• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

কোরআন-হাদিসে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় ও গুরুত্ব

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

সালাত মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালার নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল ও তাঁর নৈকট্য লাভের এবং মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ। আল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জিন উভয় জাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন।

সালাত এমন এক ইবাদত যা সারা বছর দৈনিক পাঁচবার আদায় করতে হয়, মৃত্যু ছাড়া আর কোনো অবস্থাতেই তা মাফ হয় না এমনকি মৃত্যুশয্যাতেও সালাত হতে বিরত থাকার কোনো বিধান নেই। আর সালাত বাস্তবায়িত হয় তার বিধানাবলী তথা রুকন ও ওয়াজিবসমূহ শিক্ষা, সালাতে একাগ্রতা ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমেই।

আর তাই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ সালাত অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়েই আদায় করতে হবে। পাঁচ ওয়াক্তের সালাতের সময় মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এ সম্পর্কে তিনি ইরশাদ করেন,

إِنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا

‘নিঃসন্দেহে নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করার জন্য মুমিনগণের উপর অবশ্য কর্তব্যরুপে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।’ (সূরা: আন নিসা, আয়াত: ১০৩)

মিরাজের রজনীতে সালাত ফরজ হওয়ার পরের দিন যোহরের সালাতের সময় জিবরাঈল (আ.) এসে প্রথম দিন আওয়াল ওয়াক্তে এবং পরের দিন শেষ ওয়াক্তে নিজ ইমামতিতে কাবা গৃহের নিকট মাকামে ইব্রাহিমের পাশে দাঁড়িয়ে পাঁচ পাঁচ করে দশ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সালাতের পছন্দনীয় সময়কাল ওই সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। (জামি‘আত তিরমিযী-হা: ১৪৯, সুনান আবু দাউদ-হা: ৩৯৩)

শেষ ওয়াক্তে সালাত আদায় করা যদিও শুদ্ধ, তবুও আউওয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করাকে মহানবী (সা.)  সর্বোত্তম আমল বলে অভিহিত করেছেন। কেননা মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো: কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ? উত্তরে মহানবী (সা.) বললেন, প্রথম ওয়াক্তে সালাত আদায় করা। (জামি‘আত তিরমিযী-হা: ১৭০)

আয়িশাহ (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) শেষ জীবন পর্যন্ত দ্বিতীয়বার কখোনো শেষ ওয়াক্তে সালাত আদায় করেননি। (জামি‘আত তিরমিযী-হা: ১৭৪)

নিম্নে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় ও এর গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
ফজর সালাতের সময়:

ফজরের সালাতে সুবহি সাদিক থেকে সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত। তবে এ সালাত গালস বা খুব ভোরে অন্ধকারে আদায় করাই উত্তম। 
এ সম্পর্কে আয়িশাহ (রা.) বলেন: নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ (সা.) ফজরের সালাত আদায় করতেন। তারপর নারীরা তাদের চাদর জড়িয়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যেত। কিন্তু অন্ধকারের কারণে তাদের চেনা যেত না। (সহিহ বুখারি-হা: ৮৬৭, সহিহ মুসলিম-হা: ৬৪৫/২৩২)

আবূ মূসা (আ.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) ফজরের সালাত আদায় করলেন, যখন কেউ তাঁর পাশের সঙ্গীর চেহারা চিনতে পারতেন না অথবা তাঁর পাশে কে রয়েছে, তা জানতে পারতেন না। (সুনান আবূ দাউদ-হা: ৩৯৫)। কাজেই মহানবী (সা.) এর সহিহ সুন্নাহ অনুযায়ী ফজরের সালাত গালস বা অন্ধকারে আদায় করাই উত্তম।

ফজর সালাতের গুরুত্ব:
ফজর সালাতের যথেষ্ঠ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। কেননা ফজর ও আসরের সময় ফেলেশতাগণের পালা পরিবর্তন হয়। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) এর হাদিস নিম্নরুপ।

আবূ হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের নিকট দিবারাত্রি ফেরেশতাবর্গ পালাক্রমে যাতায়াত করতে থাকতেন। আর ফজর ও আসরের সালাতে তারা একত্রিত হন। তারপর যারা তোমাদের নিকট রাত কাটিয়েছেন, তারা ঊর্ধ্ব আকাশে চলে যান। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদের জিজ্ঞেস করেন- অথচ তিনি তাদের সম্পর্কে ভালোভাবে পরিজ্ঞাত,‘তোমরা আমার বান্দাদের কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছ?’ তারা বলেন আমরা যখন ছেড়ে এসছি, তখন তারা সালাতে প্রবৃত্ত ছিলো। আর যখন আমরা তাদের নিকট গিয়েছিলাম, তখনও তারা সালাতে প্রবৃত্ত ছিল। (সহিহ বুখারি-হা: ৩২২৩, সহিহ মুসলিম-হা: ৬৩২/২১০)

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে অর্থাৎ-ফজর ও আসরের সালাত আদায় করবে। সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। (সহিহ মুসলিম-হা: ৬৩৪/২১৩, সুনান আন নাসায়ী-হা: ৪৮৭)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি শীতল সময়ে সালাত আদায় করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সহিহ বুখারি-হা: ৫৭৪, সহিহ মুসলিম-হা: ৬৩৫/২১৫) 

ফজরের সালাতের সময় ফেরেশতাগণের উপস্থিতি ঘটে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন:
‘নিশ্চয়ই ফজরেরর সালাতের কোরআন পাঠের সময় ফেরেশতাগণের উপস্থিতি ঘটে।’ (সূরা: বানী ইসরা-ঈল, আয়াত: ৭৮)

কাজেই ফজরের সালাত জামাতের সঙ্গে আদায় করার যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে। আর এ সালাত দেরী করে ফর্সার মধ্যে আদায় করার চেয়ে অন্ধকারে অর্থাৎ- আউয়াল ওয়াক্তে আদায় করাই উত্তম।

যোহর সালাতের সময়:
সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশে ঢলে গেলেই যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। আর প্রতিটি বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হওয়া পর্যন্ত যোহরের ওয়াক্ত থাকে। (সহিহ বুখারি-হা: ৫৪১, সহিহ মুসলিম-হা: ৬১২, সুনান আবু দাউদ-হা:৩৯৮)

যোহরের সালাত সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন:

أَقِمِ الصَّلاَةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ

‘মধ্যোকাশ থেকে সূর্যাস্ত পথে চলার সঙ্গে সঙ্গে সালাত কায়িম করো।’ (সূরা: বানী ইসরা-ঈল, আয়াত: ৭৮)

যোহর সালাতের গুরুত্ব:
প্রত্যেক সালাত প্রথম ওয়াক্তে আদায় করাই হলো উত্তম। তবে গ্রীষ্ম কালে কঠিন গরমের সময় যোহরের সালাত একটু দেরী করে ঠাণ্ডা অবস্থায় আদায় কার উত্তম। মহানবী (সা.) এর সাহাবি আবু যার আল গিফারী (রা.) বলেন:

একবার মহানবী (সা.) এর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। যোহরের সময় হলে মুয়াজ্জিন আজান দিতে চাইল। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: ঠাণ্ডা করো অর্থাৎ-দেরী করো। এরুপ তিনি দু’অথবা তিনবার বললেন। তখন আমরা দেখলাম যে, ছোট ছোট ঠাণ্ডা অবস্থায় আদায় করো। (সহিহ বুখারি-হা: ৫৩৯)

আসর সালাতের সময়:
আসরের সালাত শুরু হয় যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয় এবং শেষ হয় সূর্যাস্তের ঠিক পূর্বমূহর্তে। অর্থাৎ-সূর্যাস্তের পূর্বে রক্তিমবর্ণের সময় পর্যন্ত আসর সালাত আদায় করা জায়িয আছে। (সুনান আবু দাউদ-হা: ৩৯৩, জামি আত তিরমিযী-হা:১৪৯)

আসর সালাত প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) এর কয়েকটি হাদিস নিম্নে প্রদত্ত হলো- 

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহাবি আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন:
(১) সূর্য যখন আকাশের উচ্চতায় প্রদীপ্ত থাকত। তখন মহানবী (সা.) আসরের সালাত আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে সালাত আদায় করে অনেক সাহাবি মদিনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাদের নিজের প্রয়োজনে বা নিজের ঘরে ফিরে যেত। আর যখন তারা সেখানে ফিরে যেত তখন সূর্য অনেক উপরে থাকত। কোনো কোনো এলাকা মদিনা থেকে প্রায় ৪ মাইল অর্থাৎ-৭ কি.মি.দূরে অবস্থিত ছিল। (সহিহ বুখারি-হা: ৫৫০)

যারা ইচ্ছাকৃতভাবে আসরের সালাত দেরী করে আদায় করে, তাদের এ সালাত আদায় মুনাফিকের সালাত আদায়ের মতো। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন:
(২) ওই সালাত হলো মুনাফিকের সালাত, যে বসে বসে সূর্যের প্রতি তাকাতে থাকে। আর যখন তা অস্তপ্রায় হয়ে যায় এবং শয়তানের দুই শিং এর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান করে, তখন উঠে গিয়ে চারবার ঠোকর মেরে আসে। এভাবে সে মহান আল্লাহকে কমই স্বরণ করতে পারে। (সহিহ মুসলিম-হা:৬২২/১৯৫, মিশকা-তুল মাসা-বীহ হা: ৫৩৯)

রাফি ইবনু খাদীজ (রা.) বলেন:
(৩) আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে আসরের সালাত আদায় করতাম। তারপর উট যবেহ করে তার গোশত দশ ভাগে ভাগ করা হত। অতঃপর সে গোশত রান্না করে সূর্যাস্তের পূর্বে খেতে পারতাম। (সহিহ বুখারি-হা: ২৪৮৫, সহিহ মুসলিম-হা: ৬২৫/১৯৮)

অপর হাদিসে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন:
(৪) যে ব্যক্তি সূর্যাস্তের পূর্বে আসরের এক রাকাত পেয়ে যায়। সে আসরের সালাত পেয়ে গেল। (সহিহ বুখারি-হা: ৫৭৯, সহিহ মুলিম-হা: ৬০৮, মিশকা-তুল মাসা-বীহ-হা: ৬০১) ।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ