• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

পোশাক বৃত্তান্ত ।।।

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

আদিম উলঙ্গতা থেকে এই সভ্যতার উত্তরণে মানুষের দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা হয়ে উঠেছে বস্ত্র। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে খাবার অন্বেষণের পরের আবশ্যিক প্রয়োজনটি দখল করেছে পোশাক। এর মূল কারণ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। পৃথিবীর এক প্রান্ত বরফ আচ্ছাদিত, অন্য প্রান্ত তপ্ত রৌদ্রে খাঁ খাঁ। খাদ্য যেমন মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আবশ্যিক অনুষঙ্গ, বস্ত্রও তাই। আবহাওয়ার বিচিত্রতার সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছে তার আকার আকৃতি প্রকৃতি।

বরফ আচ্ছাদিত এলাকায় কেউ দেহ উন্মুক্ত করে পোশাক পরবে না নিজেকে প্রদর্শনের প্রয়োজনে। তেমনি নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় শীত গ্রীষ্ম অনুসারে পালটে যায় পোশাকের ধরন। তীব্র রোদের আঁচ থেকে দেহকে রক্ষার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের পুরুষ নারী উভয়েই পরিধান করে মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবৃত পোশাক।

হ্যাঁ প্রয়োজন থেকেই পোশাক। এই প্রয়োজনকে আমরা সভ্যতার ধাপে ধাপে সাজিয়েছি নিজের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি দিয়ে। ভালো লাগা ও সময়োপযোগিতা দিয়ে।

বাঙালির পোশাকে আসি। আদি মধ্যযুগে এ অঞ্চলের মানুষের পোশাকে নারী পুরুষে তেমন পার্থক্য ছিলো না। এক টুকরো কাপড়ে লজ্জা নিবারণ আর তা অতিক্রম করে শীত গ্রীষ্ম অনুসারী আবরণ। মধ্যযুগের শাসকরা এদেশে শাসনের নিমিত্তে এসে ধর্মের সাথে সাথে পোশাকেও বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। বাদশাহ্‌দের দরবার থেকে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে পোশাক পরিধানের ভিন্নতা শুরু হয়। তখনও পর্যন্ত পোশাক ধর্মীয় পরিচয়ের সাইনবোর্ড হয়ে ওঠে নি। ইংরেজরা আসার পর তাদের পোশাকের ছাপও ধীরে ধীরে পরতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে। কিন্তু খুব সহজেই যে এদেশের মানুষ ইংরেজ পোশাক গ্রহণ করেছে তা নয়। ইংরেজ আমলে আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়দের যে ছবি দেখি তা মোটেই ইংরেজ পোশাক প্রভাবিত নয়।

প্রয়োজনের অনুষঙ্গ পোশাক বরং ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে আত্মপরিচয় আত্মপ্রকাশ আর আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যম। এমন হয়ে উঠেছে যে, আমরা এযুগে যে কোনো অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পরিচয় ছাড়াও শুধু পোশাকে চোখ রেখে ধারণা করে ফেলি তার রুচি এবং ব্যক্তিত্বের।

বাঙালি নারীর পোশাক শাড়িতে বিবর্তন আবার শাড়ি থেকে প্রত্যাবর্তন খুব বেশিদিনের ইতিহাস নয়।  দুটোর ইতিহাসের সঙ্গেই মিশে আছে প্রয়োজন আর  প্রয়োজনের স্বার্থে বিপ্লব। এক্ষেত্রে এক এবং একমাত্র যার নামটি না নিলে চলে না, তিনি ঠাকুর পরিবারের বউ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতৃবধূ।  যিনি বিলেত ফেরত স্বামীর সাথে স্বামীর কর্মস্থল বোম্বে (মুম্বাই) গিয়েছিলেন। সেটাই ছিলো কোন বাঙালি গৃহবধূর প্রথম স্বামীর কর্মস্থল অনুগামী হওয়া। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন সমাজ এবং পরিবারের সব প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে। তখনই পোশাকের প্রশ্নটি বিরাট হয়ে ওঠে। যে এক টুকরো কাপড়ে ঘরে দিন কাটিয়ে দেয় বাঙালি নারী তা পরে তো আর ঘরের বাইরে পা দেয়া যায় না। শুরু হয় চিন্তাভাবনা। এক টুকরো কাপড় দৈর্ঘ্যে প্রস্থে হয়ে ওঠে শাড়ি। সাথে যুক্ত হয় পেটিকোট, ব্লাউজ বা গলাবন্ধ। গুজরাটি মেয়েদের কাপড় পরার ঢংটিকে সামান্য এদিক-সেদিক করে শুরু হয় আধুনিক ভঙ্গিতে শাড়ি পরার প্রচলন। সেই শাড়িই পরে নানা বিবর্তনে হয়ে উঠলো বাঙালিয়ানার প্রতীক। সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের প্রতীক। সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বের প্রতীক। সাহিত্যে যুক্ত হলো ‘নীলাম্বরী’র মতো উপমা কিংবা ‘পরনে ঢাকাই শাড়ির’র মতো অপূর্ব বাক্যবন্ধ।

কিন্তু ঐ যে প্রয়োজন!  সৃষ্টির জননী। সত্তরের দশকে  আমরা ঢাকার রাজপথের যে মিছিল দেখি শাড়ি পরিহিতা নারীদের হাতে অস্ত্র, আজ জনারণ্যে সেই মেয়েদের দেখি বোরকায় আপাদমস্তক আবৃত। এর কতোটা ধর্মীয় অনুশাসনে আর কতোটা প্রয়োজনে এ নিয়ে আমি সন্দিহান। শাড়ি কালক্রমে এদেশে কেবলই আনুষ্ঠানিক পোশাকে পর্যবসিত হচ্ছে খুব দ্রুত৷ খুব বেশি হলে তিনটি প্রজন্ম বাঙালি নারীর প্রধান পোশাক ছিলো শাড়ি। তারপর দেশভেদে বাঙালি নারীর পোশাক পালটে গেছে, পালটে যাচ্ছে প্রতিদিন। দেশভেদে বলছি, বাংলাদেশের বাইরে যে বৃহৎ আরেকটি বাংলা তা ভারতের প্রদেশ পশ্চিম বঙ্গ। এই বাংলা যেমন শাড়ি পালটে প্রবেশ করেছে সালোয়ার কামিজ, হিজাব বোরকায়, তেমনই অন্য বাংলা প্রবেশ করেছে গেঞ্জি, কুর্তি, জিন্সে। শাড়ি পরে রয়েছে মা খালাদের কাছেই।

বলছিলাম প্রয়োজনের কথা। এই বাংলা কিংবা ঐ বাংলা বাঙালি নারীর এই যে পোশাকের বিবর্তন, বাঙালি নারী খুব ভেবেচিন্তে নিজের যৌন আবেদনের চিন্তা মাথায় রেখে ঘটিয়েছে মোটেই তা নয়। বরং জ্ঞানদানন্দিনী দেবী থেকে সেই যে নারীর ঘরের বাইরে আসার শুরু তা দিনে দিনে বেড়েছে বৈ কমে নি। একজন কর্মজীবী নারীকে কর্মস্থলে যাওয়া ছাড়াও দিনে সন্তানদের আনা নেওয়া, বাজার সওদা করাসহ দিনে কয়েকবার ঘর-বাইর করতে হয়। ফলে তার পক্ষে আদৌ শাড়ি পরে বারবার ঘরের বাইরে যাওয়া কি সম্ভব?  অন্তত নিজের ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে জানি এটা কতোটা অসম্ভব। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গের নারীরা জিন্স কুর্তি পরছে। আমার কেনো যেনো মনে হয় এদেশের নারীদের বোরকাপ্রীতিও অনেকটাই প্রয়োজনের খাতিরে। দ্রুত যে কোনো পোশাকের উপর চাপিয়ে বের হয়ে গেলেই হলো। বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন তো থেমে থাকবে না। ধর্মীয় অনুশাসন আর সময়ের সদ্ব্যবহার উভয় কূল রক্ষা করার মতো এমন উপযোগী পোশাক আর কই!

নিজের শংকর জাতিসত্তার যে সব সীমাবদ্ধতা;  উচ্চতা, গায়ের রং ইত্যাদি যে আমার সীমাবদ্ধতা তাই-ই ধ্রুব- এ রায় দিলো কে?  লম্বা ফর্সা খাড়া নাকই যে সুন্দরের প্রতীক এই বিবেচনাই বা পুরোটা ধ্রুব বললো কে?  এ সবই তো আপেক্ষিক। গোলাপের দিকে চেয়ে বলি সুন্দর- সুন্দর হলো সে!

নিজের উচ্চতা আর অসৌন্দর্য ঢাকার জন্য মোটেই বাঙালি নারী শাড়ি বেছে নেয় নি, ছেড়েও দেয় নি। ঘর-সংসার, বাচ্চা সামলে বাইরে যাবার সময় কোনো নারীর মাথায় আদৌ থাকে না তার শরীরের বাঁক কতোটা প্রকাশ করছে কোন পোশাক! যে বা যারা এভাবে নারী এবং তার পোশাককে দেখছেন তাঁর সমস্যাটা মূলত মস্তিষ্কে। তিনি বেগম রোকেয়ার লড়াইয়ে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ানোর সময় থেকে এখনো বের হতে পারেন নি। একশ বছর আগের দৃষ্টিভঙ্গিতে আটকে আছেন; অন্তত নারীর ব্যাপারে।   

লেখক: নাট্যকার, গল্পকার, সংস্কৃতিকর্মী

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ