• মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ৫ ১৪৩০

  • || ০৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

ইয়াতিমের হক ও গরিবের অধিকার

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৬ মার্চ ২০২১  

ইয়াতিমের শাব্দিক অর্থ হলো নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ। বাংলা অভিধান অনুযায়ী, মাতা-পিতাহীন বালক-বালিকাকে ইয়াতিম বলা হয়। ইসলামি পরিভাষায়, যে শিশুর পিতা ইন্তেকাল করেছেন, শুধু তাকেই ইয়াতিম বলা হয়। পিতা উপস্থিত থাকা অবস্থায় মাতাবিহীন শিশুকে ইসলামী পরিভাষায় ইয়াতিম বলা হয় না।

কেননা সন্তানের লালন-পালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পিতার। তাই শিশুকে তখনই নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ ধরা হবে, যখন পিতা থাকবে না। মাতার অবর্তমানেও এই দায়িত্বভার পিতার ওপর অর্পিত। তাই মাতাবিহীন শিশু নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ নয়। আর সন্তান যখন বালেগ হয়ে যায়, তখন তাকে ইয়াতিম বলা হয় না। কেননা সে তখন স্বনির্ভর।

ইয়াতিম সম্পর্কে ইসলাম শুধু নৈতিক নির্দেশনামা দেয়নি; ইয়াতিমের প্রশাসনিক ও আইনগত অধিকারের ভিত্তিও দাঁড় করিয়েছে। এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে হাদিস ও ফিকহের কিতাবে।

পবিত্র কোরআনে ইয়াতিমের মর্যাদা

ইয়াতিমের দায়িত্ব গ্রহণে মর্যাদা ও নির্দেশনা সম্পর্কিত আয়াতগুলো পবিত্র কোরআনে অনেক। এক আয়াতে এসেছে, ‘তারা তোমাকে ইয়াতিম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, তাদের ইসলাহ তথা সুব্যবস্থা (পুনর্বাসন) করা উত্তম...।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২২০)

অর্থাৎ আপনি যদি তাদের উন্নয়নে কল্যাণমূলক কিছু করতে চান, তাহলে তাদের ইসলাহ তথা সার্বিক দেখভালের সুব্যবস্থা করুন। যারা ইয়াতিমের প্রতি অবিচার করে, আল্লাহ তাআলা তাদের ভর্ৎসনা করে বলেন, ‘অসম্ভব, (কখনোই নয়) বরং তোমরা ইয়াতিমের সম্মান রক্ষা করো না।’ (সুরা : ফজর, আয়াত : ১৭)

মক্কার কুরাইশরা ইয়াতিমেদের জুলুম-নির্যাতন করত। বাবা মারা গেলে চাচা এসে ভাতিজার সমুদয় সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজ উদরে হজম করে ফেলত। আল্লাহ তাআলা তাদের এই মন্দ কর্ম নিষিদ্ধ করেন। ইয়াতিম ও অনাথকে ধমক দেওয়াও ইসলামে নিষিদ্ধ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না।’ (সুরা : দুহা, আয়াত : ৯)

ইয়াতিমদের প্রতিপালন, তাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি হতে হবে নিঃস্বার্থ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও (আল্লাহর ভালোবাসায়) অভাবী, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। (এবং তারা বলে) শুধু আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের আহার্য দান করি। বিনিময়ে তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না।’ (সুরা : দাহর, আয়াত : ৮-৯)

হাদিসে ইয়াতিমের মর্যাদা

সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ও ইয়াতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব (তিনি তর্জনী ও মধ্য অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করেন। এবং এ দুটির মধ্যে তিনি সামান্য ফাঁক করেন)।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৩০৪)
ইয়াতিমের মর্যাদা সম্পর্কে প্রিয় নবীজি (সা.) আরো বলেন- বিধবা, ইয়াতিম ও গরিবের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে মুজাহিদের সমতুল্য। অথবা তার মর্যাদা সেই (নামাজের জন্য) রাত জাগরণকারীর মতো, যে কখনো ক্লান্ত হয় না। অথবা তার মর্যাদা সেই রোজাদারের মতো, যে কখনো ইফতার (রোজা ভঙ্গ) করে না। (মুসলিম, হাদিস : ৫২৯৫)

ইসলামের দৃষ্টিতে ইয়াতিমের প্রতিপালন জান্নাতে যাওয়ার উপায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো ইয়াতিমকে আপন মাতা-পিতার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৮২৫২)

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, মুসলিমদের ওই বাড়িই সর্বোত্তম, যে বাড়িতে ইয়াতিম আছে এবং তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওই বাড়ি, যে বাড়িতে ইয়াতিম আছে অথচ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়। অতঃপর তিনি তার অঙ্গুলির মাধ্যমে বলেন, ‘আমি ও ইয়াতিম প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করব।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৬৭৯; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১৩৭)

ইসলামে ইয়াতিমের দশটি অধিকার
ইসলাম ইয়াতিমের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছে; বিশেষ করে ইয়াতিম প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তার প্রতি দশটি অধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে।
১. ইয়াতিমের সম্পদ গ্রাস করা গর্হিত অপরাধ।
২. এতিমের ওপর জোরজবরদস্তি করা নিষিদ্ধ।
৩. ইয়াতিমের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা।
৪. ইয়াতিমের সঙ্গে দুর্ব্যবহার নিষিদ্ধ।
৫. ইয়াতিমের খাদ্যের অধিকার।
৬. নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের অধিকার।
৭. বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সম্পত্তি সংরক্ষণ।
৮. ইহসান বা ভালো ব্যবহারের অধিকার।
৯. ইনসাফ বা ন্যায়সংগত বিচারের অধিকার।
১০. মালে ফাঈ বা যে সম্পদ কাফিরদের সঙ্গে বিনা যুদ্ধে মুসলিমদের হস্তগত হয় (যেমন, খারাজ, জিজিয়া ইত্যাদি), তার ওপর অধিকার।

ইয়াতিমের প্রতি আমরা কী করব
আমরা ইয়াতিমদের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের জীবনযাত্রার সুব্যবস্থা করে সমাজে অবদান রাখতে পারি। এই কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য বড় সংস্থা-সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। আমরা তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে পারি। বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারি। তাদের মধ্যে যারা মেধাবী, যাদের সৃজনশীল ক্ষমতা আছে, তাদের জন্য আলাদা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

আমাদের এসব কর্মতৎপরতা তাদের হৃদয়ে প্রভাব সৃষ্টি করবে। তবে লক্ষণীয় যে এসব কাজ এমন আন্তরিকতার সঙ্গে করতে হবে, যেন আমাদের হৃদয়ে তার পিতৃহীনতার বিষয়টি অনুভূত না হয়। সারা দেশে ছিন্নমূল মা-বাবা হারা অগণিত ইয়াতিম ও অসংখ্য ইয়াতিমখানা রয়েছে। এই ইয়াতিমদের চলাফেরা ও যাতায়াতের সুবিধার্থে সব ধরনের গাড়িভাড়া মওকুফের জন্য সুব্যবস্থা নেয়া যায়। বিশেষ করে ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি যানবাহন বাস, নৌযান, রেলগাড়ি প্রভৃতি যন্ত্রচালিত গাড়িতে ইয়াতিমদের চলাচলের ক্ষেত্রে ভাড়া মওকুফ করা যায়।

সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুরা নানা প্রতিকূলতার মাঝে বেড়ে ওঠে। এতিম, অনাথ, সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুরা এক ধরনের প্রতিহিংসা নিয়ে বেড়ে ওঠে। মানুষ খাবার খাচ্ছে, কিন্তু সে পাচ্ছে না, এই চিন্তা হিংসার জন্ম দেয়। অন্যদের জন্য বস্ত্র আছে, শীত নিবারণের উপকরণ আছে, কিন্তু তার নেই, এই চিন্তা প্রতিশোধ পরায়ণ করে তোলে। এতে এসব শিশুর আচরণ বিকৃত হয়ে যায়। ফলে তারা কাউকে সহজে বিশ্বাস করে না। তাদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক কাজে আগ্রহ জন্মে। তাই এদের পক্ষে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মমতাহীন কাজ করা খুবই সহজ। তাদের থেকেই হয়তো গড়ে উঠেছে মুরগি মিলন, টোকাই সাগরসহ বড় বড় সন্ত্রাসী।

তাই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে তাদের কাউন্সেলিং বিচক্ষণতার সঙ্গে সম্পন্ন করা দরকার। মনঃসামাজিক সহায়ক সেল গঠন করে সেবা নিশ্চিত করা যায়। সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের জন্য বিশেষ আনন্দময় শিক্ষাদান পদ্ধতি নিশ্চিত করা আবশ্যক। বড় শিশুদের জন্য অনানুষ্ঠানিক স্বল্পমেয়াদি শিক্ষা চালু করে এই শিশুদের জন্য সময়োপযোগী বাস্তবমুখী কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। 

ইয়াতিম, অনাথ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়ে। এসব শিশু মাদকাসক্তির কারণে সুন্দর ভবিষ্যৎ বিসর্জন দেয়। তাই এই শিশুদের মাদকাসক্তি চিকিৎসার জন্য প্রতিটি সেবাকেন্দ্রে বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। শিশু হোমে প্রেরণের আগেই তাদের মাদকাসক্তি চিকিৎসা নিশ্চিত করা আবশ্যক।

ইয়াতিম, অনাথ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিচয় ও ঠিকানা অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। অনেক সময় শিশুদের পিতা-মাতার নাম বলতে পারে না। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি শিশুর জন্ম নিবন্ধন জটিলতার কারণে সম্ভব হয় না। ফলে এসব শিশু ভবিষ্যৎ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই এসব শিশুকে জন্ম নিবন্ধন, শিশুর অভিভাবকত্বসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে আইনি বাধাগুলো অপসারণ করা জরুরি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ