• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

ইসতেখারার উপকারিতা ও সুন্নত পদ্ধতি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৩ অক্টোবর ২০২০  

হজরত মুসা (আ.) এর একটি ঘটনা: হজরত মুসা (আ.) আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কথা বলতে তুর পাহাড়ে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে একব্যক্তি হজরত মুসা (আ.)-কে বললেন, হুজুর, আপনি আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছেন। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। নিজের প্রয়োজনের কথা, মনের কথা, আশা আকাক্সক্ষার কথা আল্লাহ তায়ালার সামনে পেশ করার জন্য এরচেয়ে উত্তম মুহূর্ত কী হতে পারে? 

তাই আপনি আল্লাহ তায়ালার দরবারে গেলে দয়া করে আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি বড় নিঃস্ব, অসহায়। নানান দুঃখ-দুদর্শায় জর্জরিত। হুজুর, আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করেন। হজরত মুসা (আ.) লোকটিকে ওয়াদা দিয়ে বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার জন্য দোয়া করব। 

যাও, আমি তাকে বেশিই দিলাম:

এরপর হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কথা বললেন। কথাবার্তার পর আসার সময় যেই লোকটি দোয়া চেয়ে ছিল তার কথা মনে পড়ল। হজরত মুসা (আ.) তার জন্য দোয়া করলেন, আয় আল্লাহ! অমুক জায়গায় আপনার এক বান্দা থাকে। এই তার নাম। সে আমাকে বলেছিল, আমি যখন আপনার মুখোমুখি হব তখন যেন তার দুঃখ-দুরাবস্থার কথা তুলে ধরি। আয় আল্লাহ! সেও তো আপনার বান্দা। আপনি তাকে সুখ-শান্তি দান করুন। তার সঙ্গে দয়ার আচরণ করুন। তাকে সব রকম নেয়ামত দান করুন। তার বিপদ দূর করে দিন।

আল্লাহ তায়ালা জিজ্ঞেস করলেন, ও মুসা! আমি তাকে অল্প নেয়ামত দান করব নাকি বেশি নেয়ামত? হজরত মুসা (আ.) চিন্তা করলেন, আল্লাহ তায়ালার কাছে যখন কিছু চাইব, তবে অল্প কেন? তাই তিনি আল্লাহ তায়ালাকে বললেন, আয় আল্লাহ! নেয়ামত যেহেতু দেবেনই তবে বেশি করেই দেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ঠিক আছে। যাও, আমি তাকে বেশিই দিলাম। হজরত মুসা (আ.) দারুণ খুশি হলেন। এরপর তিনি তুর পাহাড়ে যে কদিন থাকার থাকলেন।

সারা দুনিয়াও স্বল্প:

তুর পাহাড় থেকে ফিরে যাওয়ার সময় হজরত মুসা (আ.) ভাবলেন সেই লোকটির খোঁজ-খবর নেয়া দরকার। দেখা দরকার এখন কী অবস্থায় আছে সে? তার ব্যাপারে তো আল্লাহ তায়ালা আমার দোয়া কবুল করেছিলেন। যাই হোক, তিনি সেই লোকটির বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লেন। অন্য একব্যক্তি বেরিয়ে এল। হজরত মুসা (আ.) বললেন, আমি অমুকের সঙ্গে দেখা করতে চাই। লোকটি বলল, সে কদিন হলো ইন্তেকাল করেছে। 

হজরত মুসা (আ.) জিজ্ঞেস করলেন, কখন সে ইন্তেকাল করেছে? লোকটি বলল, সে অমুক দিন অমুক সময় ইন্তেকাল করেছে। হজরত মুসা (আ.) চিন্তা করে দেখলেন, যখন তিনি তার জন্য দোয়া করেছিলেন তার কিছুক্ষণ পরই তার ইন্তেকাল হয়েছে। হজরত মুসা (আ.) ভীষণ চিন্তিত হলেন এবং আল্লাহ তায়ালার নিকট আরজ করলেন, আয় আল্লাহ! বিষয়টা আমার বুঝে এল না। আমি তার জন্য সুখ-শান্তি চেয়ে দোয়া করলাম আর আপনি তাকে মেরে ফেললেন! 

আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমি তখন জানতে চেয়েছিলাম তাকে অল্প নেয়ামত দেব নাকি বেশি নেয়ামত? তুমি চেয়েছিলে বেশি নেয়ামত। এই অবস্থায় আমি তাকে সারা দুনিয়া দিয়ে দিলেও, তা অল্পই মনে হত। তাই বেশি নেয়ামত দেয়ার জন্য আমি তাকে জান্নাতে নিয়ে এলাম। দুনিয়ায় বেশি নেয়ামত হাসিল করা সম্ভব না। তাই তাকে আখেরাতের নেয়ামত দান করলাম।

সীমিত জ্ঞানে মানুষের পক্ষে আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা বোঝা আদৌ সম্ভব না। তিনিই জানেন কার জন্য কোন জিনিস উত্তম। মানুষ বাহ্যিক অবস্থা দেখেই আল্লাহ তায়ালার নিকট অভিযোগ করে বসে। এবং তার ফয়সালাকে মন্দ ভাবতে থাকে। মানুষের কল্যাণ কোন পথে, এই ফয়সালা আল্লাহ তায়ালার চেয়ে ভালো কেউ দিতে পারবে না।

ইসতেখারা করার পর:

এই কারণেই আলোচ্য হাদিসে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদি.) বলেছেন, কোনো বিষয়ে ইসতেখারা করার পর এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবে, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই কল্যাণের ফয়সালা করবেন। আল্লাহ তায়ালার সেই ফয়সালা ক্ষেত্র-বিশেষ ভালো মনে নাও হতে পারে। কিন্তু তার পরিণতি হতে পারে শুভ। তারপর শুভ ও কল্যাণকর হওয়ার বিষয়টি দুনিয়ায় প্রকাশ নাও হতে পারে। কিন্তু আখেরাতে গিয়ে নিশ্চিতরূপে জানতে পারবে আল্লাহ তায়ালা যে ফয়সালা করেছেন, তা-ই ছিল আমার জন্য উত্তম ও মঙ্গলজনক। 

ইসতেখারাকারী অসফল হয় না:

অন্য এক হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

ما خاب من استخار ولا ندم من استشار

‘যে ব্যক্তি ইসতেখারা করে সে অসফল হয় না। আর যে পরামর্শ করে সে লজ্জিত হয় না।’ (কানযুল উম্মাল ৭/৮১৩। তাবারানি - ১৪/৩৪৯)।

আহা! আমি এই কাজটা কেন করলাম কিংবা এই কাজটা কেন করলাম না, এ ধরনের আক্ষেপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য যেকোনো কাজ পরামর্শ করে করা উচিত। কোনো কাজ করতে না চাইলে তাও পরামর্শের মাধ্যমে বিরত থাকা উচিত। এর ফলে মানুষ লজ্জিত ও অনুতপ্ত হবে না।

এই হাদিসে যে বলা হয়েছে, ইসতেখারাকারী অসফল হবে না, এর অর্থ হলো ইসতেখারাকারীর কাজের পরিণাম হবে শুভ ও কল্যাণকর। কখনো যদি মনে হয় যে, কাজটা বেশি ভালো ঠেকছে না, এরপরও ইসতেখারাকারী কামিয়াব ও সফলকাম হবে। কারণ, সে আল্লাহ তায়ালার কাছে ইসতেখারা করে কাজ শুরু করেছে।

এমনিভাবে যে ব্যক্তি পরামর্শ করে কাজ করবে তাকে কোনো ব্যাপারে আফসোস করতে হবে না। লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে না। এরপরও যদি কাজে ব্যর্থতা আসে, তাহলে সান্তনার বিষয় হলো, কাজটা আমি একাকী করিনি। আমার বন্ধুজন ও প্রিয়ভাজনদের সঙ্গে পরামর্শ করে করেছি। এখন আল্লাহর হাওলা করে দিলাম। তিনি যেভাবে চাইবেন, করবেন। তাই এই হাদিসে দুটো বিষয়ের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যখনই কোনো বিষয়ে দ্বিধা-সংশয় দেখা দেবে, দুটো কাজ করবে। এক. ইসতেখারা। দুই. পরামর্শ।

ইসতেখারার সংক্ষিপ্ত দোয়া:

ইতঃপূর্বে ইসতেখারার মাসনুন তরিকা ও পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। সময়-সুযোগ পেলেই কেবল এই নিয়মে ইসতেখারা করবে। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে উল্লেখিত মাসনুন দোয়া পড়বে। এর জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। অথচ কখনো কখনো মানুষের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে এত দীর্ঘ দোয়া পড়ার সুযোগ নাও পাওয়া যেতে পারে।

কেননা, বিষয়টি নিতান্তই হঠাৎ সামনে এসে পড়েছে। এখন তাৎক্ষণিকভাবেই কাজটি করা না-করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে খোদ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সংক্ষিপ্ত দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, সেই দোয়াটি পড়বে। তাহলো,

اللَّهُمَّ خِرْ لِي وَاخْتَرْ لِي

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা খিরলি ওয়াখতার লি’

অর্থ: ‘আয় আল্লাহ! আপনিই ঠিক করে দিন আমি কোন পথ গ্রহণ করব।’ (তিয়মিযী)।

এ ছাড়া নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকটি সংক্ষিপ্ত দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। তাহলো,

اللَّهُمَّ اهْدِنِي، وَسَدِّدْنِي

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মাহদিনি ওয়া সাদ্দিদনি’

অর্থ: ‘আয় আল্লাহ! আমাকে হেদায়েত দিন এবং সোজা পথ দেখান।’ (মুসলিম)।

আর একটি দোয়া হাদিসে এসেছে। তাহলো,

اللَّهُمَّ أَلْهِمْنِي رُشْدِي

উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা আলহিমনি রুশদি।’

অর্থ: ‘আয় আল্লাহ! সহজ পথটি আমার অন্তরে ঢেলে দিন।’ (তিরমিযি)।

যদি এসব দোয়ার মূল আরবি পাঠ পড়া সম্ভব না হয়, তা হলে অন্তত নিজের ভাষায় এই প্রার্থনা করা যায়, আয় আল্লাহ! আমি দ্বিধা-সংশয়ে নিপতিত। আমাকে সঠিক পথ দেখান। যদি মুখে উচ্চারণ করা সম্ভব না হয় তবে মনে মনে এই প্রার্থনা করবে, আয় আল্লাহ! আমার সামনে এখন এই সমস্যা। আপনি আমার অন্তরে সঠিক পথের সন্ধান দান করুন। সে পথ যেন হয় আপনার মর্জি মাফিক এবং আমার জন্য মঙ্গলজনক।

প্রত্যেক কাজের শুরুতে আল্লাহ তায়ালার অভিমুখী হও:

যে ব্যক্তি প্রত্যেক কাজের শুরুতে আল্লাহ তায়ালার প্রতি মন নিবিষ্ট করে নেবে, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না যে, মুহূর্তের মধ্যে তুমি কী করে নিয়েছ। এক মুহূর্তের মধ্যে তুমি আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছ। আল্লাহ তায়ালার নিকট কল্যাণ প্রার্থনা করেছ এবং সঠিক পথের সন্ধান চেয়েছ। এই সংক্ষিপ্ত আমলের ফলে একদিকে তুমি সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যাবে। অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টির সাওয়াব অর্জন করেছ। দোয়া ও প্রার্থনা করার জন্যও রয়েছে আলাদা সাওয়াব।

কেননা, বান্দা যেকোনো বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার অভিমুখী হলে আল্লাহ তায়ালা সেই বান্দার প্রতি খুবই খুশি হন এবং এ জন্য বান্দাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেন। তাই যেকোনো বিষয়ে মানুষের উচিত আল্লাহ তায়ালার প্রতি মনোযোগী হওয়া। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মানুষ নানান পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। নানা সন্দেহ-সংশয়ের মধ্যদিয়ে বহুবিষয়ে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং বহুবিষয়ে তাকে সম্মান দিতে হয়। তাই সবসময় এই বলে আল্লাহ তায়ালার প্রতি মনোযোগ নিবিষ্ট রাখা উচিত, আয় আল্লাহ! আপনার ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী আমার অন্তরে উত্তম বিষয় ঢেলে দিন।

জবাব দেয়ার পূর্বে দোয়ার আমল:

হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি (রহ.) বলতেন, একটি আমল আমি সবসময় নিয়মিত করে আসছি। যখনই কেউ আমার নিকট এসে বলত, হজরত, আমার একটি বিষয় জানার আছে, তখন সঙ্গে সঙ্গে আমি আল্লাহ তায়ালার প্রতি মনোযোগ নিবিষ্ট করতাম, আয় আল্লাহ! জানি না সে কী জানতে চাইবে। তবে যে প্রশ্নই সে করুক, আমার অন্তরে তার সঠিক জবাব ঢেলে দিন। 
আমি কখনোই এই নিয়মের অন্যথা করতাম না। এভাবে তিনি আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতেন। সুতরাং যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমাদের উচিত আল্লাহ তায়ালার প্রতি মনোযোগ নিবিষ্ট করা।

হজরত ডা. আবদুল হাই (রহ.) বলতেন, ভাই, তুমি তোমার মাওলার সঙ্গে কথা বলো। যেকোনো বিষয়ে আল্লাহ তায়ালার নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। তার প্রতি মনোযোগ দাও। সেই কাজের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার হেদায়েত ও পথনির্দেশ কামনা কর। এই আমলকে সারাজীবনের অভ্যাস বানিয়ে নাও। এ দ্বারা ধীরে ধীরে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক গাঢ় হবে। ফলে একসময় অন্তরে কেবল আল্লাহ তায়ালার ধ্যান-খেয়ালই জাগরূক থাকবে।

আমাদের পূর্বসূরি বুজুর্গানে দ্বীন যেভাবে রিয়াজত মোজাহাদা ও কষ্ট-সাধনা করেছিলেন, আমরা তা কোথায় পাব? তবে আমি আপনাদেরকে একটি সহজ ও সংক্ষিপ্ত রাস্তা বলে দিলাম। এর ওপর আমল করলে ইনশাআল্লাহ! জীবনের আসল লক্ষ হাসিল হবে।

আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক তৈরি হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এসব বিষয়ের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন। 

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ