• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

আসহাবে রাসূল: আব্দুল্লাহ ইবনে হানজালা (রা.)

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০ জুলাই ২০২০  

‘আব্দুল্লাহ (রা.) মদিনার আওস গোত্রের একজন আনসার সাহাবি। তার পিতা হলেন ‘গাসীসুল মালায়িকা’ হানজাল (রা.)। উহুদের শাহাদাত বরণের পর ফেরেশতারা তাকে গোসল করিয়ে ছিলেন বলে তাকে ‘গাসীসুল মালায়িকা’বলা হয়। 

হানজালা স্ত্রী উপগত হয়ে ঘরে শুয় আছেন। এমন সময় ঘোষকের কন্ঠ কানে গেল, ‘এক্ষুণি জিহাদে বের হতে হবে।’ জিহাদের ডাক শুনে ‘তাহারাতের’(পবিত্রা) গোসলের কথা ভুলে গেলেন। সেই অশুচি অবস্থায় কোষমুক্ত তরবারি হাতে উহুদের প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। যুদ্ধ শুরু হলো। তিনি কুরায়শ নেতা আবু সুফইয়ান ইবনে হারবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। তাকে কাবু করে, তরবারি আঘাত করবেন, ঠিক সেই সময় নিকট থেকে শাদ্দাদ ইবনে আসওয়াদ আল-লায়সী দেখে ফেলে এবং দ্রুত হানজালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তরবারির এক আঘাতে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। অনেকে বলেছেন, আবু সুফইয়ান ও শাদ্দাদ দু‘জনে একযোগে তাকে হত্যা করে। (সীরাতু ইবনে হিসাম-২/৭৫,১২৩, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৩/১৬২)।

হানজালা (রা.) নাপাক অবস্থায় শহিদ হন। শাহাদাতের পর ফেরেশতারা তাকে গোসল দেয়। তাই দেখে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবদেরকে বলেন, তোমরা তার স্ত্রীকে জিজ্ঞস করো তো, ব্যাপার কি? হিসাম ইবনে‘উরওয়া বর্ণনা করেছেন। রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হানজালার (রা.) স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, হানজালার ব্যাপার কি?

স্ত্রী বললেন, হানজালা নাপাক ছিলেন। আমি তার মাথার একাংশ মাত্র ধুয়েছি, এমন সময় জিহাদের ডাক তার কানে গেল। গোসল অসম্পূর্ণ রেখেই সেই অবস্থায় বেরিয়ে গেলেন এবং শাহাদাত বরণ করলেন। একথা শুনে রাসূল্লাল্লা সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এই জন্য আমি ফেরেশতাদেরকে তাকে গোসল দিতে দেখেছি।’ আর এখান থেকেই তিনি হলেন‘গাসিসুল মালায়িকা’। (আস-ইসতী‘আব (আল-ইসাবার পার্শ্বটীকা)-১/২৮১;হায়াতুস সাহাবা-৩/৫৪৪)।

‘আব্দুল্লাহর (রা.) মা হলেন মুনাফিকদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবায় ইবনে সালূলের কন্যা জামিলা। ‘স্বামী আব্দুল্লাহর সঙ্গে সর্বশেষ রাতটি কাটানো ও দৈহিকভাবে মিলিত হবার পর সকালে তিনি যখন উহুদ যুদ্ধে চলে গেলেন তখন জামিলা তার গোত্রের চারজন লোককে ডেকে এনে সাক্ষী মানলেন যে, তোমরা সাক্ষী থাকো এ ব্যাপারে যে, আব্দুল্লাহ গত রাত আমার সঙ্গে কাটিয়েছে এবং দৈহিকভাবে মিলিত হয়েছে। তারা তার এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলো। তিনি বরলেন, আমি দেখলাম, আকাশ ফেটে দু‘ভাগ হয়ে গেল এবং সেই ফাটাল দিয়ে ‘আব্দুল্লাহ ভেতরে ঢুকে গেল, তারপর সেই ফাটল বন্ধ হয়ে আকাশ স্বাভাবিক হয়ে গেল। একথাও তোমরা সাক্ষী থাকো। সে রাতেই জামিলা আব্দুল্লাহকে গর্ভে ধারণ করেন। (উসুদুর গাবা-৩/১১৩)।

ইবনে সা‘দ বলেন, উহুদ যুদ্ধের সাত মাস পড়ে রবিউল আওয়াল অথবা আখির মাসে অর্থাৎ হিজরির চতুর্থ সনে‘আব্দুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের সময় ‘আব্দুল্লাহ সাত বছরের বালক মাত্র। অনেকে অবশ্য ভিন্ন কথাও বলেছেন। তারা বলেন, উহুদে তার পিতা হানজালা (রা.) শাহাদাত বরণের পুর্বেই আব্দুল্লাহর জন্ম হয়। (আল-ইসাবা-২/২৯৯-৩০০)।

যাইহোক, পরিণত বয়সে তিনি পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরী বলে নিজেকে প্রমাণ করেন। উমাইয়্যা শাসক ইয়াযীদ ইবনে মু‘আবিয়ার (রা.) কলঙ্কজনক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে তার প্রতি কৃত‘বায়আত’ (আনুগত্যের অঙ্গীকার) প্রত্যাখ্যান করে তিনি ‘আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের (রা.) প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। মদিনাবাসীরা তাকে আমির হিসেবে মেনে নেয়। ইয়াযীদের বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে। ‘আব্দুল্লাহ (রা.) অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মদিনাবাসীদের সঙ্গে নিয়ে নিজেই সেনাপতি হিসেবে আক্রমণকারীদরে বাধা দেন। অসংখ্য মদিনাবাসী মুখোমুখি যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। আব্দুল্লাহর (রা.)  আট পুত্র একের পর একে ইয়াযীদ -বাহিনীর  বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য‘আব্দুল্লাহ স্বচক্ষে আবলোকন করেন। অবশেষে তিনি নিজেই অগ্রসর হন। উহুদে শাহাদাত প্রাপ্ত পিতা হানজালার (রা.) রক্তরঞ্জিত পোশাক পরে শক্রর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শাহাদাত বরণ করেন। এ ছিলো হিজরী ৬৩ (তেষষ্ট্রি) সনের জিলহজ মাসের ঘটনা। (উসুদুল গাবা-৩/১১৪)।

‘আব্দুল্লাহ (রা.) ছিলেন একজন জ্ঞানী, গুণী ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ। তার কর্মকানণ্ডও ছিলো উঁচু মানের এবংমানুষের অন্তরেও ছিলো তা বিশেষ স্থান। একদিন তিনি একজন কোরআন পাঠকের কণ্ঠে নিম্মের আয়াতটি শোনেন, 

لَهُم مِّن جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَمِن فَوْقِهِمْ غَوَاشٍ

‘তাদের শয্যা এবং তাদের উপরের আচ্ছাদনও হবে জাহান্নামের।’ (সূরা: আল-আরাফ, আয়াত: ৪১)।

আয়াতটি শুনে তিনি এতো কাঁদলেন যে, উপস্থিত লোকেরা ধারণা করলো এখনই তার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। দীর্ঘক্ষণ পর তিনি স্থির হলেন। তখন লোকেরা বললো, আবু‘আবদির রহমান! আপনি একটু ওঠে বসুন। তিনি বললেন, জাহান্নামের স্বরণ আমাকে বসতে বারণ করছে। আমি জানিনে, আমিও হয়তো জাহান্নামীদের একজন হয়ে যেতে পারি।

তার দাস সা‘ঈদ বলেন, ঘুমানোর জন্য ‘আব্দুল্লাহর কোনো বিছানা ছিলো না। রাতে সালাত আদায় করতে করতে যখন বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তখন তার গায়ের চাদরটি অথবা তার একটি বাহু মাথার নিচে দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতেন। (উসুদুল গাবা-৩/১১৪)।

সাফওয়ান ইবনে সুলাইম বলেন, মদিনাবাসীরা বলাবলি করতো যে, একদিন ‘আব্দুল্লাহ ইবনে হানজালা (রা.) মসজিদের বাইরে অবস্থান করছেন, তখন শয়তান তার নিকট মানুষের বেশ ধরে এসে বলে, হে হানজালার পুত্র! তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছো? বললেন, হ্যাঁ! পেরেছি। তুমি তো শয়তান। শয়তান বললো, কিভাবে চিনলে? ‘আব্দুল্লাহ (রা.) বললেন, আমি আল্লাহর জিকির করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়েছি; কিন্তু তোমাকে দেখার পরই আমার সেই জিকির বন্ধ হয়ে গেছে। (আল-ইসাবা-২/২৯৯)।

‘আব্দুল্লাহ ইবনে আবী সুফইয়ান বলেন,‘আব্দুল্লাহ ইবনে হানজালা (রা.) শাহাদাত বরণের পর একদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে তাকে সুন্দর অবয়বে দেখতে পেলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নিহত হননি? বললেন, হ্যাঁ! হয়েছি। আমার রবের (প্রতিপালকের) সাক্ষাৎ লাভ করেছি। তিনি আমাকে জান্নাতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আমি আমার ইচ্ছা মতো জান্নাতের উদ্যানে ঘুরে বেড়াই ও ফল ছিড়ি।‘আব্দুল্লাহ ইবনে আবী সুফইয়ান বলেন, আমি তার সঙ্গী-সাথীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, তারা আমার সঙ্গে আমার পতাকা তলেই আছে। সেই পতাকার গিট কেযামত পর্যন্ত খোলা হবে না। ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আবী সুফইয়ান বলেন, এরপর আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। (উসুদুর গাবা-৩/১১৪)।

ইবনে‘আসাকির বর্ণনা করেছেন, খলিফা ‘ওমর (রা.) যখন লোকদের ভাতার ব্যবস্থা করেন তখন হানজালার  (রা.) ছেলে ‘আব্দুল্লাহর জন্য দু‘হাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন। তালহা (রা.) তার ভাইয়ের ছেলের হাত ধরে খলিফার নিকট নিয়ে যান। খলিফা তার জন্য কিছু কম অংক নির্ধারণ করেন। তালহা (রা.) বলেন, আমিরুল মু‘মিনীন! আপনি এই আনসারীকে আমার ভাতীজার চাইতে বেশি দিলেন? খলিফা বলেন, হ্যাঁ! কারণ তার পিতা হানজালাকে আমি উহুদে অসির নিচে এমনভাবে হারিয়ে যেতে দেখেছি যেমন একটি উট হারিয়ে যায়। (হায়াতুস সাহাবা-২/২৮১; আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-৩/১৬৩)।

‘আব্দুল্লাহ (রা.) অল্প বয়সে রাসূল্লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অল্প কিছু হাদিস তিনি বর্ণনা করেছেন। আর তার থেকে সেই হাদিস বর্ণনা করেছেন: ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ইযায়ীদ আল-খাতমী, আসমা’বিনতে যায়দ ইবনে আল-খাত্তাব,‘আব্দুল্লাহ ইবনে আবী মুলায়াকা ও আরো অনেকে। (উসুদুল গাবা-৩/১৪৪)।

সংগ্রহে: প্রিয়ম হোসেন

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ