• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকৃতিকে সময় দিয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রত্যয়

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৫ জুন ২০২০  

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) যখন বৈশ্বিক মহামারির আতঙ্ক ছড়িয়ে মানুষকে ঘরবন্দি করেছে, ঠিক সেই সময় প্রকৃতি হেসে উঠতে শুরু করেছে। ঘরে বসেও মানুষ নিশ্চিতভাবেই নিঃশ্বাসের সঙ্গে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করা থামিয়ে দেনি, তবে অনেকটাই থেমেছে গাড়িঘোড়ার চাকা, কলকারখানার যন্ত্র। রাতারাতি বিশ্বের শীর্ষ বায়ু দূষণের শহরগুলোতেও তাই বায়ুমানের সূচকে দেখা গেছে ব্যাপক উন্নতি। বিশ্বব্যাপীই বলা হচ্ছে, প্রাণ ফিরছে প্রকৃতিতে।

করোনা মহামারি আর প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরে আসার এই ক্রান্তিকালে আজ ৫ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সুস্থ আর সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ‍গুরুত্ব কতটুকু, সেই বিষয়টি তুলে ধরতেই ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

করোনাকালে যেন প্রকৃতি নতুন করে নিজেকে চেনাচ্ছে বিশ্ববাসীকে। ঠিক এমন সময়ে জাতিসংঘ এ বছরের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘Time For Nature’ বা ‘প্রকৃতির জন্য সময়’। আর এ বছর এই দিবসের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘জীববৈচিত্র্য’। অর্থাৎ প্রকৃতিকে সময় দিয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সবাইকে সচেতন করতে চায় জাতিসংঘ।

প্রকৃতিকে সময় দেওয়া আর জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব প্রসঙ্গে জাতিসংঘ বলছে— আমরা যে খাবার খাই, যে বায়ু থেকে শ্বাস নিই, যে পানি পান করি কিংবা যে জলবায়ু এই বিশ্বকে আমাদের জন্য বাসযোগ্য করেছে, তার সবই আসছে প্রকৃতি থেকেই। যেমন— বায়ুমণ্ডলের সমস্ত অক্সিজেনের প্রায় অর্ধেকই উৎপাদন করে আসছে কেবল সামুদ্রিক যে গাছপালা। আবার পূর্ণবয়স্ক একটি গাছ প্রায় ২২ কিলোগ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে থাকে, যা বাতাসকে শ্বাস নেওয়ার উপযোগী করে তুলতে ভূমিকা রাখে।

মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার এত আয়োজন প্রকৃতিতে করে রাখলেও মানুষ বরাবরই প্রকৃতির সঙ্গে বিরূপ আচরণ করে আসছে। বুঝে না বুঝে প্রকৃতির প্রতি অকৃতজ্ঞ আচরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। শিল্পায়ন, নগরায়ন আর আধুনিক ভোগ-বিলাসের মোহে নির্বিবাদে কৃষি জমি উজাড় হয়েছে, উজাড় হয়েছে বন-জঙ্গল, খোলা মাঠ। বিপরীতে মানুষ যা কিছু প্রতিষ্ঠিত করেছে, তার কোনোকিছুই প্রকৃতিতে কোনো ইতিবাচকতা ফিরিয়ে দিতে পারেনি। মানুষের এ আচরণের ফলও মিলতে শুরু করেছে। বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা, বরফ গলছে, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা।

তবে এই করোনাকালে বিশ্বব্যাপী মানুষ বাধ্য হয়েছে বিরতি নিতে। অনেক দেশই এই ভাইরাসের সংক্রমণকে পাত্তা না নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু করোনা তাদের বাধ্য করেছে ঘরবন্দি হতে। তাতে করে কিছুটা হলেও বিলাস ছাড়তে হয়েছে মানুষকে। শেষ মাস তিনেক সময় বেশিরভাগ মানুষকেই বেঁচে থাকতে হয়েছে মৌলিক চাহিদার ওপর। সেই ফাঁকে যেন এবার কিছুটা নিঃশ্বাস নিয়েছে প্রকৃতি।

খোদ বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের আগে যেখানে বায়ুমান ছিল ৩০০-এর ঘরে, সেখানে এখন এই বায়ুমান ৫০-এর আশপাশে থাকছে। সব দেশেই এমন দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে প্রকৃতির প্রাণে। পরিবেশবিদ, পরিবেশবাদী আন্দোলনকারী ও সচেতন মানুষদের প্রচারণায় এ বিষয়টিও বহুল প্রচার পেয়েছে, মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিকেও বাঁচার সুযোগ দিতে হবে।

ঠিক এমন প্রেক্ষাপটেই কলম্বিয়াকে আয়োজক দেশ নির্ধারণ করে বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে চায় জাতিসংঘ। এই কলম্বিয়া এমন একটি দেশ, যেটি জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে। যে বিশাল অ্যামাজন বন পৃথিবীর ফুসফুস হিসেবে কাজ করছে, সেই অ্যামাজনের একটি অংশও রয়ছে কলম্বিয়ায়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে প্রায় ৫১ হাজার প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। প্রজাতির সংখ্যা বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি প্রজাতির পাখি ও অর্কিডের আবাসভূমি এই কলম্বিয়া। শুধু তাই নয়, উদ্ভিদ, প্রজাপতি, স্বাদু পানির মাছ ও উভচর প্রাণীদের (অ্যামফিবিয়ান) দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক প্রজাতির বাস দেশটিতে। কলম্বিয়ায় প্রায় ৩০০ ধরনের ইকোসিস্টেম বিদ্যমান, যার অনেকগুলের অবস্থানই সংরক্ষিত এলাকায়, যার ফলে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। প্রাণবৈচিত্র্যের এমন সমৃদ্ধ আবাসস্থল কলম্বিয়াও বলছে, তাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকির সম্মুখীন। আর তাই জীববৈচিত্র্য নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার এটিই প্রকৃত সময়।

করোনাভাইরাস আমাদের বুঝিয়েছে, মানুষ প্রকৃতির ওপর যে অত্যাচার করেছ, তার ফল কখনো শুভ হতে পারে না। মানুষের এমন অবিবেচনাপ্রসূত আচরণই জীবের জীবন নয়, করোনাভাইরাসের মতো ভাইরাসের বিস্তৃতির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়ছে। তাই প্রকৃতির দিকে যদি নজর না দিতে পারি, সামনের দিনে হয়তো এর চেয়েও ভয়াবহ কোনো ভাইরাস এসে ফের থামিয়ে দেবে মানুষের গতি। তাদের বাধ্য করবে ঘরবন্দি হতে, নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেবে প্রকৃতিকে।

ঠিক এমন সময়ে এসেও যদি মানুষ প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি না করতে পারে, তাহলে আর কবে পারবে?

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ