• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

সাকিবকে নিষেধাজ্ঞা ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০১৯  

বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান। কোনো ক্রিকেটারের নামের সঙ্গে যুক্ত করে এমন অন্ত্যমিল খুব কম ক্রিকেটারের ভাগ্যেই জোটে। সেই ভাগ্যবান ক্রিকেটারের নাম সাকিব আল হাসান। তিনি সত্যিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রাণ। যে নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়; যা এর আগে কোনো বাংলাদেশি ক্রিকেটারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি ক্রিকেটার; যিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের মুকুট দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধরে রেখেছেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন অনন্য। বিশ্বের সেরা সেরা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যাট হাতে ছিলেন উজ্জ্বল। তাই নতুন প্রজন্মের সব ক্রিকেটারের কাছে সাকিব মানেই আইডল। এখন যারা ক্রিকেট খেলেন প্রায় সবাই স্বপ্ন দেখেন সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার হবেন। তাদের স্বপ্ন এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ সাকিব বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় তারকা।

তবে এবার সেই নামের পাশে কিছুটা কলঙ্ক লাগল। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাকিব আল হাসানকে এ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে আইসিসি। পাশাপাশি আরো এক বছর পর্যবেক্ষণে থাকবেন সাকিব। এর মধ্যে আর কোনো অনৈতিক কাজে যুক্ত হলে আবারও নিষিদ্ধ হবেন তিনি। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বড় ধরনের একটা ধাক্কা। বিশেষ করে সাকিব আল হাসানের মতো অপরিহার্য ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে। অবশ্য বাংলাদেশে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঘটনায় কোনো ক্রিকেটারের নিষিদ্ধ হওয়া এবারই প্রথম নয়। এর আগে ম্যাচ ফিক্সিং ইস্যুতে শাস্তি পাওয়া দেশের প্রথম ক্রিকেটার মোহাম্মদ আশরাফুল। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে অভিযুক্ত হয়ে ২০১৩ সালে প্রথমে ৮ বছর নিষিদ্ধ হলেও পরে তা কমিয়ে ৫ বছর করা হয়। এ ক্ষেত্রে সাকিবের বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। সাকিব সরাসরি ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। জুয়াড়ির সঙ্গে কথা বলার পর তা না জানানোর অপরাধে বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিষিদ্ধ করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল- আইসিসি। তবে সাকিব সরাসরি ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। শুধু প্রস্তাব পাওয়ার তথ্য গোপন করেন।

সাকিবের এই ইস্যুটি সামনে আসার আগে গত ১০ দিন বাংলাদেশের ক্রিকেট ছিল অনেকটা টালমাটাল। বিশেষ করে ক্রিকেটারদের আন্দোলন ইস্যুতে। একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায় গত ২১ অক্টোবর হঠাৎ করে কাউকে কিছু না জানিয়ে ক্রিকেটাররা এক জোট হয়ে ১১ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন বিসিবির সামনে। যেখানে নেতৃত্ব দেন সাকিব আল হাসান। দাবি আদায় না হলে ক্রিকেটাররা সরাসরি হুমকি দেন ক্রিকেট না খেলার। সে সময় ক্রিকেটারদের সেই দাবিগুলো হয়ে ওঠে আলোচিত বিষয়। ক্রিকেটারদের ১১ দফা দাবিগুলো ছিল নি¤œরূপ। ১. ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন কোয়াবের বর্তমান কমিটিকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। ক্রিকেটারদের সরাসরি ভোটে ঠিক করা হবে নতুন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। ২. ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দল বদলের নিয়ম আগের মতো করতে হবে। যে যার পছন্দমতো দলে যাবে। ৩. এ বছর না হোক, তবে পরের বছর থেকে আগের মতো (ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে) বিপিএল আয়োজন করতে হবে। স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক বাড়াতে হবে। ৪. প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ম্যাচ ফি ১ লাখ করতে হবে। চুক্তিভুক্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন ৫০ শতাংশ বাড়াতে হবে। ১২ মাস কোচ-ফিজিও দিতে হবে, প্রতি বিভাগে অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে বল দিয়ে খেলা হয়, ঘরোয়া লিগে সেই বল ব্যবহার করতে হবে। দৈনিক ভাতা ১৫০০ টাকায় কিছু হয় না, তা বাড়াতে হবে। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যাওয়ার জন্য যাতায়াত ভাড়া মাত্র ২৫০০ টাকা। তা বাড়াতে হবে অথবা প্লেন ভাড়া দিতে হবে। হোটেল ভালো হতে হবে, জিম ও সুইমিংপুল সুবিধা থাকতে হবে। ৬. জাতীয় দলে চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা অন্তত ৩০ করতে হবে ও বেতন বাড়াতে হবে। ৭. দেশি সব স্টাফের বেতন বাড়াতে হবে। কোচ থেকে শুরু করে গ্রাউন্ড স্টাফ, আম্পায়ারÑ সবার বেতন বাড়াতে হবে। ৮. জাতীয় লিগের পর আগে একটি ওয়ানডে লিগ হতো, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে। বিপিএলের আগে আরেকটি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট দিতে হবে। ৯. ঘরোয়া ক্যালেন্ডার চূড়ান্ত হতে হবে। ১০. ডিপিএলের (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ) পাওনা টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দিতে হবে। ১১. বিদেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ দুটির বেশি খেলা যাবে না, এমন নিয়ম তুলে দিতে হবে। সুযোগ থাকলে সবাই খেলবে। প্রথমে ১১ দফা নিয়ে এলেও পরে ২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় আইনজীবীর মাধ্যমে আরো নতুন দুটি দাবি বাড়ানো হয় ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে। নতুন দুটি দাবি হলোÑ ক্রিকেটের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও বিসিবির আয়ের একটা অংশ ক্রিকেটারদের দিতে হবে। আর সবশেষ দাবি ছিল নারী ক্রিকেটারদের ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে। এ ছাড়া আরো কিছু দাবি রয়েছে; যা তারা উল্লেখ করেনÑ ঘরোয়া ক্রিকেটে অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগে ইচ্ছা করেই কোনো দলকে জেতানো বা হারানো

হয়। এসব বন্ধ করতে হবে। ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব দাবিগুলো তারা দীর্ঘদিন বললেও বিসিবি গুরুত্ব দেয়নি। অবশ্য বিসিবির পক্ষ থেকে বলা হয় বিসিবিকে আগে কিছু বলেননি ক্রিকেটাররা।

মূলত এসব দাবি প্রকাশিত হওয়ার পর ক্রিকেট নিয়ে জাতির মধ্যে চরম উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। কারণ ক্রিকেটারদের দাবির বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসে বিসিবির পক্ষ থেকে। এতে শুরু হয় বিসিবির সঙ্গে ক্রিকেটারদের প্রকাশ্য বিরোধ। তবে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে দীর্ঘ ৫৪ ঘণ্টা পর অবশ্য দৃশ্যত সেই বিরোধের অবসান হয়। ২৩ অক্টোবর রাতে বিসিবি কার্যালয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ক্রিকেটারদের অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয় বিসিবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিকেটাররাও তাদের আন্দোলন স্থগিত করে। সম্মত হয় অনুশীলনে ফেরার বিষয়ে। ভারত সফরে যাওয়ার বিষয়েও রাজি হয় তারা। অংশ নেয় প্রস্তুতি ম্যাচেও।

তবে এর দুই দিন পর নতুন করে এমন একটি বিষয় সামনে আসে; যার জন্য কেউ আসলে প্রস্তুত ছিল না। আলোচনায় আসে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত সাকিব। সারা দেশের মানুষ সাকিবের এই ঘটনাটি মেনে নিতে পারেনি। এখনো পারছে না। তবে বাস্তবতা হলো, আমাদের সবাইকে সাকিবের বিষয়টি মেনে নিতে হবে। আগামী এক বছর সাকিবকে ছাড়াই মাঠে নামতে হবে দলকে। এটা সত্যিই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের জন্য। তবে ক্রিকেটারদের আন্দোলন ও সাকিব ইস্যু এখন থেমে গেলেও এর রেশ রয়ে যাবে আমাদের ক্রিকেটে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, সাকিব ইস্যুতে বড় রকমের একটা প্রভাবও পড়বে আগামীতে। তবে সবার বিশ্বাস সাকিব তার আগের রূপেই ফিরে আসবেন মাঠে।

এখন একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক, ক্রিকেটারদের আন্দোলনের বিষয়টির দিকে। ক্রিকেটাররা যেসব দাবিতে আন্দোলন করেছেন তা অবশ্যই যৌক্তিক। কিন্তু তারা যে প্রক্রিয়ায় আন্দোলন করেছেন, তা সঠিক ছিল না। তাই সঠিক প্রক্রিয়ায় না এগোলে আগামীতে অনেক যৌক্তিক ইস্যুও বাদ পড়ে যেতে পারে। তাই ক্রিকেটারদের এ বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে। আবার ক্রিকেটারদের দাবির বিষয়ে বিসিবি যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটাও কাম্য ছিল না। কারণ ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য ক্রিকেটার ও বোর্ডের সম্পর্ক সবার আগে জরুরি। ক্রিকেটাররা মাঠে খেললেও সেই পরিবেশ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব বোর্ডের। বোর্ড ও ক্রিকেটারদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক হলে লাভবান হবে আমাদের ক্রিকেট। কারণ বাংলাদেশের ক্রিকেট সবার কাছে বিশেষ কিছু। এর সঙ্গে এখন আমাদের সবার আবেগ জড়িত। সেই আবেগটা এতই প্রবল যে, ক্রিকেটে ভালো করলে আমরা আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠি। আবার কখনো ক্রিকেটে খারাপ ফলাফল করলে আমরা কষ্ট পাই। তাই সুখ-দুঃখের ক্রিকেটে সব সময় এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা থেকেছেন ক্রিকেটারদের পাশে। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। সবাই থাকবে ক্রিকেটারদের পাশে, ক্রিকেটের পাশে।

বাস্তবতা হলো, ক্রিকেটারদের আন্দোলন ও সাকিবের নিষিদ্ধ হওয়া আমাদের জন্য বেশ বড় ঘটনা। তবে এর বিরূপ প্রভাব যেন আমাদের ক্রিকেটে না পড়ে; সে বিষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে বোর্ডের দায়িত্ব সবার আগে। পাশাপাশি ক্রিকেটারদেরও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। সবকিছু ভুলে গিয়ে মাঠের পারফরম্যান্সের দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। তবেই কাক্সিক্ষত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে আমাদের ক্রিকেট।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ