• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

গণমুক্তির আন্দোলন এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নজরদারি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০১৯  

যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি বাহিনীর হাতিয়ার ছিল প্রোপাগান্ডা (গুজব ছড়ানো) ব্যবস্থা। যার যোগ্য সঞ্চালক ছিলেন হিটলারের প্রোপাগান্ডা ব্যবস্থার প্রধান গোয়েবলস। অবশ্য এই গুজব ছড়ানোর কাজে পশ্চিমারাও কম যান না। যেমন, ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র আছে, আমেরিকার এই এক গুজব ধোঁয়ায় মিসমার হয়ে গেল এক জাতি রাষ্ট্র। কিন্তু শেষতক দেখা গেল সবই ছিল সাজানো নাটক। নিজেদের অর্থনীতির বাজার হাতিয়ে নেয়ার ছক।

গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে বাংলাদেশেও বেশ কট্টরভাবে বয়ে চলেছে এই মহামারী। বাংলায় যার নাম গুজব। এই আলোচনার ব্যাপ্তিফল বাড়ানোর পূর্বে একটি প্রবাদ বলি, ‘হুজুগে বাঙালী’। যার অর্থ দাঁড়ায় সামান্য উস্কানিতে যে কোন অঘটন-ঘটাবার রেওয়াজ বাঙালীর মজ্জাগত। আর তাছাড়া সংস্কৃতির ইতিহাস বলে, প্রবাদ-প্রবচন হলো যে কোন জাতির মানুষের আচরণগত সামষ্টিক ফলাফল।

সম্প্রতি প্রোপাগান্ডা বা গুজবে ভর করেই কিছু নৃশংস ঘটনা ঘটেছে দেশে। যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের মূল্যবোধের ঘাটতি, সামাজিক অস্থিরতা এবং বেদনাদায়ক অসংখ্য সিরিজ মৃত্যু। কিন্তু হঠাৎ-ই কেন এই সিরিজ সন্ত্রাস বা অস্থিরতা? এর পেছনের বহুমাত্রিক গল্পগুলো আসলে কি? সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা সামাজিক সন্ত্রাস। আর রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা কারও সুদূরপ্রসারী ম্যান্ডেট। তবে তাৎপর্যগত দিক হলো, রাষ্ট্রযন্ত্রকে দুটো বিষয়কেই মোকাবেলা করতে হবে ভিশনারি রোডম্যাপ দিয়ে।

প্রথমটির মহাঔষধ ‘পারিবারিক শিক্ষা’। যদিও দুই শব্দেই বলা হয়ে যায় সমাধান। তবে একে বাস্তবায়ন করতে সরকারকে পড়তে হবে পদে পদে তোপের মুখে। কারণ এখনও এই সমাজে স্বামী বউকে পেটালে সরকার ব্যবস্থা নিতে গেলে বলে ‘আমার বউরে আমি পিটাই সরকারের কি’? আবার ওই লোকটি তার বউ অসুস্থ হলে সরকার কেন দেখছে না, সেই বিষয়ে প্রশ্ন তোলে। অর্থাৎ, এখানকার মানুষের মনের ভৌগোলিক চিত্র জোয়ার-ভাটার মতো। কাজেই এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রকে হতে হবে কঠোর এবং প্রীতিহীন।

এই অঞ্চলে বহু বাবা-মা আছেন, যারা স্কুলে টিফিনটাই তার সহপাঠীর সঙ্গে ভাগ করে খেতে শিক্ষা দেন না। পরীক্ষায় প্রথম হলে এটা-ওটা কিনে দেবেন এই ধরনের লোভনীয় মুনাফা ধরিয়ে দেন বাচ্চাদের সামনে। পাশের বাসার ওই সন্তানকে হাতি মেরেছে অথচ তার সন্তান মশাও মারতে পারেননি! এই কষ্টে নিজের সন্তানকে মানসিক-শারীরিক নির্যাতন করেন। অর্থাৎ অসহনশীল এবং লোভের ভেতর দিয়ে বাবা-মাই বড় করে তোলেন তার সন্তানকে।

তাছাড়া পারিবারিক এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রতিযোগিতার মনোভাব সেই বাবা-মার হাত ধরে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের চোখে মুখেও। যার প্রামাণ্য দলিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। কে কার আগে একটি তথ্য জানে ও জানাবে সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। যার কারণে বিশেষ ব্যক্তিদেরও কয়েকবার মিথ্যা মৃত্যুবরণ করতে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।

রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন্দ্রবিন্দু ‘পরিবার’। এখন নিজেদের প্রশ্ন করলেই হয়, অভিভাবক হিসেবে পরিবারে আমাদের মানসিক এবং সামাজিক শিক্ষা-সংস্কার কতটুকু? আর তাতেই মিলে যাবে সমকালীন সময়কার সামাজিক নৃশংসতা এবং অসহনশীল আচরণের হিসাব।

অন্যদিকে রাজনৈতিক মেরুকরণে বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নে ‘বাংলাদেশ’ এখন বিশ্ব নেতৃত্বের দাবিদার। অর্থনৈতিক মুক্তিতে বিশ্ব ব্যবস্থার উদাহরণ। পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতির ক্ষমতার মেরুকরণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এশিয়ার নতুন সমৃদ্ধ সারথী। যার রয়েছে মুক্তবাজার, গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করবার সুযোগ এবং সস্তা শ্রমিক। কাজেই এখানকার মার্কেট এখন বিশ্বের অনেকের গড় চাহিদার অংশ।

কাজেই এখানকার সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোকে অস্থির করতে পারলেই অনেক বিনিয়োগকারী এখান থেকে মুখ সরিয়ে নেবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে এই রাষ্ট্র পিছিয়ে পড়বে। তখন আবারও হাত পাততে হবে এই রাষ্ট্রকে। যা স্বার্থ অনুগত হয়ে যাবে বৈদেশিক বেনিয়াদের। ফলে অবাধে নিজেদের সুবিধা মতো বেনিয়াবৃত্তি বা ব্যবসা করতে পারবে ওইসব উপনিবেশিক এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষমতালোভীরা।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যখন বৈদেশিক বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার দোহাইয়ে চলে যাবে তখন বন্ধুহীনতার কারণে সুযোগসন্ধানী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেই অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে বাধ্য হবে বাংলাদেশ। এতে তাদের অর্থাৎ ভিনদেশী সুযোগসন্ধানীরা লাভবান হতে পারবে নিজেদের স্বার্থকে গুরুত্বে রেখে। অর্থাৎ, প্রভুত্বের ঘানি টানবে দেশ।

আর তাই দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া কয়েক প্রান্তের মানুষ। তার প্রমাণ যখন যে অঘটনগুলো ঘটছে, তা বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হলেও চলছে সিরিজ আকারে। বিগত তিন-চার মাসের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যায়, প্রথম মহামারী সামাজিক সন্ত্রাস ছিল ধর্ষণ। যাকে রূপায়িত করা হয়েছে নানা কায়দায়। কখনও বাসে, কখনও পরিত্যক্ত বদ্ধ জায়গায় এবং তা নানা বয়সের ব্যবধানে। শুধু তাই নয়, শেষতক একে রূপ দেয়া হয়েছে নানা কায়দার নৃশংস হত্যায়।

আবার কিছুদিন ধরে চলেছে দেশের স্পর্ধা এবং শেখ হাসিনার চেষ্টা ‘পদ্মা সেতুকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে মানুষের মাথার গুজব। রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলা এই প্রোপাগান্ডা বা গুজবকে যখন বাঙালী প্রতিহত করেছে চমৎকারভাবে, তখন আরেকটি সিরিজ সামাজিক সন্ত্রাস শুরু হয়েছে ‘ছেলে ধরার নামে’ পিটিয়ে মানুষ হত্যার। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো অবিবেচকভাবে কিছু ‘হুজুগে বাঙালী’ দেশী-বিদেশী সেই সামাজিক অস্থিরতা ও ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়ন করে চলেছে উন্মত্তার বসে।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজন পুরো বিষয়গুলোকে ময়নাতদন্তের আদলে নজরদারির। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই হতে পারে সরকার এবং রাষ্ট্রকে বিপাকে ফেলার জন্য প্রশিক্ষিত এজেন্টরা ‘নাটকের দুর্বিনীত’ ফর্ম ‘গেরিলা নাট্য’কে ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ, ঝটিকায় একজন মানুষকে টার্গেট করে তার ওপর উৎসুক মানুষদের উস্কে দিয়েই সরে যাচ্ছে। আর তাতেই সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক সন্ত্রাস এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষয়। অর্থাৎ, এটা স্পষ্টতর যে উন্নয়ন এবং গণমুক্তির সংগ্রাম চালানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের চ্যালেঞ্জ বহুমুখী।

লেখক : প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ