• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

আশা, নেশা ও পেশা

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২১  

আমার সকল আশা, নেশা ও পেশা সবই আমার স্বার্থে হলেও আমি কি চিরকাল বেঁচে থাকতে পারবো?

এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সকল সচেতন মানুষ মাঝে মাঝে খুঁজতে চেষ্টা করে। আমিও করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবারও নিজের আশা আকাঙ্খা, নেশা, পেশা সবই আপন স্বার্থে মিলিয়ে ফেলি। কারণ, সাধারণ মানুষ এর বাইরে যেতে পারে না। কিছু কিছু মহান মানুষ এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে। তাঁরা নিজেকে সমর্পণ করে সৃষ্টির কল্যাণে। তাঁদের আশা,নেশা ও পেশা সবকিছু সৃষ্টির কল্যাণে কাজে লাগিয়ে একদিন মাটির দেহ নিয়ে মাটিতে মিশে গেলেও রেখে যায় আলো। তাঁদের রেখে যাওয়া আলোয় দীর্ঘদিন আলোকিত হতে থাকে সমগ্র সৃষ্টি।

এইসব আলোকিত মানুষের আশা, নেশা ও পেশার সুফল ভোগ করে সমগ্র বিশ্ব। যুগে যুগে, কালে কালে, দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে এইসব মহান মানুষের আবির্ভাব ঘটে। যে জাতি বা দেশ তাদের মহান মানুষদের প্রকৃত মূল্যায়ণ করতে পারে সেই জাতির মধ্যে মহান মানুষের বার বার আবির্ভাব ঘটে। সেইসব মহান মানুষদের আলোর পথ বেয়ে সংশ্লিষ্ট জাতি, দেশ বা এলাকা দিন দিন আরো বেশি আলোকিত হয়। আর যে জাতি, দেশ বা এলাকা তাদের আলোকিত মহান মানুষদের অবমাননা করে, সেই দেশে বা এলাকায় নতুন কোন মহান মানুষ জন্ম নেয় না। ফলশ্রুতিতে সেই দেশ, জাতি বা এলাকা দিন দিন অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয়।

আমরা বাঙালি বা বাংলাদেশিরা জাতি অথবা দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে কোথায় অবস্থান করছি তা সচেতন মানুষ মাত্রই সহজে অনুধাবণ করতে পারি। জাতি বা দেশ হিসেবে আমাদের এই অবস্থানের পিছনে হাজারো কারণ উল্লেখ করা যায়। অগণিত কারণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ, আমরা আমাদের আলোকিত মহান মানুষদের অবমাননা করতে সিদ্ধহস্ত। আমাদের আশা, নেশা, পেশা সবকিছু নিজেকে ঘিরে। আর যাঁরা নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে পরার্থে আলো ছড়াতে আত্মবিসর্জন করে গেছেন বা এখনও করতে চান তাঁদের অবমূল্যায়ন করতে আমরা ভুল করি না। তাইতো জাতি বা দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থান এইখানে।

প্রতিটি মানুষের মনে মনে অনেক আশা থাকে। কোন মানুষই তার সারা জীবনের সকল আশা পূরণ করতে পারে না। তবে তার আশাগুলি যদি সৃষ্টির জন্য কল্যাণমূলক হয় তাহলে তার অপূর্ণ আশাগুলি পূরণ না করে সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও শুভ আশার ফলাফল পরপারে গিয়ে উপভোগ করবে।

নেশার মধ্যেও এক ধরনের মাদকতা আছে। যে মানুষ তার নেশাকে সুপথে পরিচালিত করতে পারে তার সমগ্র জীবনটা এক নৈসর্গিক আনন্দময় ভুবন। আলোর নেশায় পাগল হয়ে সারা জীবন আলো ছড়িয়ে সেও একদিন পরপারের ডাকে সাড়া দিয়ে আর এক অনন্ত নেশার জগতে গিয়ে প্রবেশ করে।

সকল মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তার একটা পেশা প্রয়োজন হয়। পেশা ছাড়া কোন মানুষের অস্তিত্ব বা কোন পরিচয় থাকে না। তাই পেশার মধ্যে নিজেকে আলোকিত করা সকল মানুষের মহান দায়িত্ব। মানুষ যদি তার পেশাকে সঠিকভাবে পালন করে তাহলে ইহজগতে সে অন্ততঃ মহান মানুষ হিসেবে নাম লেখাতে না পারলেও অমানুষ হয়ে বিদায় নেবে না। প্রকৃতির নিয়মে পরপারে যাবার পরেও হিসেবের খাতা সহজে মিলাতে পারবে।

অত্যন্ত হতাশার ব্যাপার হচ্ছে-আমাদের দেশে অধিকাংশ পেশায় প্রায় সকলেই কোন না কোনভাবে দায়িত্বহীন, উদাসীন অথবা অপব্যবহারকারী। আমি যখন আমার পেশায় দায়িত্বহীন, উদাসীন বা অপব্যবহারকারী তখন আমার আশা, নেশা, পেশা সবকিছুই সৃষ্টির জন্য ভয়ঙ্কর। আমার ইহকাল- পরকাল সবই অভিশপ্ত। আমার আগমনে সৃষ্টির অকল্যাণ হলো। অতএব আমাদের প্রত্যকের স্ব স্ব পেশাকে সঠিকভাবে পালন করা সবচেয়ে পবিত্র কর্তব্য। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় বৈপরীত্য এইখানে।

উদাহরণ হিসেবে ধরে নেই এদেশের একজন চা বিক্রেতাকে। তিনি দীর্ঘদিন রাস্তার পাশে চা বিক্রি করেন। তার দোকানে হরেক রকম মানুষ চা পান করে। অনেক মানুষ চায়ের আড্ডাও বসান। ঐ চা দোকানি সারা জীবন চা বিক্রি করতে করতে চায়ের আড্ডায় বসা সকল মানুষের আলাপচারিতা শোনেন। তাদের সাথে দেশের রাজনীতি, সমাজ সমাজিকতা, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, কিভাবে দেশের উন্নয়ন হবে, পদ্মা সেতুর হালচাল, চেয়ারম্যান নির্বাচন থেকে শুরু করে সংসদ নির্বাচন সবকিছু তিনি জানেন। তিনি শুধুমাত্র একটি জিনিস সঠিকভাবে জানেন না বা জানার প্রয়োজন মনে করেন না। সেটা হলো কিভাবে ভাল চা তৈরী করতে হয়।

এই চা দোকানীর মতো আমাদের দেশের সকল পেশায় নিয়োজিত লোকজন তার নিজের কাজটি সঠিকভাবে পালন না করে অন্যের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে সদা নিয়োজিত। তাদের সকল আশাও হীনমন্যতায় ভরা। তাদের নেশাও বিষাক্ত মাদকের মতো। তাইতো জাতি ও দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থান এই পর্যায়ে।

তাই বলে আমাদের দেশে একেবারেই আশা ওয়ালা, নেশা ওয়ালা, পেশা ওয়ালা ভাল মানুষ নেই তা কিন্তু নয়। আমরা জাতিগতভাবে এইসব ভাল আশা ওয়ালা, নেশা ওয়ালা, পেশা ওয়ালা মানুষের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে অভ্যস্থ নই। বরং যারা সঠিকভাবে তাদের পবিত্র আশা, নেশা ও পেশা বাস্তবায়ন করতে চায় সবাই মিলে তাদের প্রতিহত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করি।

আমাদের এই জাতিগত দৈন্যতা এখনই পরিহার করতে হবে। বিশ্বের উন্নত জাতির মতো মহান মানুষের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই আমাদের দেশে আলো ছড়াতে মহান মানুষের আবির্ভাব ঘটবে। তাঁদের আলোর ছটায় আমরা আলোকিত হবো। বিশ্বের দরবারে আমাদের অবস্থান সমুন্নত হবে।

(লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা)

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ