• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

জাকাতের গুরুত্বপূর্ণ মাসলা মাসায়েল

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৯ এপ্রিল ২০২৩  

পবিত্র কোরআনে নামাজের পরই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে জাকাতকে। মুমিনদের পরিচয় সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে- ‘তারা এমন লোক- যাদেরকে আমি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে, সৎকাজের আদেশ করে ও মন্দকাজে বাধা প্রদান করে।’ (সূরা: হজ, আয়াত: ৪১)

জাকাত আরবি শব্দ। অর্থ- পবিত্র হওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। পারিভাষিক অর্থে, ধনীদের ধন-সম্পদ থেকে আল্লাহর নির্ধারিত হারে উপযুক্ত ব্যক্তিকে দান করা। জাকাত ইসলামের দৃষ্টিতে অনুদান নয় বরং গরিবের অধিকার।

জাকাত একদিকে দাতার আত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে, তার ধন-সম্পদকেও পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করে দেয়; অন্যদিকে দরিদ্রদের অভাব পূরণে সহায়তা করে এবং সম্পদে ক্রমবৃদ্ধি বয়ে আনে। তাই জাকাত একটি সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অনন্য হাতিয়ার।

উল্লেখ্য, অধিক সওয়াবের আশায় অনেকে রমজান মাসে জাকাত আদায় করে থাকেন। যদিও জাকাতের সঙ্গে রমজানের সম্পর্ক নেই, তথাপি এই মাসে জাকাত আদায় করা অধিক সওয়াবের কাজ।

জাকাতের গুরুত্বপূর্ণ মাসলা মাসায়েল

(১) কোনো ব্যক্তি যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মালিক হয়; চাই তা ব্যবহার করুক বা নাই করুক ঋণ মুক্ত অবস্থায় তার নিকট এক বৎসর কাল থাকলে তার উপর জাকাত দেওয়া ফরজ। যদি তার নিকট অন্য কোনো মাল না থাকে তাহলে উক্ত মালের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ কিংবা তার সমপরিমাণ মূল্য আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে উক্ত স্বর্ণ বা রূপা থেকে কিছু অংশ বিক্রি করে হলেও জাকাত আদায় করা জরুরি। (আদদুররুল মুখতার ২:২৯৫)

(২) যদি ব্যাংকে বা অন্য কোনো তহবিলে কারো টাকা জমা থাকে আর ঐ টাকাগুলো ঋণমুক্ত অবস্থায় নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিক্রান্ত হলে তার জাকাত দিতে হবে। (আলমগীরী ১:৭২, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৩:৫৭)

(৩) যদি কোনো সাহিবে নিসাব ব্যক্তি দোকান কিংবা বাড়ী ভাড়া নেয় আর মালিকের নিকট সিকিউরিটি হিসেবে জমা রাখে যা পরবর্তীতে ফেরতযোগ্য তাহলে উক্ত টাকার জাকাত দেওয়া ফরজ। কারণ, উক্ত টাকা তার মালিকানায়ই রয়েছে । জমা রাখার দরুন তার মালিকানা শেষ হয়নি, সুতরাং অন্যান্য মালের সঙ্গে হিসাব করে তার এ টাকার জাকাতও আদায় করতে হবে। (আদদুররুল মুখতার ২:৩০৫, দারুল উলূম ৬:৭৭ আহসানুল ফাতাওয়া ৪:২৫১)

তবে উক্ত টাকা যদি এডভান্স ভাড়া হয় যা থেকে মাসে মাসে কিছু কিছু কাটা যায় তাহলে উক্ত টাকার জাকাত দিতে হবে না।

(৪) স্বর্ণ বা রূপার মধ্যে যেকোনো একটির গহনা আছে, কিন্তু নিসাব পরিমাণ নয়, কিন্তু তাহার সঙ্গে নগদ টাকা (চাই পাঁচ/দশ টাকাই হোক না কেন) সারাবৎসর হাতে আছে। যদি উক্ত স্বর্ণ বা রূপার সঙ্গে টাকা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার দামের সমান হয় তাহলে তার উপর জাকাত ফরজ হবে। (রদ্দুল মুহতার ২:২৯৬, ফাতাওয়া দারুল উলূম, ৬:৫০)

(৫) করয দেওয়া টাকা উসূল হওয়ার পর উক্ত টাকার জাকাত দিতে হবে এবং বিগত বছর সমূহে উক্ত টাকার জাকাত না দিয়ে থাকলে সেই বকেয়া জাকাতও দিতে হবে। তবে কেউ যদি করযের টাকা উসূল হওয়ার পূর্বে প্রতি বছর উক্ত টাকার জাকাত দিয়ে দেয়, তাহলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (আদ্দুররুল মুখতার ২:২৬৬, দারুল উলূম ৬:৪৫,৭৭)

যে করযের টাকা পাওয়ার কোনো আশা নেই সে টাকার জাকাত দিতে হবে না। আর যদি কখনো উসূল হয় তাহলে সে বছর থেকে জাকাত দেবে। অতীতের জাকাত দিতে হবে না। (কিতাবুল ফিকহ ১:৫৪৮, দূররে মুখতার ও রদ্দুলমুহতার খণ্ড-২ পৃ-২৬৬)

(৬) জাকাতের নিয়্যতে ঋণ মাফ করে দিলে জাকাত আদায় হবে না। জাকাত আদায় হওয়ার জন্য তামলীক তথা অন্যকে খালেছ ভাবে জাকাতের মালের মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। আর জাকাতের নিয়্যতে ঋণ মাফ করে দিলে গরীবকে জাকাতের টাকার মালিক বানানো হচ্ছে না । তাই এ পদ্ধতিতে জাকাত আদায় হবে না।

তবে এরূপ ক্ষেত্রে জাকাত আদায়ের সঠিক পন্থা হলো, ঋণ দাতা প্রথমে নিজের পক্ষ থেকে গরীব ঋণ গ্রহীতাকে নিঃশর্তভাবে জাকাতের টাকার মালিক বানিয়ে দেবে। তারপর তার থেকে পাওনা ঋণের টাকা উসূল কবে নেবে, এতে জাকাত আদায় হয়ে যাবে এবং ঋণও উসূল হয়ে যাবে। (আদদুররুল মুখতার ২:২৭০, ফাতাওয়া আলমগীরী ১:১৭১, রহীমিয়া ২:১২)

(৭) যদি কোনো রাজনৈতিক দল জাকাতের টাকা কোরবানির চামড়া ইত্যাদি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা সেবার নামে সংগ্রহ করে আর সেগুলোকে ইলেকশনে ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ব্যয় করে এবং রাজনৈতিক কর্মীদের ভাতা হিসেবে প্রদান করে তাহলে তাদেরকে এ জাতীয় সদকা (অর্থাৎ, সদকায়ে ওয়াজিবাহ) প্রদান করা জায়িয নয়। এবং এতে যজাকাত দাতার জাকাত আদায় হবে না। (খাইরুল ফাতাওয়া ৩:৩৯৭)

(৮) মসজিদ, মাদরাসা, এতীমখানা, হাসপাতাল ইত্যাদির নির্মাণ কাজে জাকাতের টাকা ব্যয় করলে জাকাত আদায় হবে না। জাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো, জাকাতের প্রকৃত হকদারকে বিনিময়হীন ভাবে উক্ত মালের মালিক বানিয়ে দেওয়া। নির্মাণ কাজে ব্যয় করলে যেহেতু কোনো হকদার ব্যক্তিকে মালিক বানানো হয় না তাই এ সুরতে জাকাত আদায় হবে না। সুতরাং এসব নির্মাণ কাজে কেউ জাকাত দিয়ে থাকলে ঐ পরিমাণ টাকার জাকাত দ্বিতীয়বার আদায় করতে হবে। উল্লেখিত কারণেই জাকাতের মাল জনকল্যাণমূলক কাজে যেমন: রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ইত্যাদির জন্য ব্যয় করা না জায়িয। অনুরূপভাবে ইসলামের নামে টিভি চ্যানেল বা পত্র-পত্রিকার কাজে জাকাত দিলে সে জাকাত আদায় হবে না। (আলমগীরী ১:১৮৮, আহসানুল ফাতাওয়া ৪:২৮২)

(৯) বহু লোক জাকাত-ই দেয় না! আর কিছু লোক এমনও রয়েছে যারা জাকাত দেয় ঠিক; কিন্তু যাকাত দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি তারা অবলম্বন করে না।

শরিয়তে যখন শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত দিতে বলা হয়েছে তখন উহার দাবী হলো জাকাতযোগ্য সমস্ত সম্পদ হতে হিসাব করে শতকরা আড়াই ভাগ বের করে যাকাত দেওয়া। যদি কেউ হিসাব না করে জাকাত আদায় করে আর এই টাকাও নির্দিষ্ট পরিমাণ হতে কম আদায় করে তাহলে তার জন্যও আখিরাতে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। (সূরা তাওবা ৩৪/৩৫)

হিসাব করার সময় জাকাতযোগ্য মালের বর্তমান বাজার দর হিসেবে হিসেব বের করবে। যে দামে খরিদ করা হয়েছে বা ভবিষ্যতে যে দামে বেচা যাবে তা ধর্তব্য নয়। (ফাতাওয়ায়ে শামী ২:২৮৬)

উল্লেখ্য যে, গরীব আত্মীয়-স্বজনকেও জাকাতের মাল দেওয়া যায় বরং তাদেরকেই আগে দেওয়া উচিত। অবশ্য তাদেরকে হাদিয়া বলে দেওয়া ভালো যাতে তারা মনে কষ্ট না পায়। তবে মেহমানে রাসূল (সা.) তালিবে ইলমের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাদেরকে জাকাতের বড় অংশ দেওয়া উচিৎ তাতে জাকাত তো আদায় হবেই সেই সঙ্গে কোরআনী তালীমের সহযোগিতা করার দরুনসদকায়ে জারিয়ার সাওয়াবও হাসিল হবে। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৭৩)

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ