• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১০ জুন ২০২১  

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে প্রকৃতি দান করেছেন। আমাদের বসবাসের উপযোগী করে এই সুন্দর বসুন্ধরা সাজিয়েছেন অপরূপ মায়াবী কারুকার্যে। যাবতীয় প্রয়োজনীয় বস্তু সামগ্রী দিয়েই মানুষকে পাঠিয়েছেন পৃথিবীর বুকে। এই প্রকৃতি মহান আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট ও পরিচালিত। তবে মাঝেমধ্যে প্রকৃতি বিরূপ রূপ ধারণ করে। আমাদের উপর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ভারী বর্ষণ, বন্যা, খরা, দাবানল, শৈত্যপ্রবাহ; দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প, সুনামিসহ ইত্যকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমূহ। এই সব বিপদ থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহর কাছে আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে।

দুর্যোগে রাসূলের কেমন অবস্থা হতো
কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিচলিত হয়ে পড়তেন। আল্লাহর শাস্তির ভয় করতেন। বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করতেন এবং অন্যদেরকেও তা করার নির্দেশ দিতেন। ঝড়-তুফান শুরু হলে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। নফল নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এ আমল দ্বারা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী তা জানতে পারি।হাদিসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনে, ‘মুমিনের বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্যের! তার প্রতিটি কাজই কল্যাণকর। যদি তারা (মুমিন বান্দা) সুখে থাকে তবে শুকরিয়া আদায় করে, যার ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর সে বিপদে পড়লে ধৈর্য ধরে, তাও তার জন্য মঙ্গলজনক হয়।’ (মুসলিম)

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধৈর্য ধারণ করা
মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিভিন্ন বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা ও সতর্ক করে থাকেন।  আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, নিজেদের বিপদ-মুসিবতের সময় বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা  বাকারা, ১৫৫-১৫৭; পারা: ২)।

দুর্যোগের সময় পালনীয় সুন্নত আমল
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কিছু সুন্নত আমল করার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, যখন কোথাও ভূমিকম্প সংঘটিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝোড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা, তার কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা, মহান আল্লাহকে স্মরণ করা এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে মহান আল্লাহর জিকির করো, তার নিকট তওবা করো।’ (বুখারি ২/৩০; মুসলিম ২/৬২৮)।

আল্লাহর জিকিরের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে নামাজ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত বা দোয়া-দরুদ পাঠ করা। দুর্যোগের সময় জিকিরের আরও উপায় হতে পারে ইস্তিগফার, তসবি পাঠ ইত্যাদি। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, প্রচন্ড ঝোড়ো হাওয়া বইলে রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে যেতেন এবং নামাজে মশগুল হতেন। (মিশকাত শরিফ: ৬৯৬)। সাহাবিদের জীবনে আমরা দেখি, বিপদে-মুসিবতে তারা নামাজে দাঁড়াতেন ও ধৈর্য ধারণ করতেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ: ৫৩৪৫)। ঝড়-তুফানের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তাকবির (আল্লাহু আকবার,আল্লাহ মহান) বলা ও আজান দেয়া সুন্নত। (তবে এই আজানে ‘হাইয়া আলাছ ছলাহ’ [নামাজের জন্য আসো] ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ [সফলতার জন্য আসো] বাক্যদ্বয় বলার প্রয়োজন নেই)।

বৃষ্টি-বাদলের সময় যে দোয়া পড়া সুন্নাত 
আম্মাজান হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, বৃষ্টি হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দোয়া পড়তেন: ‘আল্লাহুম্মা ছয়্যিবান নাফিআ’ (হে আল্লাহ! এই বৃষ্টি যেন আমাদের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর হয়)। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)। হজরত যায়িদ ইবনে ছাবিত (রা.) বর্ণনা করেন, বৃষ্টির পর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলতেন: ‘আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহে আমরা বৃষ্টিস্নাত হয়েছি।’ (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

অতিবৃষ্টির সময় সুন্নাত দোয়া পড়া
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) অধিক বৃষ্টি ও ভারী বর্ষণের সময় এই দোয়া পড়তেন, হে আল্লাহ! এই ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ আমাদের আশপাশ থেকে সরিয়ে নিন, দয়া করে আমাদের ওপর ঝড়, তুফান ও ভারী বর্ষণ দেবেন না। হে আল্লাহ, এই ভারী বর্ষণ দিন টিলা-পর্বতে, উঁচু ভূমিতে, উপত্যকায়, বনভূমি ও চারণ ভূমিতে। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

ঝড়-তুফানের সময় পড়ার সুন্নত দোয়া
হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঝড়-তুফানের সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে এই দোয়া পড়তেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি এই ঝড়ের কল্যাণ, এর মধ্যস্থিত কল্যাণ, এর সঙ্গে প্রেরিত কল্যাণ। আমি আপনার নিকট পানাহ চাই এই ঝড়ের অনিষ্ট থেকে, এর মধ্যস্থিত অনিষ্ট থেকে, এর সঙ্গে প্রেরিত অনিষ্ট থেকে। (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

বজ্রপাত, ঝড়-তুফান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার বিশেষ দোয়া
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ করুণ এক রূপ হলো বজ্রপাত, যা মহান রাব্বুল আলামিনের শক্তিমত্তা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। এ সম্পর্কে কোরআন মজিদে রয়েছে: ‘বজ্রধ্বনি তার সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে, ফেরেশতাগণও তাকে ভয় করে (প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করে)। তিনি বজ্রপাত ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আঘাত করেন। আর তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডা করে, অথচ তিনি মহা শক্তিশালী।’ (সুরা-১৩ [৯৬] রাআদ, রুকু: ২, আয়াত: ১৩; পারা: ১৩)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, বজ্রপাত ও বিজলি চমকানোর সময় এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দোয়া পড়তেন, হে আল্লাহ! গজব দিয়ে আমাদের নিঃশেষ করবেন না, আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করবেন না; এর পূর্বেই আমাদের ক্ষমা করে দিন)। (মিশকাত শরিফ: ১৫২১; সুনানে তিরমিজি শরিফ: ৩৪৫০; নাসাই শরিফ: ৯২৭; মুসনাদে আহমাদ: খন্ড-২, পৃষ্ঠা ১০০, হাদিস: ৫৭৬৩; আদাবুল মুফরাদ বুখারি: ৭২১)

প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার উপায়
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হলো আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টি। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে আশরাফুল মখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনি অযথা কাউকে শাস্তি দিতে চান না। আল্লাহর আজাব থেকে বাঁচার জন্য আমল পরিশুদ্ধ করতে হবে। যে আমলে আল্লাহ খুশি হন, সে আমল বেশি বেশি করতে হবে। নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা ইত্যাদি ভালো কাজ করতে হবে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘সদকা আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে।’ (তিরমিজি শরিফ: ৬০০)।

মুমিন বান্দার উচিত, সব সময় আল্লাহর পথে অগ্রসর হওয়া, আল্লাহ সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা, তার নির্দেশিত বিধি-বিধান পালন করা। বিশেষ করে তার নিষেধাজ্ঞাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করা। তবেই আল্লাহ তায়ালা পার্থিব জীবনের কঠিন বিপদাপদ ও দুর্যোগ থেকে মুক্তি দিবেন এবং মৃত্যুর পরে উত্তম প্রতিদান দিবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য পথ (কল্যাণের ফয়সালা) তৈরি করে দেন। (সুরা তালাক : আয়াত ২)হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তার করুণা চাও, কেননা আল্লাহ তার কাছে করুনা চাওয়াকে ভালোবাসেন। আর (বিপদাপদে) অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো তার কাছে দুঃখ কষ্ট লাঘবের ধৈর্য ধারণ করা।’ (তিরমিজি) কোরআনে আরো এসেছে, ‘গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।’ (সুরা সাজদা : ২১) 

এ আয়াতের তাফসিরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ছোট শাস্তি হলো দুনিয়ার বিপদাপদ, রোগব্যাধি, মৃত্যু এবং তাদের ওপর নেমে আসা অন্যান্য মুসিবত, যা দিয়ে আল্লাহ তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন, যাতে বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে।’ যে কোনো দুর্যোগের মুহূর্তে প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী সাহায্যের হাত প্রসারিত করার পাশাপাশি ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় তাদের প্রতিপালকের প্রতি তাওবার মাধ্যমে ফিরে আসা। তার নিকট আশ্রয় চাওয়া। কেননা যারাই বিপদাপদের মুহূর্তে তার কাছে আশ্রয় চেয়েছেন, তিনি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন, তার দুঃখ-দুর্দশা দূর করেছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করুন।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ