• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

উই হ্যাভ টু ফাইট

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৮ মার্চ ২০২০  

আমেনা বেগম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার পদে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। কর্মজীবনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ২০১৫ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম)-সেবা’ লাভকারী আমেনা গত বছর পেয়েছেন ‘আইজি গুড সার্ভিস মেডেল’। বাংলাদেশ পুলিশে ২১ বছরের দীর্ঘ এ যাত্রায় অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী আমেনা এখন অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদায় চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন’স নেটওয়ার্কের সভাপতি।

আলাপচারিতায় তিনি বলেছেন নিজের অভিজ্ঞতা, নারীর অধিকার, নিরাপত্তা এবং নারীর প্রতি সহিসংতা রোধে করণীয়সহ নানা বিষয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন।

পুলিশিংকে চ্যালেঞ্জিং পেশা উল্লেখ করে আমেনা বলেন, ‘এ পেশায় পেশাদারিত্বকে বড় করে দেখা হয়। পুলিশে কে নারী আর কে পুরুষ তা দেখে কোনো কনসিডারেশন নেই। নারী বলে আপনি অতিরিক্ত কিংবা আলাদা ফ্যাসিলিটিজ প্রত্যাশা করতে পারেন না। তবে অন্য সব কর্মক্ষেত্রের চেয়ে পুলিশে নারীর এগিয়ে যাওয়াটা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। কারণ এটা পুরুষপ্রধান কর্মক্ষেত্র। সো উই হ্যাভ টু ফাইট (সুতরাং আমাদের লড়ে যেতে হবে)। আমাদের ফাইট করেই এ প্রফেশনে এগিয়ে যেতে হবে।’

আমেনা বেগম বলেন, ‘২১ বছর ধরে বাংলাদেশ পুলিশে কাজ করছি। অনেক পরিবর্তনই দেখছি। শুরুটা কিন্তু পরিচ্ছন্ন ছিল না। পুলিশে নারীর পদায়ন প্রশ্নে মনে করা হতো, নারী বলে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। এখন সেটা বদলে গেছে। নারীরা কাজের মাধ্যমে সক্ষমতার জানান দিয়েছে। বাহিনী থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় এ ধারণা বদলে গেছে।’

এ পেশায় নারীর যাত্রায় প্রতিকূলতা ছিল এবং আছে। সেটি তুলে ধরে আমেনা বেগম বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই আমরা আজকে পাঁচজন নারী অ্যাডিশনাল ডিআইজি হয়েছি। নিজ নিজ জায়গায় আমাদের কাজটা কর্মকর্তা হিসেবেই করতে হচ্ছে। নারী বলে হীনমন্যতায় ভোগার কোনো সুযোগ নেই। আপনি নারী নন, কর্মকর্তা। অন্তত কর্মকর্তা পর্যায়ে এ ধারণাটা নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রটা আরও প্রশস্ত করেছে বলেই আমি মনে করি।’

‘আগে তো পুলিশে যোগদান করলে নানাজনের কাছ থেকে নানা কথা শুনতে হতো। মানসিক দৈন্যতার কারণে নারী পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সেটা বদলেছে। এটা খুবই ভালো পরিবর্তন। সামাজিক কিংবা পারিবারিক মানসিকতার পরিবর্তন নারীকে এগিয়ে নেবে। যেটার প্রতিফলন আমরা টের পাচ্ছি। এখন পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করাটাকে খুবই পজিটিভলি দেখা হচ্ছে।’

নিজের পুলিশে আসার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আমেনা বলেন, ‘পুলিশে আসার ক্ষেত্রে আমি পরিবারের পুরো সাপোর্ট পেয়েছি। সমাজও আমাকে খুব পজিটিভলি দেখেছে। কিন্তু নিজ দফতরে শুরুটা খুব সহজ ছিল না। নারী অফিসার বলে মনে করা হতো। ফ্যামিলি বাইন্ডিংয়ের কারণে পুরুষের মতো দায়িত্ব পালন করতে নারী পারবে না, এমন ধারণা ছিল। এখনো যে এ ধারণা নেই তা নয়, আছে। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারীকে প্রুভ করতে হয় আমি পারি। আমাকে চ্যালেঞ্জটা নিতে হয়। কাজে সেটার প্রমাণ দিতে হয়।’

অতিরিক্ত এ ডিআইজি মনে করেন, ‘আশা করছি নারীদের এগিয়ে চলার অদম্য স্পৃহা ও পুরুষ সহকর্মীদের বদলে যাওয়ার মানসিকতায় বাকি অন্ধকারটুকুও আলোয় উদ্ভাসিত হবে। যদিও ক্যাডার সার্ভিসে পুলিশে নারীর পথচলা বেশ সহজ হলেও এখনো বাহিনীর নিচের পদে কর্মরত নারীদের সমস্যা রয়ে গেছে।’

সরকার নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে করণীয় জানতে চাইলে আমেনা বেগম বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি-স্বল্পমেয়াদি করণীয় আছে। রাতারাতি পরিবর্তন তো আসলে সম্ভব নয়।’

ফেনীর নুসরাত হত্যার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ফেনীর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বেশ প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু সেখানে যদি আজকে একজন নারী এসপি থাকতেন কিংবা নারী কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হতো, তাহলে নিশ্চিত করেই বলতে পারি যে, সেখানে শুরুতেই ভিন্ন চিত্র উঠে আসতো। মূল ফ্যাক্টটা আগেই স্পষ্ট হতো।’

‘সরকার অনেক কিছুই করছে, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনও করেছে। তবে আরও অনেক কিছুই কিন্তু বাকি আছে। সহিংসতা, নির্যাতন কিংবা নিপীড়নের শিকার একজন নারীর কাছে এ মেসেজটা পৌঁছানো জরুরি যে, তার জন্য রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার সবসময় সচেতন। বিপদে রাষ্ট্র তাকে নিরাপত্তা সহায়তা দেবে, সে প্রস্তুতি সরকারের আছে। এটা তখনই করা সম্ভব যখন নারীর ক্ষমতায়নটা সার্বজনীন হবে। সব ক্ষেত্রেই নারীর এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কোনো নারী যখন ইউএনও হিসেবে কিংবা পুলিশ কর্মকর্তার চেয়ারে একজন নারীকে দেখেন, তখন তার মধ্যে কনফিডেন্স আসে, আত্মবিশ্বাস আসে। নিজের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন প্রেরণা পান, তেমনি নিজে কোথাও গেলে কিংবা সমস্যায় পড়লে বিচারটা যে পাবেন, সে আত্মবিশ্বাসটা পান।’

আমেনা বেগম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর যথেষ্ট সদিচ্ছা আছে। এখন বাংলাদেশে ৯ জেলা প্রশাসক নারী। নারী এসপি আছেন কয়েকটা জেলায়। এটার মানে এই নয় যে, নারী বলে তাদের সেখানে বসানো হয়েছে। এটার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ‘গিভিং দ্য মেসেজ টু দ্য কমিউনিটি, টু দ্য সোসাইটি, প্রত্যেকটা নারী ও শিশু নিরাপদ। প্রতীকী অর্থে এই মেসেজই যাচ্ছে নারীর এমন পদায়নে।’

‘কি-পয়েন্টে এই মেসেজ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিটা জেলায় একজন করে অন্তত নারী এএসপি কিংবা অ্যাডিশনাল এসপিকে পদায়ন করা হোক, যারা কিনা উইমেন অ্যাফেয়ার্স নিয়ে কাজ করবেন। জেলা প্রশাসনে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা আছেন। এ নামকরণে খুবই আশ্চর্য হয়েছি। এটা আসলে মহিলা বিষয়ক নয়, পদটির নাম হওয়া উচিত নারী উন্নয়নবিষয়ক।’

আমেনা মনে করেন, ‘সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হলে পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং বাহিনীতে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ পুলিশের জয়যাত্রা চলছে। এতে পুরুষের মতো ভূমিকা রয়েছে ১০ শতাংশের বেশি নারী পুলিশ সদস্যেরও। পুলিশের দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি, নেতৃত্বের বিকাশ, মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত নারী পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন অপারেশনাল কাজে পুরুষের মতো সমান সাফল্য পাচ্ছেন নারী কর্মকর্তারাও।’

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ