• বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৩ ১৪৩১

  • || ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

ধর্ষণ, যৌনক্ষুধা এবং যৌন কেলেঙ্কারি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০১৯  

পত্রিকায় এক প্রতিবেদন দেখলাম, ‘ধর্ষণে নজিরবিহীন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ’। ১০০ দিনে ৩৯৬টি ধর্ষণ ঘটিয়েছে। এসব রেকর্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ৯৮ শতাংশই ঘটিয়েছে ভিকটিমের পরিচিত জন। সাধারণত ধরা হয় যে শতকরা ৭০ ভাগ ধর্ষণ মামলাই রেকর্ড হয় না। মানে থানায় অভিযোগ যায় না। মামলা হয় না বা থানা-আদালত-মিডিয়া কর্তৃক আরেক দফা ধর্ষণের ভয়ে ধর্ষিতের পরিবার বা ভিকটিম মামলা করে না। তাহলে চিন্তা করতে পারেন কী পরিমাণ ধর্ষণ বেড়েছে আমাদের সমাজে।

সমাজটা যাচ্ছে কোথায়! সমাজের বিনাশ কি অনিবার্য হয়ে উঠেছে? সমাজ নিয়ে যারা চিন্তা করেন, সমাজ নিয়ে যারা কাজ করেন- তারা এখন কী উপায় বের করবেন। সমাজকে তো বাঁচাতে হবে। সমাজ উচ্ছিন্ন হয়ে গেলে জাতির অস্তিত্বইতো বিপন্ন হয়ে যাবে। ইউরোপের সমাজে কোনও কুমারী নাকি পাওয়া মুশকিল। সম্ভবতো আমরা তো সে পথের পথিক হচ্ছি।

 রাষ্ট্র একদিকে বৈধতা দিচ্ছে, প্রশাসন আরেক দিকে হয়রানি করছে। তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করছে কিছু মিডিয়া। পতিতাসহ খদ্দর ‘ধরা পড়ার’ ছবি ছাপানো সমাজের সেই অন্ধকার দিককেই নির্দেশ করে। অথচ খাওয়ার খিদের মতো যৌন খিদেও ক্ষুধা। সুস্থ সমাজের জন্য সেই ক্ষুধাও নিভৃত করা প্রয়োজন 

অবশ্য ভার্জিনিটির ধারণা নিয়েও মতবিরোধ আছে। সেটি ভিন্ন বিতর্ক। বলা হয়, নারী ভার্জিন থাকে ‘বাই চয়েস’ আর পুরুষ থাকে ‘বাই চান্স’। মানে পুরুষ সুযোগের অভাবে কুমারত্ব রাখে আর নারী স্ব ইচ্ছায় কুমারিত্ব রাখে। এখন প্রশ্ন সমাজ ও রাষ্ট্র নারীকে স্বেচ্ছায় কুমারিত্ব বজায় রাখার নিশ্চয়তা দিতে পারছে কিনা। যারা জবরদস্তিতে কুমারিত্ব হারাচ্ছে বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তাদের রক্ষার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা কী?

সাম্প্রতিককালে ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাতকে যৌন হয়রানির বিচার চাইতে গেলে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট যেভাবে হেনস্থা করেছে বলে তদন্তে বেরিয়ে আসছে, যৌন হেনস্থাকারী তারই শিক্ষক যেভাবে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যেভাবে যৌন নিপীড়ক ওই শিক্ষক ও তার সাঙ্গাতদের পক্ষে কাজ করেছে– ধর্ষণ ঠেকানো এবং কারও কুমারিত্ব তার ইচ্ছায় বজায় রাখার ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্র কতটা নিশ্চয়তা দিচ্ছে- এরচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রমাণ আর হয় না।

মোল্লারা মতিঝিলে সমাবেশ করে কয়েক দফা দাবি দিলেন। নারীদেরকে পর্দার মাঝে থেকে চলতে বললেন। আমরা ‘তেঁতুল হুজুর’ বলে বিদ্রুপও করলাম। কারণ সেখানে নারীদের সম্পর্কে এমন সব কথা বলা হয়েছে তা এই সমাজে, এই কালে গ্রহণযোগ্য নয়। সভ্য সমাজে চলে না। আবার চিন্তা করেন, ঠাট্টা বিদ্রুপে সবাইকে যদি আমরা হালকা করে ফেলি, সমাজে যদি ওজনধার লোক না থাকে তবে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করবে কে?

অনিয়ন্ত্রিত সমাজ তো গতি হারিয়ে ফেলে। গতি হারা সমাজের কি কোনও উন্নতি আছে? ফলে দু’পক্ষকে নিজেদের দায়িত্ব এবং ওজন রক্ষা নিয়ে সচেতন হতে হবে। আল্লামা শফি হুজুর শুধু নারীকে পর্দা করার কথা বললে হবে না, পর্দানসীন নারীও যখন যৌন হয়রানির শিকার হন তখন উনাকেও রাস্তায় নেমে তার প্রতিবাদ করতে হবে।

ব্রিটিশের সমাজবাদী লেখক এডওয়ার্ড কার্পেন্টার ‘সিভিলাইজেশন, ইটস্ কজ্ অ্যান্ড কিউর’ নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছিলেন এক শতাব্দী আগে। তিনি তার বইতে বলেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেমন ক্রমাগত উৎপাদনক্ষম করে তুলছে সমাজকে, তেমনি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে তার আত্মসত্তা থেকে, প্রকৃতি ও পারিপার্শ্ব থেকে। ভেঙে চুরে দিচ্ছে মানব চরিত্রকে।’

ইন্টারনেট আধুনিক বিজ্ঞানের চরমতম বিকাশ। সমগ্র বিশ্বকে এক বিন্দুতে নিয়ে এসেছে। এখন দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে ইন্টারনেট ক্রাইমের ডিপো হয়ে উঠছে। কোনও অস্ত্র কোনও সুশৃঙ্খল লোকের হাতে থাকলে তখন এটা আত্মরক্ষার হাতিয়ার হয় কিন্তু কোনও উচ্ছৃঙ্খল লোকের হাতে সে অস্ত্র পড়লে আক্রমণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এখন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে সব আধুনিক প্রযুক্তিতে। নিয়ন্ত্রণহীন হলে সমাজের জন্য বিপদ ডেকে আনবে।

বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকা বেহাত হয়ে ম্যানিলার রিজাল ব্যাংকে চলে গেলো প্রযুক্তির কারণে। প্রযুক্তি মানুষের সুখ যেমন বাড়াবে আবার সেই প্রযুক্তিই মানুষের মাথা ব্যথার কারণও হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং যারা এসব উদ্ভাবন করছেন তাদের এসবের শৃঙ্খলা বিধানের নিয়ম কানুনও বের করে দিতে হবে।

আইনস্টাইন বৈজ্ঞানিক ছিলেন। বিজ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করে না, এটাই বিজ্ঞানের ধর্ম। আইনস্টাইন ‘ঈশ্বর ঈশ্বর’ বলতেন। না দেখে না শুনে আইনস্টাইনের মতো বৈজ্ঞানিক ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে গেলেন কেন? বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যে শৃঙ্খলার মাঝে চলছে সে শৃঙ্খলাই নাকি আইনস্টাইনের ঈশ্বর। শৃঙ্খলা ছাড়া চললে গ্রহ-উপগ্রহের সংঘাতে সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যেতো।

এখন সমাজ বিজ্ঞানীরা বা সমাজ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বিশৃঙ্খল সমাজ নিয়ন্ত্রণের কী উপায় বের করার কথা বলেন তা শুনতে হবে। তবে কঠোর হওয়া ভিন্ন অন্য কোনও উপায়ের কথা চিন্তা করা যাবে বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে একটা ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি একজন খ্যাতিমান সুশাসক ছিলেন। তার সময়ে তার রাজ্যের সীমানার মধ্যে ওজনে হের ফের করার এক রোগ ব্যবসায়ী সমাজকে পেয়ে বসেছিল এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না।

তখন আলাউদ্দিন খিলজি আইন করেছিলেন বাজারে বাজারে হঠাৎ হঠাৎ মনিটরিং হবে। ওজনে কম দেওয়ার কোনও বিষয় ধরা পড়লে যতটুকু কম প্রমাণিত হবে তাৎক্ষণিকভাবে তা দোকানীর শরীরের মাংস কেটে ক্রেতাকে পূরণ করে দেওয়া হবে। রাজ্যব্যাপী এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটার পর ব্যবসায়ীরা এত সতর্ক হয়ে গিয়েছিলো যে ঐতিহাসিকরা বলেন, দশকের পর দশক আর কখনও ওজনে কম দেওয়ার প্রবণতা ব্যবসায়ীদের মাঝে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশেও ধর্ষণ নিয়ে এমন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে মনে হচ্ছে। যারা নাবালক শিশুর সঙ্গেও যৌন কর্ম করতে উদ্দত হয়, তাদেরকে ধর্ষণ করে, এমন কী ধর্ষণের পর হত্যা করে- তাদের জন্য তো কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তির বিধান থাকা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতেও নারী ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। ভারতে ২০১২ সালে এক নারী বাস যাত্রীকে বাসের মধ্যে শ্লীলতাহানীর ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হয়েছে। দাবি উঠেছে ধর্ষকের লিঙ্গ ছেদন আইন প্রণয়নের।

অত্যন্ত বেদনাদায়ক সংবাদ হচ্ছে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর বিরুদ্ধেও তার অধীনস্থ চাকরিচ্যুত এক মহিলা কর্মচারী যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। অবশ্য গগৈ এক বিশেষ বেঞ্চে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন তার আদালতে বিশেষ কয়েকটা মামলার বিচার চলছে। এসব মামলায় তার অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য কোনও পক্ষ এ ষড়যন্ত্র করছেন।

যাক, সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বহু পরীক্ষা নিরীক্ষাও হয়েছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের স্বাভাবিক এবং সম্মতিপূর্ণ সম্পর্ককে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে আরও উদার দৃষ্টিতে নিতে হবে। কঠোর হতে হবে অসম্মতিপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পূর্বেও আমরা দেখেছি বড় বড় শহরে যৌনকর্মীদের পল্লী ছিল, তাদের লাইসেন্স ছিল। প্রয়োজনে মানুষ এসব যৌন কর্মীদের পল্লীতে যাতায়াত করতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার কুমিল্লা সেনানিবাসের সৈন্যদের জন্য গৌরিপুরে একটি যৌনপল্লী স্থাপন করেছিলো।

অনেকে হয়তো অবাক হবেন শুনে। স্থানীয় এনজিওদের পরিসংখ্যান মতে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে নারী যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। ২০১৬ সালে ইউএনএইড-এর হিসাব অনুসারে এটি এক লাখ ৪০ হাজার। ২০টির মতো যৌনপল্লী রয়েছে। সবচেয়ে বড় পল্লীটি রয়েছে দৌলদিয়ায়, যেখানে প্রায় ১৩০০ যৌনকর্মী আছে। টাঙ্গাইলের কান্দুপাড়া দ্বিতীয় বৃহৎ যৌনপল্লী, যেটির বয়স প্রায় ২০০ বছর।

সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ আইনগতভাবে যৌনপল্লী রেখেছে কিন্তু তার খদ্দেরদের দেখা হচ্ছে অপরাধীর চোখে। সেখানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং জোর করে কাউকে পতিতাবৃত্তিতে রাখা হয়েছে কিনা তার সঠিক মনিটরিং নেই। রয়েছে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা নিয়ে সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা রয়েছে পতিতাপল্লী নিয়ে প্রশাসনসহ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির।

রাষ্ট্র একদিকে বৈধতা দিচ্ছে, প্রশাসন আরেক দিকে হয়রানি করছে। তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করছে কিছু মিডিয়া। পতিতাসহ খদ্দর ‘ধরা পড়ার’ ছবি ছাপানো সমাজের সেই অন্ধকার দিককেই নির্দেশ করে। অথচ খাওয়ার খিদের মতো যৌন খিদেও ক্ষুধা। সুস্থ সমাজের জন্য সেই ক্ষুধাও নিভৃত করা প্রয়োজন।

অতীতে রাজনৈতিক কারণে এসব বৈধ যৌন পল্লীর ওপর আঘাত এসেছে। রাজনৈতিক নেতারা সস্তায় নাম কুড়াবার জন্য আর ধর্মপ্রীতি দেখানোর জন্য শুক্রবারে নামাজের শেষে মুসল্লীদের মিছিল নিয়ে গিয়ে অনেকস্থানে এসব যৌনপল্লী আক্রমণ করে উচ্ছেদ করেছে। নারায়ণগঞ্জের টান বাজারে বিরাট যৌন পল্লী ছিল। শামীম ওসমান এটা উচ্ছেদ করে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ শহরকে ভাসমান যৌনকর্মীতে ভরে দিয়েছেন। এখন ঢাকাসহ বড় বড় শহরে আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে পতিতালয় চালু আছে। থানা প্রশাসন এসব জানে এবং মাসোহারাও নেয়। পল্লী উচ্ছেদ করে সভ্যতা দেখাতে অসভ্যতার হাট বসানো হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ বিরাট নদী বন্দর। বন্দর থাকলেই জাহাজের সারেং সুকানি ম্যাকানিকসহ অন্যান্যদের জন্য যৌনপল্লী প্রয়োজন হয়। দুনিয়াজুড়ে এই নিয়ম। কারণ তারা দীর্ঘসময় ব্যাপী বাড়িঘর ছেড়ে জাহাজে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরেও অনুরূপ কাণ্ড আমরা দেখে থাকি। জাহাজ থেকে নেমেই জাহাজের ক্রুরা যৌনপল্লী খোঁজে।

এখন চট্টগ্রামে কিছু রিক্সাওয়ালা, দালাল তাদেরকে প্রাইভেট বাসায় নিয়ে যায়। আমার লেখা পড়ে কারও কারও মনে হচ্ছে যেন আমি যৌন পল্লীর পক্ষে ওকালতি করছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- ধর্ষণ, যৌন কেলেঙ্কারি নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়ে সমাজকে কেলেঙ্কারিতে জড়িত করার চেয়ে যৌনপল্লীতে সীমাবদ্ধ থাকা অনেক ভালো।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ