• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদকে নিয়ে ধন্দ

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০১৯  

যেকোনো বিষয়েই হোক না কেন, কোনো বঙ্গ তনয়ের (অথবা তনয়ার) বিশ্ববিজয়ের ঘটনা নাড়া দেয় প্রত্যেক বঙ্গ হৃদয়কে। সেই মতোই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কলকাতার বালিগঞ্জের ছেলে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বিজেপি বাদে বাকি সব দল-নির্বিশেষে (পশ্চিমবঙ্গের মানুষ) কয়েক দিন ধরে রীতিমতো আত্মশ্লাঘার মৌতাত উপভোগ করে চলেছে। সেটাই স্বাভাবিক। বিজেপির এক বঙ্গনেতা ও ওই দলেরই আরেক দিল্লি-মন্ত্রীর মিডিয়ায় দুই বেসুরো মন্তব্যেও এতটুকু ছন্দঃপতন হয়নি বাঙালির সেই গরিমা উপভোগের। যদিও নোবেল বিজয়ের পর মঙ্গলবার প্রথম তাঁর শহরে আগমন ঘিরে যতটা হৈচৈ প্রত্যাশিত ছিল, আদতে তা তেমন কিছুই হয়নি। বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার পথে ও শহরের অন্যত্র মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যুগপৎ অভিজিতের ছবিসংবলিত বেশ কিছু ব্যানার ছাড়া তেমন কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। কলকাতায় এসেছিলেন নেহাতই ব্যক্তিগত সফরে। মাত্র এক দিনের জন্য। ফলে তাঁকে নিয়ে মাতামাতিরও তেমন সুযোগ হয়নি কলকাতার। প্রবাসীসন্তান যেমন দেশে মায়ের কাছে ফেরেন, ঠিক তেমনই ছিল ঘটনাটা। তবে পার্থক্য হলো এই প্রবাসী বঙ্গসন্তান সদ্য নোবেল জিতে মায়ের কাছে ফিরলেন।

এর কারণটা কী? অভিজিৎ বিনায়ক সম্পর্কে এই নিস্পৃহতার পেছনে আপাতদৃষ্টিতে মনে হওয়া অন্যতম একটি কারণ হতে পারে এই যে জাতীয় অর্থনীতির মূল ক্ষেত্র সম্পর্কে গত কয়েক দিন সদ্য নোবেল পাওয়া অভিজিতের বিচ্ছিন্ন কিছু মন্তব্য থেকে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা বিরূপ ধারণা গড়ে ওঠা। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদেশিনী স্ত্রী অথবা তাঁকে ‘বামপন্থী’ বলে অচ্ছুত করে দেওয়া দুই বিজেপি নেত্রীর দুই মন্তব্যে আপামর দেশবাসী যে খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছে তা নয়। কিন্তু মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে এখনো পর্যন্ত টুঁ শব্দটি উচ্চারিত না হলেও মূলত বাম মানসিকতায় জারিত বঙ্গবাসীর কাছে মনে হয়েছে, যে লোকটিকে ভাবা হয়েছিল বাম ঘরানার অর্থনীতিবিদ হিসেবে, তিনি আদপে তা তো ননই; বরং তিনি হয়তো মূলত মার্কিন মতবাদের পৃষ্ঠপোষক। নোবেল বিজয়ের আগের কথা নিয়ে মানুষ খুব একটা ভাবিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু নোবেল বিজয়ের পর পরই তাঁর বেশ কয়েকটি মন্তব্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অর্থনৈতিক ভাবনার মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বড় রকমের প্রশ্ন চিহ্ন তুলে দিয়েছে।

তার মধ্যে প্রধান হলো দ্রুত অধোগতির দিকে ধাবমান ভারতীয় অর্থনীতিকে বাঁচাতে তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিদানের কথা। এক. তিনি বলেছেন, গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষের হাতে ব্যাংকিং পরিষেবার সুযোগ প্রসারিত করতে এই মুহূর্তে দরকার গোটা ব্যাংকব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরাষ্ট্রীয়করণ। (যদিও ব্যাংক বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যাংক সংযুক্তির বিরুদ্ধে মাত্র গতকালই সারা দেশে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করেছেন ব্যাংককর্মীরা। কাকতালীয় হলো এই ব্যাংক ধর্মঘটের দিনে নোবেল বিজয়ের পর গতকাল অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পদার্পণ ভারতের মাটিতে)। অভিজিৎ বিনায়কের দ্বিতীয় মন্তব্য, সব পাবলিক সেক্টর আন্ডারটেকিংয়ে অর্থাৎ যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের পরিপূর্ণ বেসরকারীকরণের। অভিজিতের এই দুই মন্তব্যে এই শহরের শুধু বুদ্ধিজীবী অংশই নয়, আপামর মধ্যবিত্তও যৎপরোনাস্তি হতচকিত। তাঁরা কিছুতেই এটা মেলাতে পারবেন না যে দিল্লি থেকে বিজেপির নেতৃস্থানীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল যাঁকে ‘বামপন্থী’ বলে গালমন্দ করেছেন, সেই মানুষটির মুখ দিয়ে এ রকম ‘দক্ষিণপন্থীসুলভ’ মন্তব্য কী করে বের হয়? তাঁর কথায় সাধারণ মানুষের মনে সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।

ভারতে ব্যাংকিং শিল্পের সংকটকে ভয়ংকর আখ্যা দিয়ে অভিজিৎ বলছেন, অবিলম্বে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সরকারের মালিকানা ৫০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে, যাতে কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনের নিয়ন্ত্রণ না থাকে। তাঁর যুক্তি, সরকারি নিয়ন্ত্রণ না সরলে ভিজিল্যান্স কমিশনের আতঙ্ক কাটবে না। ওই ভয়েই ব্যাংক কর্তারা ঋণ শোধ না হওয়ার তথ্য ধামাচাপা দিয়ে রাখছেন। কেউ একটা ঋণ শোধ করতে না পারলেও তাঁকে নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে পুরনোটির কিছুটা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য। অভিজিতের দাবি, এভাবে বিপদ ঠেকিয়ে রাখা যখন অসম্ভব হয়ে উঠছে, তখনই ভেঙে পড়ছে ব্যাংক।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিরূপ খবর সংবাদপত্রে দৃষ্টিগোচর হয়েছে উৎসাহী পাঠকদের। তা হলো, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের পর আয়োজিত সাংবাদিক বৈঠকে নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে অভিজিতের ভূয়সী প্রশংসা। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, মোদির দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা বেশ অভিনব। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের সংস্কার করতে চান তিনি। আমলাতন্ত্রকে আরো বেশি দায়িত্বশীল করে তুলতে চান তিনি। যাতে মানুষ আরো বেশি করে উপকৃত হয়। এখানেই না থেমে তিনি আরো মন্তব্য করেছেন, ভারতের মানুষের স্বনির্ভরতা বৃদ্ধিতে মোদীর প্রচেষ্টা সত্যিই উল্লেখযোগ্য।

সব মিলিয়ে নোবেল বিজয়ের পর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে যত মুখ খুলছেন, ততই ধন্দ বাড়ছে তাঁকে নিয়ে। এ ব্যাপার কোনো রাখঢাক না রেখেই অভিজিৎ নিজেই অবশ্য অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন,

কোনো ধরনের নীতির প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব নেই।

 

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ