার ও প্রকারটা একটু জেনে আসি। পশ্চিমা দার্শনিক উড্রো রবিনসন বলেন, সুখ বস্তুত একটি অনুভূতি মাত্র, যা কিনা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের জীবনে ইতিবাচক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সূচিত হয়। ধরুন আজ সকালবেলা আপনি একটি আশাতীত ভালো খবর পেলেন, আপনার মন অপার ভালোলাগার দোলনায় দুলে উঠলো, একে আপনি কী বলবেন? সুখ! রবিনসনের মতে একে সুখ বলে না, একে আপনি জয় বা আনন্দ বলতে পারেন, কিংবা উচ্ছ্বাস। তাঁর মতে এটা সাময়িক ও একক ঘটনা। সহজ করে বুঝতে গেলে বিষয়টিকে আমরা আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। ভূগোলে পড়েছি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের দৈনন্দিন অবস্থা যেমন ঝড়বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, আর্দ্রতা কিংবা উত্তাপের যে ফিরিস্তি- তাকে বলে আবহাওয়া। আর যখন দীর্ঘমেয়াদে এই আবহাওয়াকে বিবেচনা করা হয় তখন তাকে বলে জলবায়ু। যেমন বলে থাকি আমাদের দেশের জলবায়ু সমভাবাপন্ন। মোদ্দা কথা হল এই, সুখ বলতে একটি দীর্ঘকালীন ভালো অনুভূতি পরিতৃপ্তিবোধ ও ইতিবাচক মনোভাবকে বুঝায়।

সুখ যেহেতু প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি, তাই সুখ পরিমাপের নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠিও নেই। একেকজন মানুষ একেক জিনিসে একরকমভাবে সুখ পায়। একজন পাঁড় মাতাল যেমন মদ গিলে সুখ পায়, তেমনি আবার কেউ হয়তো গরম দুধ খেয়ে ভালো বোধ করে। কারো অনেক অনেক টাকা চাই, আবার কেউ চায় সামাজিক অবস্থান ও আদর্শনিষ্ঠ জীবনযাপন করতে। কেউ হয়তো অন্যের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে বা প্রভুত্ত বা জাহির করেও নিজেকে সুখী মনে করে। আবার যারা স্যাডিস্ট টাইপ, তারা অধস্তন বা সমশ্রেণীর মানুষকে পীড়ন করেও একরকম সুখ পায় বলে মনে করে। তাই বলি কি, সুখ বড় গোলমেলে ব্যাপার। মিছে ওই বস্তু না খুঁজলেই কি নয়! বিশিষ্ট মূকাভিনেতা চার্লি চাপলিনের মতে, জীবনে বেঁচেবর্তে থাকবার জন্যে সুখের খুব একটা দরকার আছে বলে মনে করি না। সুখে থাকতে গেলে সুখকে বরং দূরে রাখাই উত্তম!

এবার আসুন সাফল্য নিয়ে কিঞ্চিত বাতচিৎ করি। জীবনে আমরা সকলেই সফল হতে চাই। কারণ আমরা মনে করি, সাফল্য এলে জীবনে সুখও আসবে। তাহলে জানতে হয় ‘সাফল্য’ বলতে আসলে আমরা কী বুঝি! কীসে সাফল্য আসে! এ বিষয়েও নানা মুনির নানান মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, সাকসেস ইজ অ্যা পিস অফ মাইন্ড। আবার কেউ বলেন, সাকসেস ইজ অ্যান এ্যাটিটিউড। আর এ্যাটিটিউড হল গিয়ে ‘ওয়ে অফ থিংকিং’। অর্থাৎ আপনার সাকসেস বা সফলতা আপনার কাছে। অন্যে যাকে সাকসেস বলে মনে করে, আপনি তাকে সাফল্য মনে নাও করতে পারেন। তবে একথা ঠিক যে, জীবনে সুখী হতে না পারলে তাকে ‘সাফল্য’ বলা যাবে না। আপনি সফল হবেন তখনই, যখন আপনার মধ্যে ‘সেলফ স্যাটিসফেকশন’ কাজ করবে। আপনার অঢেল টাকা, আপনি প্রচুর ক্ষমতাবান, আপনার কথায় সকলে উঠে-বসে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই, আপনার শরীর-মন কোনোটাই ভালো নেই, বস্তুত আপনি অসুস্থ- তাহলে আপনি সফল হলেন কী করে, বলুন!

জন উডেন বলেন, সুখের মতো ব্যক্তিগত সাফল্যও ব্যক্তিভেদে পৃথক হয়ে থাকে। এটা নির্ভর করে তার জীবনের লক্ষ্য, মোটো বা উদ্দেশ্যের উপর। যদি মনে করেন যে আপনি একজন ভালোমানের ক্রিকেটার হবেন, সেক্ষেত্রে আপনি হয়তো ওয়ার্ল্ডকাপ ক্রিকেটে অংশ নিয়ে ভালো স্কোর করতে পারলেই নিজেকে সফল মনে করবেন। আবার যিনি বিশ্বনেতা হতে চান, তিনি হয়তো চাইবেন জাতিপুঞ্জের প্রধান হতে। অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাফল্যের সংজ্ঞা আপনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে, তারপরও আপনি নিজেকে নিজের মতোন করে ‘সফল’ ভাবতেই পারেন।

আবার আমরা অনেকেই যথেষ্ট ভাল অবস্থানে রয়েছি, কিন্তু মনের দিক থেকে স্যাটিসফাইড বা খুশি নই। আমরা আরো চাই, অনেক উপরে উঠতে চাই, অথচ সেই পরিমাণ উচ্চতায় পৌঁছানোর মতোন যোগ্যতা আপনার নেই। প্রয়োজনও নেই। ফলে আপনি হয়তো নিজেকে অসফল বা ব্যর্থ মনে করবেন। প্রশ্ন হল, সাফল্যের এই মাপকাঠি কে ঠিক করবে? আপনি স্বয়ং, নাকি আপনার আত্মীয়-পরিজন বা সমাজ! আমি মনে করি, নিজেকে সুখী বা সফল মনে করতে চাইলে সবকিছুতেই পরিমিতিবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়।

এ বিষয়ে দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের বক্তব্য বিশেষভাবে স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন, সুখ বা সাফল্য যাই বলুন, এ দুটোর একটিও পেতে গেলে আপনাকে সবার আগে নিজেকে জানতে হবে, বুঝতে হবে, এবং আপনি নিজে কীসে সুখ অনুভব করেন, তা উপলব্ধি করতে হবে। পরের মুখে ঝাল খেয়ে কখনও পরিতৃপ্ত হওয়া যায় না। মোড়লের ছেলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে নইলে মান থাকে না, অথচ তার মগজে সায়েন্স ঢোকে না। এই ছেলেকে জোর করে ঠেলে বিজ্ঞানে ঢুকিয়ে দিলে তো সে জীবনেও সফল হবে না। তখন আপনি কাকে দোষ দেবেন! মোড়ল, না তার কোমলমতি ছেলেকে! আবার দেখবেন আমরা অনেকেই ভুল দরজায় কড়া নেড়ে চাকরিতে ঢুকি। তারপর কাজ করতে আর ভালো লাগে না। কারণ চাকরিটা আপনার মনের মতোন নয়। বন্ধুরা করছে, তাই জাতে উঠতে আপনিও অমনি ঢুকে পড়েছেন। অথচ আমাদের প্রত্যেকের মেজাজ-মর্জি, এ্যাটিটিউড, রুচি-পছন্দ, সক্ষমতা- সবকিছুই আলাদা। তাহলে আমাদের সাফল্যের মাপকাঠি কী করে এক হবে! অ্যাবসার্ড!

এই আমাকেই দেখুন না, আমি পুরোমাত্রায় ক্রিয়েটিভ একজন মানুষ, আমার লিখতে-পড়তে ভালো লাগে, অথচ আমি কিনা হয়ে গেলুম রাজস্বকর্তা। আবার কেউ হয়তো রক্ত দেখলে ভিড়মি খায়, অথচ ডাক্তারি পড়ে সে এখন মস্তবড় সার্জেন। এরকম মিসম্যাচ হামেশাই হয় বলে আমরা প্রায়শ সুখ বা সাফল্য- কোনটির দেখাই এ জীবনে পাই না। তাই বলি কি, সুখ নিয়ে মিছে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। জীবন মানেই, না না, জি বাংলা নয়, এটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র। আসুন, আমার শুধু নিজের জন্যে নয়, অপরের জন্যও কাজ করি। তাতেই প্রকৃত সুখের সন্ধান পাবো। শরীর ও হৃদয় দুটোই ভালো থাকবে। আর একজন সুস্থ সবল মননশীল মানুষের অসুখী হবার তো কোনো কারণ নেই।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ