• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

গোপালগঞ্জে ভাসমান পদ্ধতিতে উৎপাদিত হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০২০  

বিলবেষ্টিত গোপালগঞ্জের জলাশয়ে উৎপাদিত হচ্ছে ভাসমান পদ্ধতিতে বিষ মুক্ত সবজি। কোনো প্রকার কীটনাশক বা রাসায়নিক সার ব্যবহার না করেই এসব কৃষকরা ফলাচ্ছেন বিভিন্ন প্রকার সবজি। এসব সবজি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন তারা। ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ এটাই প্রথম নয়। এই চাষ হয়ে আসছে শতবছর আগের থেকে। বংশ পরমপরায় বর্ষা মৌসুমে ধাপের ওপর চাষাবাদ করে আসছে গোপালগঞ্জের বিল এলাকার বিভিন্ন গ্রামের হাজারও পরিবার। 

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, গোপালগঞ্জের পাঁচ উপজেলায় ধাপে সবজি চাষ করছে প্রায় তিন হাজার পরিবার।  তারা বিলের কচুরিপানা দিয়ে প্রায় বিশ হাজারটি ধাপ তৈরি করে সেখানে চাষ করছে, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙ্গে, লালশাক, পুঁইশাক, কড়লা, বরবটি, শশা, ঢেড়শ, হলুদসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি। এসব সবজিতে কোনো প্রকার রাসয়নিক সার বা কিটনাশক দেওয়া হয় না বলে দাবি কৃষি বিভাগ ও চাষিদের।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের পাঁচ উপজেলার মধ্যে টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলার ধাপের উপর বেশী চাষ হয়ে থাকে। এসব এলাকা একদিকে যেমন নিম্ন জলাভূমি বেষ্টিত ও মাটি এবং পানিতে লবণাক্ততা। এই কারণে কচুরীপানা দিয়ে তৈরি ধাপ পদ্ধতির মাধ্যমে এখানকার কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের শাক-সব্জি উৎপাদন করে থাকে। তাতে ফলনও ভালো হয় আবার প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবেলা করে অধিক ফলন পাচ্ছে। এতে এলাকার সব্জির চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি নিজেদের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি করতে পারছেন চাষিরা।

বিশেষ করে অতি সম্প্রতি বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে সব্জি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হলেও ধাপের উপর চাষ করা সব্জি কিন্তু নষ্ট হয়নি। এসব চাষীরা এখন ভালোদামে তাদের সবজি বিক্রি করছে। 

টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বন্যাবাড়ি গ্রামের বরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, বর্ষা মৌসুমে আমাদের এলাকায় কোনো কাজ থাকে না। তাই বিলে জম্মে থাকা কচুরিপানা দিয়ে বেড তৈরি করে লাল শাক, পুইশাক, ঢেড়শ, মিষ্টিকুমড়া, শশাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে থাকি। এই দিয়েই আমাদেও পরিবারের খরচ চলে। বন্যা হলেও আমাদের কোনো ক্ষতি হয় না। যতই পানি হোক না কেন সবজি নষ্ট হয় না।

তিনি আরো বলেন,আমাদের ৩৪টি বেডে ঢেড়শ গাছ আছে। গাছে ফল এসেছে। একদিন পর একদিন দুই থেকে তিন হাজার টাকা বিক্রি করে পাচ্ছি। ফলনও খুব ভালো হয়েছে। বেডে আমরা যে সবজি চাষ করি তাতে কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করি না। ধাপে যে সার হয় তাই দিয়েই এই চাষ। 

শুধু বরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসই নয় টুঙ্গিপাড়া উপজেলার মিত্রডাঙ্গা গ্রামের শক্তি কীর্ত্তনীয়া, বন্যাবাড়ি গ্রামের ভূপতি বিশ্বাস, সুব্রত মন্ডল, মো. মান্নান শেখ, হিরামন বিশ্বাস, সুশান্ত বিশ্বাসসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আমাদের এলাকায় একবার ফসল হয়। বাকি সময়টা থাকে পানিতে নিম্মজিত। তাই কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান চাষ করি। শুকনার সময় এসব ধাপ উঁচু জমিতে নিয়ে বিছিয়ে দিই এবং শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, মরিচ , লাউ, পালংশাক, লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের চাষ করি। এর উপরই এলাকার দরিদ্র মানুষ জীবিকা নির্বাহ করি।

তারা আরো বলেন, বাপ দাদার আমল থেকেই ধাপ তৈরি করে সবজি চাষ করে আসছি। এই সময় ২০ টাকা খরচ করলে তাতে ৪০ টাকা আয় হয়। বংশ পরমপরায় এই চাষ হয়ে আসছে। তারা বলেন, এই চাষে আমরা বাইরের কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করি না। কচুরিপানায় যে জৈবসার তৈরি হয় তার উপরই চাষাবাদ করি। দেশের মানুষ জানে কচুরিপানায় ভালো জৈবসার হয়। তাই এলাকার মানুষ দাম বেশী হলেও সবজিগুলো ভক্তি করে কিনে খায়।

এ ব্যপারে গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, গোপালগঞ্জে এ বছর অন্তত বিশ হাজারটি ধাপের ওপর চলছে ভাসমান সবজি চাষ। আর এর সাথে জড়িত রয়েছেন দুই সহস্রাধিক কৃষক। এ সময়ে নিম্ন জলাভূমি এলাকার মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না। ধাপের উপর সবজি চাষ করে তারা ভালোই আছেন।

তিনি জানান, বন্যা আসুক আর বৃষ্টি-বর্ষা আসুক না কেন, এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা সব্জিতে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। তাছাড়া কীটনাশক ও সারবিহীন উৎপাদিত এই সব্জি এলাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রীয়। তাই কৃষকেরাও সব্জি বিক্রি করে বেশ ভালো আছেন এ সময়টাতে।

তিনি আরো জানান, গোপালগঞ্জের ব্যাপক এলাকা নিম্ন জলাভূমি অঞ্চল। শুধু যে টুঙ্গিপাড়া বা কোটালীপাড়ায় ধাপ পদ্ধতিতে চাষ হয় তা নয়। জেলার বাকী উপজেলা যেমন কাশিয়ানী, মুকসুদপুর ও সদর উপজেলায় ও ধাপ পদ্ধতিতে চাষাবাদ হয়ে থাকে। এসব চাষিরা সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে এ জলাভূমিতে ধাপের উপর সব্জি চাষ করে জেলার কৃষকেরা ব্যাপকভাবে সাফল্য পেতে পারে। ঘটাতে পারে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ