• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

পাক সেনারা দেখে বলে এধার আও, বাইনচ্যুত কলা আচ্ছা হ্যাঁয়?

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯  

সাহসী গেরিলা যোদ্ধা মুন্সি জহুরুল হক। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য বীর প্রতীক (বার) পদক পেয়েছেন। বাড়ি তার শেরপুর জেলার শ্রীবর্দ্দী বাজারে। অসীম সাহস বুকে নিয়ে ১১ নং সেক্টরে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কখনো ছদ্মবেশে গেরিলা আক্রমণ, কখনো সম্মুখ যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত রাখতো পাক সেনাদের। পাক বাহিনীর ক্যাম্প জামালপুর গ্যারিসনে আত্মসমর্পনে সারেন্ডার লেটার নিয়ে গেলে তার পায়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাট দিয়ে মুখে আঘাত হেনে সবগুলো দাঁত ভেঙ্গে দেয়। সারেন্ডার লেটার বহনকারী মুন্সি জহুরুল হকের উপর নির্যাতনের খবরে বিক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনা ক্যাম্প চারদিক ঘিরে হামলা ও আকাশপথে যুদ্ধ বিমান হামলা শুরু করলে ১০ ডিসেম্বর সকালে সারেন্ডার করে পাক সেনারা। মুক্ত হয় জামালপুর। যুদ্ধাহত এই বীর সেনানী মুক্তিযুদ্ধে গর্ব গাঁথা বীরোচিত ঘটনা তুলে ধরে মুখোমুখি হয়েছিলেন।

দৈনিক গোপালগঞ্জ: মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে প্রস্তুতি কেমন ছিল, মুক্তিযুদ্ধে কেন গেলেন, কিভাবে গেলেন?

মুন্সি জহুরুল হক: বাঙালীদের উপর পাকিস্তানী সরকারের বৈষম্য আচরণে প্রতিবাদ মুখর হয়ে নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ডে শ্রমিকের চাকরিকালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেই। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় বাঙালীদের উপর পাকিস্তানী সেনাদের হামলার খবর নারায়ণগঞ্জে পৌঁছলে আমরা রাস্তায় গাছের গুড়ি ফেলে ব্যারিকেডের সৃষ্টি করি। ব্যারিকেড ভাঙতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাংক নারায়ণগঞ্জে প্রবেশের খবর পেয়ে ডকইয়ার্ডের অস্ত্রখানার তালা ভেঙ্গে ৩০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল লুট করে প্রতিরোধের চেষ্টা করি। ট্যাংক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে বন্দর এলাকায়। ২৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জ বন্দর ও শহরে তুমুল যুদ্ধের এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমার সঙ্গে থাকা থ্রি নট থ্রি রাইফেলটি বাইসাইকেলে বেঁধে সখিপুর-টাঙ্গাইল-জামালপুর হয়ে এলাকায় চলে আসি। পরবর্তীতে ১১নং সেক্টরের অধীনে জামালপুরের কামালপুর রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।

দৈনিক গোপালগঞ্জ: ট্রেনিং পেয়েছিলেন কোথায়?

মুন্সি জহুরুল হক: প্রথমে ১১নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ভারতের মেঘালয়ের তুরা জেলার মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে যোগাযোগ করি। রাস্তা-ঘাট ভাঙ্গা, বোমা মেরে ব্রিজ-কালর্ভাট উড়ানোর ১৫ দিনের ট্রেনিং নিয়েছি। পরে গেরিলা ট্রেনিং সম্পন্ন করি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ: যুদ্ধ করেছেন কোথায় কোথায়?

মুন্সি জহুরুল হক: চিলমারী, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর, কুড়িগ্রাম, কামালপুর ও জামালপুর শহরে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমাকে মুক্তিবাহিনী থেকে মিত্রবাহিনীতে স্থানান্তর করে। ব্রিগেডিয়ার সৎ সিং বাবাজী ও মেজর জেনারেল হযরত সিং নাগরার নেতৃত্বে নভেম্বরের প্রথম দিকে বকসীগঞ্জের কামালপুর এলাকায় মাইন পুতে গাড়ি উড়িয়ে পাকিস্তানী মেজর আইয়ুবকে হত্যা করি। ১৪ নভেম্বর কামালপুরের ঝড়াইপাড় এলাকায় তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৬টি গাড়ি বিধ্বস্তসহ ১শ’ ১২ জন পাকিস্তানী সেনাকে মেরে ১৩ জনকে ধরে নিয়ে কর্ণজোড়া বাজারে টানিয়ে মেরেছি। আরো অনেক ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ: উল্লেখযোগ্য গেরিলা তৎপরতা।

মুন্সি জহুরুল হক: ১০টি কলা চুনে চিহ্নিত রেখে ৩০টি কলার মধ্যে পয়জন মিশিয়ে কলার ফেরিওয়ালা সেজে গাইবান্ধা ট্রেজারিতে যাই। সেখানে উপস্থিত পাক সেনারা আমাকে দেখে বলে এধার আও, বাইনচ্যুত কলা আচ্ছা হ্যাঁয়? আমি বললাম আচ্ছা হ্যাঁয়। আমাকে কলা খেতে বললে আমি চুন চিহ্নিত খাওয়ার পর তারা কলা নিয়ে যায়। সেখানে ১৫ মিনিট অপেক্ষার পর সেনারা এসে কলার দাম না দিয়ে পাছায় লাথি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। আমি দুই কিলোমিটার দুরে গিয়ে অবস্থান নেয়। পরে খবর পাই, কলা খেয়ে ২৮ জন পাকসেনা মারা গেছে। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে খোঁজাখুঁজির পর বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে। এমন অনেক গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়েছি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ: জীবনবাজি রেখে পাক সেনাদের আত্মসমর্পন করাতে সারেন্ডার লেটার নিয়ে যাওয়ার পরের ঘটনা?

মুন্সি জহুরুল হক: আমরা জামালপুরের পাকিস্তানী ক্যাম্প থেকে দেড় মাইল দুরে বেলটিয়ায় অবস্থান নেয়। সেখানে উপস্থিত ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লে আহবান জানালো পাক সেনা আত্মসমর্পণ করাতে একজনকে সারেন্ডার লেটার ও সাদা পতাকা নিয়ে জামালপুর গ্যারিসনে যেতে হবে। সবাই নিশ্চুপ, মাঝখান থেকে হাত তুলে বললাম আমি যাবো। সাইকেলে সাদা পতাকা বেঁধে সারেন্ডার লেটার নিয়ে পিটিআই ভবনে জামালপুর গ্যারিসনের অভিমুখে রওনা হলাম। আমার হাতে সাদা পতাকা ও সারেন্ডার লেটার দেখে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ওয়াবদা (পানি উন্নয়ন বোর্ড) বিল্ডিংয়ে ৪ ঘণ্টা আমাকে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে সাথে আমার পায়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, হাতের সুঁই ঢুকিয়ে নির্যাতন করে। পরিশেষে আমাকে উল্টো করে টানিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে আমার মুখর সামনের ৪টি দাঁত ভেঙ্গে দেয়। আমি বুদ্ধি খাটিয়ে পাকসেনাদের বললাম আমি ক্ষেতে কৃষিকাজ করছিলাম, বন্দুকের ভয় দেখিয়ে মুক্তিরা চিঠি দিয়ে আপনাদের ওখানে পাঠিয়েছে। আমি অশিক্ষিত কৃষক চিঠিতে কি লেখা আছে জানিনা। তারা আমার কথা শুনে কিছুটা বিশ্বাস করে নির্যাতন বন্ধ করে হাত-পা বেঁধে ক্যাম্পের মাটিতে ফেলে রেখে চলে যায়। আমি এই সুযোগে আমার হাতে থাকা ওয়ারলেস সিস্টেম ঘড়িতে বার্তা পৌঁছালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৪টি যুদ্ধ বিমান জামালপুর গ্যারিসনের ক্যাম্পের উপর দিয়ে টহল দিতে শুরু করে। পিটিআই মাঠের পূর্ব কোনায় ছিল অস্ত্রের ডিপো। সেখানে যুদ্ধ বিমান থেকে পর পর ৪টি বোমা নিক্ষেপ করলে বিকট শব্দে অস্ত্রের ডিপো বিস্ফোরণ ঘটে জায়গাটি পুকুর হয়ে যায়। এসময় বেশকিছু পাকিস্তানী সেনা মারা যায়।

দৈনিক গোপালগঞ্জ: তারপর?

মুন্সি জহুরুল হক: আত্মসমর্পণ অস্বীকার করে পাকিস্তানী কমান্ডিং অফিসার সুলতান খান ৯ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় ’একটি বুলেটসহ কাগজে লিখে দেয় বুলেটের জবাব বুলেটেই হবে’ আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি গিয়ে বুলেট ও কাগজের জবাব দেখালে উত্তেজিত হয়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনারা। তিন দিক থেকে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্প ঘিরে ফেলে। পাকসেনা ক্যাম্প লক্ষ্য করে প্রচণ্ড গুলি শুরু করে যৌথ বাহিনী। পাল্টা গুলি শুরু করলে দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল গুলিবিনিময় চলে। পরদিন সকাল পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানীরা আত্মসর্মপণ করলে জামালপুর দখল করে ঢাকার অভিমুখে যাওয়ার পথে টাঙ্গাইল রোডের বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ঢাকা দখল করি। পরে ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। বাংলার আকাশে উঠে লাল সবুজের পতাকা, জয়বাংলার শ্লোগানে গর্জে উঠে পুরো বাংলাদেশ।

দৈনিক গোপালগঞ্জ: আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ সময় দেয়ার জন্য।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ