• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

গোপালগঞ্জ জেলার পর্যটন অঞ্চল/দর্শনীয় স্থান সমূহ

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৫ মে ২০১৯  

প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত গোপালগঞ্জ জেলায় রয়েছে বহু দৃষ্টিনন্দন স্থান। এসব স্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করা হল- বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য টুঙ্গিপাড়া মধুমতি নদীর তীরে পাটগাতির পরেই টুঙ্গিপাড়া। কোনো কবি এখানে এলে রূপসী বাংলাকে স্বচক্ষে দেখতে পারেন-ই। তখন কবির কাব্যে প্রকৃতি নতুনতর রূপে অঙ্কিত হবে। কবি আলাদা এক জগৎ সৃষ্টি করবেন। টুঙ্গিপাড়ার গাঁয়ের মেঠো পথের পারে চোখে পড়বে বিল-ঝিল। আর সেখানে ফুটে রয়েছে কত না শাপলা। টগর-কামিনী ফুলের গন্ধেও মাতোয়ারা হতে হয় তখন। এই টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামনের সমাধি। এখানে ঢুকতেই পাথরের গায়ে লেখা রয়েছে_"দাঁড়াও পথিক বর যথার্থ বাঙালি যদি তুমি হও। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে। এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। এ দেশের মুক্তিদাতা, বাংলার নয়নের মণি" এই কথাগুলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমানের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা ডাকতেন 'খোকা' বলে। তাঁর শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। জীবনভর তিনি দুঃখী মানুষের পাশে থেকে সংগ্রাম করে গেছেন। পাকিস্তানীদের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে বার বার তিনি কারাগারে গিয়েছিলেন। তবুও বাংলার মানুষের পাশেই ছিলেন তিনি। ১৯৬৮-৬৯ সালে শেস্নাগান উঠল_'আগরতলার ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা মানি না', 'শেখ মুজিবের মুক্তি চাই'। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি প্রায় দশ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের ঐ ভাষণে তিনি বাঙালির মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানান। এই ভাষণে তিনি বললেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।" ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাঙালির এই অবিসংবাদিত নেতাকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়া। নির্জন নিরিবিলি উপজেলা শহর এখন। এখানে চারদিকে গাছগাছালি, ফল ও বিল। যেন ছবির মতো সাজানো এই টুঙ্গিপাড়া। বঙ্গবন্ধুর সমাধির পাশেই তাঁর বাড়ি। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তাঁর সমাধি ও বাড়ি দেখে কী মনে পড়বে না_"নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই'। টুঙ্গিপাড়ার সবুজ শ্যামল মায়ায় মোহিত হওয়ারই কথা। ওখানে মানুষ কত না সহজ-সরল। কয়েক মিনিট বাক্য বিনিময় হওয়ার পরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে যে সময় লাগে না। ধান ক্ষেত দেখে বলবেন, 'এখানে যে সোনা ফলে'। কল্পনায় ভাসবে, ঐ যে বাড়ি-ঘর ওখানে বুঝিবা এক জোতদার বসবাস করেন। ওনার বাড়িতে গরু, মহিষ আছে। গরু, মহিষ দেখাশোনার জন্য এক রাখাল ছেলেও যে আছে। ওর নাম 'কৃষ্ণ'। দারুণ বাঁশি বাজায়। বাস্তবেও এখানের বিল-ঝিলের পাশে রাখাল ছেলের বাঁশির সুর শুনে ও তাকে দেখে মনে পড়বেই কানন দেবীর গাওয়া-"রাখাল ছেলে বাঁশি বাজায়/ বাঁশি বাজে আর বাজে" গানের এই কথাগুলো। সত্যিই এক ভালোলাগা আর নির্জনতা খুঁজে পাওয়ার এক মনোরম স্থান এই টুঙ্গিপাড়া। কয়েকদিন বেড়িয়ে এখানে প্রবল শান্তি ও মেলে। ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি কাশিয়ানী থানার একটি ইউনিয়ন ২৩০২১র্ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯০৪৯ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এর অবস্থান। ওড়াকান্দি মিড হাই স্কুল (১৯০৮) এ- অঞ্চলের প্রাচীন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডাক্তার মিড নামের একজন খ্রিস্টান মিশনারি। ১৮৮০ সালে গুরম্নচাঁদ ঠাকুর এখানে যে পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন তাই পরবর্তীতে হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। নমঃশূদ্রসহ নিমণবর্গের উত্থানের কেন্দ্রীয় চরিত্র লাভ করে। এই গ্রামের ভীষ্ণদেব দাস নিমণবর্ণের প্রতিনিধি হিসাবে প্রথম বাংলার আইন পরিষদে প্রবেশ করেন নমঃশূদ্র সমাজের প্রথম দুই ব্যারিস্টার পি.আর. ঠাকুর ও সুরেশ বিশ্বাস (কবি) এই গ্রামের সমত্মান। ড. ভগবতী প্রসন্ন ঠাকুর বিলেতে পি.এইচডি করেন। অমূল্য দাস বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার। এখানে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশন আছে। ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষাত নমঃশূদ্র হিন্দু এই ইউনিয়নে বাস করে। শ্রী শ্রী হারিচাঁদ ঠাকুরের লীলাক্ষেত্র এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের মহাতীর্থ হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি পবিত্র স্থান। প্রায় দুইশত বছর আগে ১২১৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে ওড়াকান্দির পার্শ্ববর্তী সাফলিডাঙ্গা গ্রামে শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ডাক্তার মিড মিশনারি ছেড়ে হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র দেব ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং শ্রীধাম ওড়াকান্দি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মের লোক এই মতুয়া ধর্মালোন্দলনে শরিক হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষিণাঞ্চলের শরনার্থীরা এখানে এসে আশ্রয় নিত। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মুক্তাঞ্চলের হেডকোয়ার্টার ছিল এই ওড়াকান্দি গ্রামে। এখানে একটি ট্রেনিংক্যাম্প ছিল, যাঁর নেতৃত্বে ছিলেন নূর মুহম্মদ ক্যাপ্টেন বাবুল (ফরিদপুর)। কিভাবে যাওয়া যায়: উপজেলা সদর হতে ৩০ কিঃ মিঃ পূর্ব দিকে অবস্থিত এ ইউনিয়নে উপজেলা সদর হতে তিলছড়া বাসস্ট্যান্ড হতে পূর্ব দিকে বাইপাস সড়ক দিয়ে খাগড়াবাড়ীয়া-আড়ুয়াকান্দি-ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ী জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ী ভাটিয়াপাড়া মধুমতি তীরস্থ একটি ঐতিহাসিক স্থান। মধুমতি থেকে উৎপত্তি চন্দনা-বারাশিয়া নামের এক শীর্ণকায় নদীর। ভাটিয়াপাড়া থেকে এই নদীর পূর্ব পাড় দিয়ে এক কিলোমিটার উত্তরে ছোট কাচা রাস্তা পূর্ব দিকে চলে গেছে। শেষ হয়েছে কাশিযানী পুরানো রেল স্টেশনে। জানা যায় জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের পদরেনুতে ধন্য ছিল এই কাচা রাস্তাটি। পূর্ব-পশ্চিমমুখী রাস্তাটির নদীর পাড় থেকে পূর্ব দিকে সামান্য এগুলেই চোখে পড়বে ডানপাশে বিশালাকৃতির পুকুর আর বামপাশে জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ি। ইংরেজী U-প্যাটার্ণের দক্ষিনমুখী বাড়িটি তৎকালে সবার নজর কাড়ত। নয়নাভিরাম এই বাড়িটির মধ্যঅংশ ছিল দ্বিতল বিশিষ্ট এবং তারই লাগোয়া দুপাশে ছিল একতলা বিশিষ্ট ভবন। সাদা রঙের জমিদারি ভবনটি মোটামুটি সুরক্ষিত ছিলবলা যায়। প্রাচীর বেষ্টিত বাড়ির পিছনে তিনদিক থেকে ছিল বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। বাড়িটির বামপাশে ছিল একতলা ভবন বিশিষ্ট মন্দির এবং ডান পাশে ছনের ছাউনি দিয়ে কাচাড়ী।দৃষ্টিনন্দন বলতে যা বোঝায় তার কোন অংশেরই কমতি ছিল না এই বাড়িটিতে। জমিদার বাড়ির বিশালাকার পুকুরটি ছিল সুশোভিত। শান বাঁধান পুকুরটি নিঃস্বার্থভাবে সেবা দিয়েছে জমিদার বাড়িকে, এলাকার জনগণকে।এখন আর সেই কাচা রাস্তাও নেই, নেই সেই জমিদার বাড়িও। পরিচিতি গেছে পাল্টে। এখন শুধু এটুকুই পরিচয় কাশিয়ানী এম.এ খালেক সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ কাশিয়ানী এম.এ খালেক ডিগ্রী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষের বাড়িটিই তখনকার জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ির ভিটা। কিভাবে যাওয়া যায়: ভাটিয়াপাড়া থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে ছোট কাচা রাস্তা পূর্ব দিকে জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়। অন্যন্যা চন্দ্র ঘাট গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা সংলগ্ন দীঘিতে ১৯৫৮ সালে একটি ঘাটলা নির্মাণ করা হয়। তদানিন্তন সার্কেল অফিসার (সি, ও, ডেভঃ) জনাব এস এম এ কাশেম বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে নগদ ৩,০০০/- টাকা পুরস্কার পান এবং ঘাটলা নির্মাণের জন্য তিনি পুস্কারের অর্থ দান করেন। উক্ত দানের অর্থ দিয়ে তার স্মৃতি রক্ষার্থে দীঘি সংস্কার কমিটি অনন্যা চন্দ্রা নাম সূচক সুদৃশ্য ঘাটলা নির্মাণ করেন। ঘাটলার বাদিকে গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউজ এবং ডানদিকে বেদনা বিধুর ’৭১ এর বধ্যভুমি অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ এর চারপাশ। বধ্য ভূমি স্মৃতি সৌধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা সংলগ্ন ৭১ এর বধ্যভূমি (জয়বাংলা পুকর) হচ্ছে এলাকাবাসীর স্মৃতি বিধুর স্থান। শত শত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী বাঙ্গালীর আত্মহুতির নীরব সাক্ষী এ বধ্যভুমি। এখানে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সমর্থকদের ধরে এনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হতো। পাকবাহিনী কর্তৃক জয়বাংলা পুকুর নাম করণ করে সেখানে মৃত দেহ টেনে হেচড়ে ফেলা হতো আর জয় উল্লাস করা হতো। ১৯৭২ সালে বাঙালী জাতির প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় যা পরবর্তীতে দুস্কৃতিকারীরা ধবংস করে ফেলে। অতপর আলহাজ্ব সাইদুর রহমান (চানমিয়া) দীর্ঘ দিন চেষ্টার পরে তৎকালীন মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব সা জ ম আকরামুজ্জামান এবং সদর উপজলো নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ সাইফুল ইসলাম ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করেন।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ