• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

আধুনিক দাসপ্রথা উচ্ছেদে নীতি বদলাতে হবে

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০১৯  

‘আধুনিক দাসপ্রথা’—এই টার্মটির ওপর কয়েক বছর ধরে সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক ও গণমাধ্যমের আগ্রহ বেড়েছে। প্রায় সব সমাজেই ‘আধুনিক দাসপ্রথা’র খারাপ প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। যে অবস্থায় পড়ে একজন ব্যক্তি দাসের মতো ব্যবহৃত হয়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য হয় এবং হাজার চেষ্টা করেও সেই পরিস্থিতি থেকে সে বের হতে পারে না—এমন অবস্থাকেই আধুনিক দাসপ্রথা হিসেবে সাধারণভাবে বোঝানো হয়ে থাকে। আধুনিক দাসপ্রথা শব্দটির সঙ্গে ‘মানব পাচার’ এবং ‘ফোর্সড লেবার’ বা জবরদস্তি করে কাজ করানোর সম্পর্ক অতি নিবিড়। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে পড়া লোকদের ‘বন্দী’ মনে করা যেতে পারে।

গত তিন দশকে মানুষের এই বন্দিদশার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা জ্যামিতিক হারেবেড়েছে। ১৯৯০–এর দশকে এই ধরনের হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন ছিল। এখন তাদের সংখ্যা কয়েক শ। সারা বিশ্বের সরকারগুলো দাসপ্রথাবিরোধী আইন পাস করিয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সব ধরনের দাসপ্রথা বিলোপে বহু আইন হয়েছে। সরকার, এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ জন্য প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। সংবাদমাধ্যমগুলো এই ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়ে সংবাদ প্রচার করছে।

এত কিছুর পরও আধুনিক দাসপ্রথার ধারণা এবং সেটিকে মোকাবিলা করতে যেসব নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে—এই দুই বিষয় নিয়েই বিতর্ক রয়ে গেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমন বহু মানুষ আছে, যারা আধুনিক দাসপ্রথা বলতে যা বোঝায় সেই পরিস্থিতির মধ্যে আটকা পড়ে আছে কিন্তু তাদের আধুনিক দাস হিসেবে স্বীকারই করা হচ্ছে না।

বহু নারী আছেন, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে সে অবস্থা থেকে মুক্তির পথ পাচ্ছেন না। ইউরোপের আশ্রয়শিবির নামক আটককেন্দ্রে অভিবাসীরা বন্দীর মতো দিন কাটাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসী তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে—এই ভয়ে পেটে-ভাতে কোনোরকমে কাজ করে টিকে আছে। এসব লোক এমন একটি অবস্থার মধ্যে আটকা পড়েছে যে তারা সেখান থেকে আর মুক্তি পাচ্ছে না। তাদের দিয়ে জোর করে ক্রীতদাসের মতো খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কারা আধুনিক দাস এবং কারা তা নয়—এই বিষয়টি কে নির্ধারণ করবে? আধুনিক দাসপ্রথা—এই ধারণাটি মূলত সাম্প্রতিক ইউরোপ-আমেরিকান ‘আবিষ্কার’। নিও-অ্যাবোলিশনিস্ট এনজিওগুলো দ্রুত তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে চটকদার প্রচারণা হিসেবে এই টার্মটির প্রচার শুরু করে। গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স নামের বহুল আলোচিত সূচকনির্ভর প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা কেভিন ব্যালেস এই ধারণাটি প্রসারে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর লেখালেখি ও তৎপরতার মধ্য দিয়ে আধুনিক দাসপ্রথার ধারণাটি ব্যাপকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে চলে আসে।

মূলত শ্বেতাঙ্গ উদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই ধারণাটির ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করে। অ-পশ্চিমা দেশগুলোতে, বিশেষ করে দক্ষিণ বিশ্বের দেশগুলোতে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপে থাকা মধ্যবিত্তদের অবস্থার বিষয়ে পশ্চিমা উদারপন্থীদের সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এর জন্ম। উদার পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, আমি যখন আমার পছন্দমতো জীবনযাপন করতে পারব এবং কেউ আমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ চাপিয়ে দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে পারবে না, সেই অবস্থায়ই আমি নিজেকে স্বাধীন বলে দাবি করতে পারব।

আমি পশ্চিম আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ইউরোপে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করার সময় এমন বহু শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, যাঁরা তীব্র দারিদ্র্যপীড়িত এবং শুধু কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্য রাতদিন খেটে চলেছেন। অদ্ভুত বিষয় হলো, এসব মানুষ তাঁদের এই জীবনকেই স্বাভাবিক জীবন হিসেবে মেনে নিয়েছেন এবং এর চেয়ে ভালো জীবন যে থাকতে পারে, তা অনেকেই কল্পনা করতে পারেন না। অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের বন্দী ভাবতেই ভুলে গেছেন। ঘানা এবং ভারতে এই শ্রেণির মানুষ আমি সবচেয়ে বেশি দেখেছি। তার মানে যে লোকটি নিজেকে বন্দী ভাবতে পারছেন না, বিশেষজ্ঞদের সংজ্ঞা অনুযায়ী তাঁকে ক্রীতদাস বলা যাচ্ছে না।

এই কারণে কিছু বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, কর্মীর ‘না’ বলার শক্তিই হলো প্রকৃত স্বাধীনতা। কোনো কর্মী যাতে নির্ভয়ে তাঁর অপছন্দের কাজকে ‘না’ বলতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করাই প্রকৃত স্বাধীনতা। এটি নিশ্চিত করার প্রধান পথ হলো আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় নিয়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার আয়কে ‘মূল আয়’ হিসেবে নির্ধারণ করা এবং সবার জন্য নিম্নতম সেই আয় করার সুযোগ নিশ্চিত করা। সেটি যত দিন হচ্ছে না, তত দিন আধুনিক দাসপ্রথা পৃথিবীতে টিকে থাকবে।

আল–জাজিরাথেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ