• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

বাইয়াতের পরিচয় ও ফজিলত

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৮ জুলাই ২০২০  

বাইয়াত ইসলামের একটি পরিভাষা। উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলমানরা এর সঙ্গে পরিচিত। বাইয়াত শব্দটি আরবি ‘বাইয়ুন’ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো বিক্রি করা। যেহেতু বাইয়াতের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয় অর্থ নিহিত থাকে তাই উক্ত শব্দ দ্বারা প্রচলিত বাইয়াতের নামকরণ করা হয়েছে। 

বাইয়াতের এই অর্থের দিকে আল কোরআনেও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের থেকে তাদের জান-মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।’ (সূরা: তাওবা, আয়াত: ১১১)।

বাইয়াতের প্রকৃত অর্থ এরকম হলেও পরিভাষা হিসেবে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। যেমন ইদরিস কান্ধলবি (রাহ.) বলেন, ‘প্রবল আগ্রহের ভিত্তিতে নিজের জান-মাল জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেয়ার নাম হলো বাইয়াত।’ (সিরাতে মোস্তফা, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২৫)। 

‘বাইয়াত হচ্ছে, ভালো কাজের ওপর অটল অবিচল থাকার ব্যাপারে কারো সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া।’ (কামসূল ফিকহ, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৮৩)। 

রাজনৈতিকভাবে বাইয়াত নেয়ার প্রচলনও ইসলামে ছিলো। সেখানে অধস্তন নেতৃত্ব অঙ্গীকার করে যে, সর্বাবস্থায় উধ্বতন নেতৃত্বের অনুগত হয়ে চলবো, চাই তাদের নির্দেশ মন মতো হোক বা অপছন্দনীয় হোক। বাইয়াতের এই আলোচনার খোলাসা হচ্ছে, বাইয়াত এক ধরনের অঙ্গীকার। যেখানে কিছু বিষয় মেনে চলার শর্তে দুনিয়াবী শান্তি-শৃঙ্খলা ও আখেরাতের সফলতার ঘোষণা দেয়া হয়।

রাসূল (সা.) এর হাতে সাহাবারা বিভিন্ন বিষয়ে বাইয়াত হতেন। কখনো জিহাদের জন্য বাইয়াত হতেন। আমৃত্যু দুশমনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রাসূল (সা.) এর হাতে রেখে বাইয়াত হতেন। নামাজ, জাকাত ও সাধারণ মুসলমানদের জন্য কল্যণকামনার বিষয়েও বাইয়াত হওয়ার ঘটনা হাদিসে পাওয়া যায়। যেমন: সহিহ বুখারিতে হজরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) এর ঘটনা এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল (সা.) এর হাতে বাইয়াত হয়েছি এ বিষয়ে যে, নামাজ কায়েম করবো, জাকাত দেবো ও সব মুসলমানের কল্যাণ কামনা করবো। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর-৫৫)।

ইমাম বুখারির শর্ত অনুযায়ী না হওয়ায়, মূল কিতাবের হাদিস হিসেবে তিনি এটাকে উল্লেখ করেননি। শিরোনামের অধীনে এনেছেন। কখনো কখনো অন্যান্য নেক কাজের ওপর অটল-অবিচল থাকার শর্তেও বাইয়াত হতেন। যেমন সূরা মুমতাহিনাতে এসেছে, ‘হে নবী! যখন মুমিন নারীরা আপনার কাছে এই মর্মে বাইয়াত হওয়ার জন্য আসে যে, তারা কোনো কিছুকে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, নিজেদের হাত-পায়ের মাঝে বানিয়ে কোনো অপবাদ রটাবে না এবং কোনো ভালো কাজে আপনার নাফরমানি করবে না তখন আপনি তাদেরকে বাইয়াত করে নিন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ (আয়াত নম্বর: ১২)। এই আয়াত থেকে কয়েকটি বিষয় বুঝে আসে।

এক. ভালো কাজ করা ও তার ওপর দৃঢ় থাকার জন্য কোনো পীরের হাতে বাইয়াত হওয়া তথা অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া রাসূল (সা.) থেকে প্রমাণিত সুন্নত। দুই. তৎকালিন আরবে সন্তান হত্যা বিশেষ করে মেয়েদেরকে হত্যা করার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। ইসলাম এটাকে বন্ধ করার জন্য সন্তান হত্যার বিষয়টিকে বাইয়াতের অন্তর্ভূক্ত করেছে। যেন গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় বিষয়টি আলোচিত হয়।  উক্ত আয়াত থেকে তৎকালিন সময়ে নারী জাতির প্রতি সহিংসতা ও ইসলাম নারীদের রক্ষায় ভূমিকা ফুটে উঠে। তিন. পুরুষের ন্যায় নারীরাও শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে আত্মশুদ্ধির জন্য পীরের কাছে বাইয়াত হতে পারবে। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায়। সহিহ বুখারিতে হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘কোনো নারী সাহাবি যখন রাসূল (সা.) এর সব শর্ত মেনে নেয়ার ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করতো তখন রাসূল (সা.) তাকে বলতেন, আমি তোমাকে বাইয়াত করেছি। আল্লাহর কসম! রাসূল (সা.) এর হাত কোনো নারীর হাতকে বাইয়াতের সময় কখনো স্পর্শ করেনি। নারীদেরকে তিনি কথার মাধ্যমে বাইয়াত করতেন।’ (হাদিস নম্বর-২৭১৩)।

বাইয়াত হওয়ার বিধান: ইদ্রিস কান্ধলবী (রাহ.) এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘কোরআনের বহু আয়াত ও রাসূল (সা.) এর হাদিসে বাইয়াতের বিষয়টি উল্লেখ থাকায়, বাইয়াত সুন্নত, কল্যাণকর ও বরকতের বিষয় হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। রাসূল (সা.) উম্মতের শিক্ষক ও তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধকারী ছিলেন। তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান। অতএব, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি যে বাইয়াত নিয়েছিলেন, বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্যও ওই বাইয়াত সুন্নত। তিনি উম্মতের অন্তরকে পরিশুদ্ধকারী হিসেবে উম্মত থেকে যে বাইয়াত নিয়েছিলেন, তার স্থলাভিষিক্ত হক্কানী রব্বানী উলামাদের জন্য সে বাইয়াত সুন্নত। (সিরাতে মোস্তফা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩৯১)।

বাইয়াত আল্লাহর সঙ্গেই হয়ে থাকে: বাইয়াতের অর্থ বিক্রি করা বা অঙ্গীকার করা যাই হোক, এটা আল্লাহর সঙ্গেই মূলত হয়ে থাকে। তবে আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি এমন কিছু করা সম্ভব না হওয়া, নবীরা ও পরবর্তীতে তাদের উত্তরসূরি হক্কানি পীর-মাশায়েখের মাধ্যমে এটা সম্পন্ন হয়ে থাকে। আল কোরআনে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা আপনার হাতে বাইয়াত হয়, প্রকৃত অর্থে তারা আল্লাহর সঙ্গে বাইয়াত হয়। তাদের হাতের ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে। সুতরাং যে অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে, সে তা ভঙ্গ করবে নিজেরই ক্ষতির জন্য। আর যে কেউ সে বিষয় পূর্ণ করবে, যার অঙ্গীকার সে আল্লাহর সঙ্গে করেছে, আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই বিশাল প্রতিদান দেবেন।’ (সূরা: ফাতহ, আয়াত নম্বর: ১০)।

হাদিসেও পাওয়া যায় যে, রাসূল (সা.) নির্দিষ্ট কিছু আমল করার অঙ্গীকার চেয়ে বলেছেন, তা যদি কেউ পূর্ণ করে তাহলে তার জান্নাতের ব্যাপারে আমি জিম্মাদারি নেবো। অর্থাৎ এখানে মূলত আল্লাহর তরফ থেকে কেমন যেন তিনি ওকিল হয়ে এই অঙ্গীকারগুলো নিচ্ছেন। তবে অঙ্গীকার পূর্ণ হওয়া না-হওয়ার ওপর তার ফলাফল নির্ভর করবে। বাইয়াতে যেসব বিষয়ে অঙ্গীকার নেয়া হয় তা সাধারণত দ্বীনদারি পালনের বিষয় হয়ে থাকে। তাই তা মেনে চললে, এর অসিলায় আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দেবেন- ইনশাল্লাহ! কিন্তু অঙ্গীকার বাস্তবায়ন না করে, শুধু বাইয়াত দ্বারা কোনো উপকার পাওয়া যাবে না।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ