• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

তাফসীর ও হাদিসের পর্যালোচনা: ধর্ম ও জীবন অনেক সহজ

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৫ জুন ২০২০  

ধর্ম আমাদের মনোভাব তৈরিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা বা ভুল চর্চায় একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। 

জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হোসেন আশকারি এক গবেষণায় দেখিয়েছেন সবচেয়ে বেশি ইসলামিক নৈতিক বিধান মেনে চলা দেশ হচ্ছে নিউজিল্যান্ড এবং দ্বিতীয় অবস্থানে লুক্সেমবার্গ। এরপর পর্যায়ক্রমে এসেছে আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড। মুসলিম দেশ মালয়শিয়া ৩৮তম, কুয়েত ৪৮তম, সৌদি আরব ১৩১তম অবস্থানে। গ্লোবাল ইকোনমিক জার্নাল (Global Economic Journal) এ প্রকাশিত এ গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থান সৌদি আরবেরও নিচে। 

গবেষণায় দেখা গেছে মুসলমানরা নামাজ, রোজা, সুন্নত, কোরআন তেলাওয়াত, হাদিস, হিজাব, দাড়ি, টুপি নিয়ে অতি সতর্ক এবং বেশি ব্যস্ত। কিন্তু রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে ইসলামের নির্দেশের ধার ধারে না।

কোরআন মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একমাত্র গ্রন্থ। কোরআনের একটি আয়াত তো দূরে থাক, একটি শব্দ নিয়েও মুসলমানদের মধ্যে কোনো সন্দেহ বা দ্বিমত নেই। এর কারণ কোরআনের সংরক্ষণ প্রক্রিয়া। প্রতিটি আয়াত নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবিরা তা মুখস্ত করে ফেলতেন, পাহাড়ের গায়ে পাথরের ওপর লিখে রাখতেন, নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন। এছাড়াও পেশাদার ওহি লেখক ছিলেন । যারা ওহি নাজিলের সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলতেন। সাহাবিদের মধ্যে কয়েক হাজার হাফেজ ছিলেন। এবং সব সাহাবিরই প্রায় অধিকাংশ কোরআন মুখস্থ ছিল। এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় তা নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তাফসির মূলত কোরআনের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ।

যুগে যুগে অনেক বিখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত, ধর্মতত্ত্ববিদরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণাদি বা ইসলামের মৌলিক চর্চার ওপর ভিত্তি করে কোরআনের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যা মানুষকে কোরআনের উচ্চতর জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। আর কোরআন কাব্যিক ছন্দ বা সাহিত্যিক রূপকথায় নাজিল হওয়ায় অনেক আয়াতের শাব্দিক অর্থ এর মর্মার্থ থেকে ভিন্ন। বিশেষজ্ঞদের মতামত হিসেবে এসব ব্যাখ্যা বিবেচনার যোগ্য হতে পারে কিন্তু চূড়ান্ত কিছু নয় এবং সব তাফসীরও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এটা নির্ভর করে তাফসিরকারকের প্রোফাইল এর ওপর। কিন্তু অনেকে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোরআনের তাফসিরকে কার্যত কোরআনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়। যেমন জামায়াতে ইসলামির লোকদের কাছে মাওলানা মওদুদীর তাফসীর চিরন্তন। এর কারণ এর তাফসীর তাদের রাজনীতির ভিত্তি। আর ধানক্ষেতে, বাড়ির পাশে প্যান্ডেল বানিয়ে আপামর জনসাধারণের জন্য যে তাফসীর মাহফিল আয়োজন করা হয়, তাতে প্রসিদ্ধ তাফসীর এর আলোচনার চাইতে বানোয়াট কিচ্ছা কাহিনীই থাকে বেশি।

হাদিস হচ্ছে নবীজির (সা.) কথা কাজ বা মৌন সম্মতি। কোরআনে নবীজির (সা.) জীবন ও কর্মের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং নবীজি (সা.) জীবন ও কর্মের বিবরণ কোরআনেই আছে। এর বাইরে হাদিস বলতে আমরা যা বুঝি, তা হচ্ছে সিয়াহ সিত্তাহ বা হাদিসের ৬ টি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ যা মূলত হাদিস সংগ্রহকারী বা সংকলকদের নামানুসারেই। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসাই এবং ইবনে মাজাহ। যাতে প্রায় লক্ষাধিক হাদিস আছে। তবে একই হাদিস বহুবার এসেছে কিন্তু বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য বিবেচনায় নিয়ে এ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আর এসব হাদিস গ্রন্থের উল্লেখ কোরআনে থাকার সুযোগ নেই। কারণ প্রথম হাদিস সংকলনকারী ইমাম বুখারীর জন্ম নবীজির (সা.) ইন্তেকালের প্রায় ৩০০ বছর পর উজবেকিস্তানে।

আমাদের দেশে মাদরাসায় প্রতি ক্লাসে ১০০ নম্বরের হাদিস বিষয়ে পড়ানো হয় যাতে উসুলে হাদিস বা হাদিসের মুলনীতি ও উৎস গবেষণা পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত আছে। হাদিসের একটা একাডেমিক পরিভাষা হলো খবর। খবর হলো একটা রেনডম ইনফর্মেশন, যেটা সত্যি হতে পারে, মিথ্যা হতে পারে আবার উদ্দেশ্যপ্রনোদিত হতে পারে। তাই খবর একটা জেনারেল ইনফর্মেশন, এভিডেন্স নয়।

হাদিস বিশেষজ্ঞরা হাদিসের যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন সহিহ হাদিস, দুর্বল হাদিস, জয়ীফ হাদিস বা fake-hadith। এসব মূলত উৎসের ভিত্তিতে করা। হাদিসের বিশুদ্ধতা নিয়ে অসংখ্য মত পথ। কেউ বুখারি এবং মুসলিম শরিফকে বিশুদ্ধ মনে করে এবং মুত্তাফাকুন আলাইহি বা রাওয়াহুশ শাইখাইন ট্যাগ দিয়ে এ হাদিসগুলোকে আলাদা করেছেন। আবার কেহ কেহ সিহাহ সিত্তার বাইরে বায়হাকী শরিফ সহ আরো অনেক হাদিস গ্রন্থকে সহিহ মনে করেন। ঐতিহাসিক ধারা বিবরণী বা উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে তাত্তিক বা পণ্ডিতদের জন্য হাদিস প্রযোজ্য হতে পারে কিন্তু এই হাদিস সর্বসাধারণের পালনের বাধ্যবাধকতা কতটুকু?

এ প্রসঙ্গে কয়েকজন মুহাদ্দেসের সঙ্গে আলোচনার সময়ে কিছু প্রশ্ন এবং এর উত্তর বা ব্যাখ্যা এ রকম- 

প্রথমত কোরআনে যেহেতু এসব হাদিস গ্রন্থের কোনো নির্দিষ্ট উল্লেখ নেই তাই এসব হাদিস পালনের বাধ্যবাধকতা কতটুকু? কারণ এসব নবীজির (সা.) বক্তব্য কিনা? তা আমরা শতভাগ নিশ্চিত নই। একটা উত্তর পাওয়া গেছে, নবীজি (সা.) হাদিসের কথা বলেছেন বিদায় হজের ভাষনে। প্রথমত বিদায় হজের ভাষণও তো একটা খবর। আর সেখানে নবীজি (সা.) তার সুন্নত অনুসরণের যে কথা বলেছেন তা কোরআনের বাইরের তো কিছু হতে পারে না। কারণ তখনও তো এসব হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয় নাই।

দ্বিতীয় জবাব, নবীর একটা দায়িত্ব মানুষকে ধর্মীয় রীতি নীতি শিক্ষা দেয়া। প্রথমত সে শিক্ষা কোরআনের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এর বাইরে কোনো নির্দেশনা আবশ্যক হলে নবীজি (সা.) নিজেই সেইসব লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নিতেন।

নবীজির (সা.) পর হাদিস সংকলনে সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য অবশ্যই চার খলিফা। হজরত আবু বকর (রা.), হজরত ওমর (রা.), হজরত উসমান (রা.) ও হজরত আলী (রা.) ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতেই এ চারজন ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং নবীজির (সা.) ইন্তেকাল পর্যন্ত এই চারজন ছায়ার মত সার্বক্ষণিক নবীজির (সা.) সঙ্গেই ছিলেন। হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত ওমর (রা.) ছিলেন নবীজির (সা.)  শ্বশুর। হজরত উসমান (রা.) এবং হজরত আলী (রা.) ছিলেন নবীজির (সা.) জামাতা। নবীজির (সা.) ইন্তেকালের পর এই চারজন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন।

হজরত উসমান (রা.) এর খেলাফতের সময় মুসলিম বিশ্বের আর্থিক কোষাগার ও বেশ সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা হাদিস সংগ্রহ, সংকলন বা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগই নেননি। তিনশত বছর পর ইমাম বুখারী ও অন্যান্যরা হাদিস সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝলেও নবীজি (সা.) এবং তার প্রধান সহচররা তা বুঝতে পারেননি? তদুপরি অনেক হাদিসের বর্ণনা নবীজির (সা.) জন্য মর্যাদাহানিকর আপত্তিকর এবং অশালীন। ধর্ম বিদ্বেষীরা এসব হাদিসের ভিত্তিতেই নবীজীকে (সা.) কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করে।

তৃতীয় উত্তরটি মূলত পাল্টা প্রশ্ন। হাদিস ছাড়া আপনি নামাজ পড়বেন কিভাবে? রোজা রাখবেন কিভাবে? কোরআনে তো এসবের কোনো স্পেসিফিকেশন নেই। তো - ইমাম বুখারীর আগে মুসলমানেরা নামাজ পড়েছে কিভাবে? আর কোরআনে সবিস্তার বিবরণী দেয়া নাই মানে আমরা এখন যেভাবে পড়ছি ঠিক এভাবে বলা নেই। তার অর্থ ঠিক এভাবেই পড়তে হবে এমনটা আল্লাহ উল্লেখ করেননি। কিন্তু আমাদের মাথায় কোনো জিনিস একবার বসানো হয়ে গেলে তার বিকল্প আর ভাবতে পারি না।

আর কোরআন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে হাদিস কি তা পারছে? নাহ! সে ক্ষেত্রে তৃতীয় পন্থা কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে কিয়াস বা অনুমান করতে হবে। এবং একেক জন আলেমের অনুমান একেক রকম। তাই চতুর্থ সমাধান হচ্ছে ইজমা এ উম্মত বা উম্মতের ঐক্যমত । কিন্তু এটা বাস্তবে হয়নি। কেউ ইমাম আবু হানিফার সঙ্গে একমত, কেউ ইমাম শাফেঈর সঙ্গে একমত। কেউ ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে একমত আবার কেউ আল্লামা শফীর সঙ্গে একমত। এভাবে মুসলমানেরা দলে দলে বিভক্ত।

আর হাদিসেই কি শেষ! এর বাইরে ফাজায়েলে তাবলীগ, ফাজায়েলে জিকির, ফাজায়েলে জিহাদ , বেহেশতী জেওর , নেয়ামুল কোরআন, মকসুদুল মোমেনিন, হাজারো বই। এবং এসব বইয়ে মনগড়া আমল, দোয়া, তাবিজ আর কিচ্ছা কাহিনীতে ভরপুর। এবং এগুলো আমাদের দেশে কোরআন এর চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। কারণ আমরা অলৌকিক কল্পকাহিনী শুনতে পছন্দ করি।

আর আমাদের প্রতিটা প্রশ্নের একটা উত্তর লাগবে। এবং সেই উত্তর থেকে আরো তিনটা প্রশ্ন বানাতে হবে। হুজুর! গরুর লেজ খাওয়া কি জায়েজ? জায়েজ হলে এটা সুন্নত না মাকরুহ। মাকরূহ হলে মাকরূহে তাহরীমী না হাকিকি। আর এভাবে সহজ সরল পথ কে আমরা কঠিন করছি।

পবিত্র কোরআনের সর্ববৃহৎ সূরা হচ্ছে সূরাহ আল বাকারা। বাকারা শব্দের অর্থ গরু। এ সূরায় গরু সম্পর্কিত দারুন শিক্ষনীয় একটা ঘটনার উল্লেখ আছে। এবং সে ঘটনার প্রেক্ষিতে এ সূরার নামকরণ। বনি ইসরাইলের অত্যন্ত ধনাঢ্য এবং নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তি গুপ্তঘাতকের হাতে খুন হয়। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা যখন এ খুনের কূলকিনারা করতে পারল না । তখন তারা হজরত মুসা (আ.)-কে এসে বলল, আপনি আল্লাহকে জিজ্ঞেস করে বলুন হত্যাকারী কে? হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কথা বলে এসে জানালেন যে তোমরা একটা গরু জবাই কর। এবং তার হাড্ডি দিয়ে মৃত লোকটাকে আঘাত কর। আর ওই লোক জীবিত হয়ে বলে দেবে, কে হত্যা করেছে? কেন করেছে এবং কিভাবে করেছ। খুবই সহজ ও নির্ভেজাল সমাধান।

কিন্তু এত বড় একটা জটিল সমস্যার এত সহজ একটা সমাধান ইসরাইলিদের পছন্দ হলো না। তারা একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল। গরু কি গাই গরু না বলদ গরু? গরুর বয়স কত? রং কেমন? শিং কেমন? আর হজরত মুসা (আঃ) আল্লাহর সঙ্গে কথা বলে এসে একে একে প্রত্যেক উত্তর দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল এই নির্দিষ্ট গরু খুঁজে পাওয়াই প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাদেরকে শুধু একটা গরু জবাই করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা জিনিসটাকে কঠিন করল। কারণ ওই যে বলে, ‘The most complicated skill is to be simple.’ তাই সহজ করে ভাবুন এবং অনুশীলন করুন । সহজ করে ভাবলেই দেখবেন, ধর্ম অনেক সহজ এবং জীবনও অনেক সহজ।

আমার এই আলোচনার কিছু অংশ আপনার কাছে বেশ চমৎকার অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত অতি প্রয়োজনীয় বলে মনে হতে পারে। আবার কিছু অংশ আপনার কাছে একেবারে অযৌক্তিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ষড়যন্ত্রমূলক বাতিল বলে মনে হতে পারে। আবার আপনার কাছে যে বক্তব্য অত্যন্ত যুক্তিসংগত মনে হবে সেটা আবার আরেকজনের কাছে পাগলের প্রলাপ বলে মনে হবে। এটা নির্ভর করে আপনি কোন মতের কড়া সমর্থক তার ওপর। আমি কোনো দল বা মতের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ এর ভিত্তিতে লিখছি না। এই লেখায় আমার কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নেই। আমি কোনো ধর্ম প্রচারক নই । আপনার কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবর্তন আনা আমার উদ্দেশ্যে নয় বরং সেটা সম্ভবও না।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ