• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না হলে যাবজ্জীবন হতো’;অভিনেতা কাদের

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

বরেণ্য অভিনেতা আব্দুল কাদের। মঞ্চ থেকে টেলিভিশন, তারপর নাম লেখান চলচ্চিত্রে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে ‘বদি’ চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে যান। অভিনয় ক্যারিয়ারে কয়েকশ’ টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন। বেশিরভাগ হাস্যরসাত্মক চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে অনেক কিছু। বয়সও ভর করেছে শরীরে।জনপ্রিয় তারকার সঙ্গে কথোপকথনটি হুবহু তুলে ধরা হল:-

সত্তর দশকে থিয়েটারের মাধ্যমে অভিনয়ে আপনার হাতেখড়ি। থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রে তুলনামূলক কতটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?

কাদের: মঞ্চনাটক, টিভি নাটক কিংবা চলচ্চিত্র— যে মাধ্যমের কথাই বলুন গল্প খুব গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মঞ্চ নাটক সেরকমভাবে লেখা হয় না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমরা যখন মঞ্চনাটক করেছি, তখন সমসাময়িক জীবন এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাট্যচর্চা হয়েছে। যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল। যে কারণে অন্যরকম একটা উন্মাদনা ছিল। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সবার কমিটমেন্ট ছিল। এজন্য টিমওয়ার্ক ভালো হতো। ওই সময়ে নাটক রচনা করতেন— আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন, হুমায়ূন আহমেদ, মমতাজউদ্দীন আহমেদ। এদের কেউ বেঁচে নেই। বর্তমান প্রজন্মের যারা নাটক লিখছেন তারা আবার টেলিভিশন নাটকও লিখছেন। এজন্য অবশ্য তাদের দোষ দেই না। এটা ঘটে গেছে। মোদ্দা কথা হলো— মঞ্চের যে কমিটমেন্ট ছিল সেটা এখন নেই। আর আগে যারা মঞ্চে কাজ করতেন তারা এখন কাজ করেন না। কারণ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বিস্তার ঘটায় তাদের সেদিকেও সময় দিতে হচ্ছে। চাইলেও তারা টেলিভিশনে সময় দেয়া বন্ধ করতে পারবেন না।  

প্রায় ৩০টি মঞ্চ নাটকে কাজ করেছেন। মঞ্চে কি ফেরার পরিকল্পনা রয়েছে?

কাদের: না, আমি আর মঞ্চে ফিরতে পারব না। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমিতে আমি যাই। তাছাড়া থিয়েটারের পরিচালক ও প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করি। বিভিন্ন উৎসবে যাই। কিছুদিন আগে আব্দুল্লাহ আল মামুনের স্মরণসভায় গিয়েছিলাম।

সম্প্রতি আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর মঞ্চে ফিরেছেন। আপনার কী কোনোই সম্ভাবনা নেই?

কাদের: মঞ্চে ফিরতে পারলে ভালো লাগত। আমার বিষয়টি কিছুটা আলাদা। বাসা যদি কাছে থাকত তবে হয়তো চেষ্টা করা যেত। তাছাড়া অনেক নাটকই তো করেছি। যারা নতুন এখন তারা করুক। তাদেরকেও তো তৈরি করতে হবে। নূর ভাই এখন মঞ্চে সময় দিচ্ছেন। রামেন্দুদা, ফেরদৌসী আপা আছেন। তারা যদি বেছে বেছে নতুনদের  প্রশিক্ষণ দেন ও নাটকে কাজের সুযোগ করে দেন তবে ভালো হয়।

‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে আপনার ‘বদি’ চরিত্রটি এখনো মানুষের মনে গেঁথে আছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ খেপেছিলেন। ওই সময়ে আপনার সঙ্গে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেছিল?

কাদের: না, সে ধরণের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নাট্যকার যেভাবে নাটক রচনা করেছিলেন আমি সেভাবেই অভিনয় করেছি। সাংবাদিকদের হুমায়ূন স্যার তখন বলেছিলেন, ‘এক সময় পরিবারটা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। বাকেরের যদি ফাঁসি না হতো তবে তাকে আজীবন জেলে থাকতে হতো। এতে তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হতো। সেদিক বিবেচনা করেই বাকেরের ফাঁসি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এক সময় বন্ধুত্বের চেয়েও পরিবার প্রাধান্য পায়। এ বিষয়টি স্যার নাটকে দেখিয়েছেন। দর্শক তখন ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল- এটাই স্বাভাবিক। তখন বড় ধরণের আন্দোলন পর্যন্ত হয়েছিল। এ বিষয়ে যদি বলি, তবে দীর্ঘ লেখা লিখতে হবে। কারণ অনেক ঘটনাই ঘটেছিল। সবই আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। বাকের ভাই সমাজের প্রতিবাদী চরিত্র। গল্পে কুত্তাওয়ালির বাড়িতে যতগুলো অঘটন ঘটেছিল তার সবগুলোর প্রতিবাদ সে করেছিল। দর্শক আমার অভিনয় পছন্দ করেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে যখন কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হতো তখন আমাকে দেখে অনেকে হাসত। 

এই নাটকে কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন?

কাদের: বরকতউল্লাহ সাহেব নাটকটিতে অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন। তিনি নাটকটির প্রযোজক ছিলেন। তিনি সম্ভাব্য কিছু শিল্পীকে ডেকেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ সাহেব ও বরকতউল্লাহ সাহেব দুজনে মিলেই বদি চরিত্রের জন্য আমাকে নির্বাচন করেন।

এখন বদি কিংবা বাকের ভাইয়ের মতো কোনো চরিত্র তৈরি হয় না কেন?

কাদের: আসলে সেরকম নাট্যকার তো নেই। এখন যারা আছেন তারাও একদিন এমন চরিত্র তৈরি করবেন। একদিনে তো কেউ তৈরি হয় না। সময়ের সঙ্গে ভালো নাট্যকার, ভালো পরিচালক তৈরি হবে। নাটকের গল্প গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন পরিবার নিয়ে খুব বেশি নাটক হয় না। নাটক হচ্ছে কিন্তু পরিবারের সুখ-দুঃখ-বেদনা, হাসি-ঠাট্টা এসব নিয়ে এক্সক্লুসিভ নাটক নির্মিত কম হয়। দর্শক কিন্তু এগুলো চায়।

বর্তমান টিভি নাটকে মূল সংকট তাহলে কোথায়?  

কাদের: টেলিভিশন নাটক সংকটময় সময় পার করছে। আসলে কোয়ান্টিটি যখন বাড়ে তখন কোয়ালিটি কমে যায়- এটাই নিয়ম। এত চ্যানেল এত নাটক— একজন নাট্যকার কয়টা নাটক লিখবেন? এখন নাট্যকারকে সকালে একটা রাতে একটা নাটক লিখতে হচ্ছে। শুটিংয়ের সময় নাটকের স্ক্রিপ্ট দিচ্ছে। শুটিংয়ের আগে অভিনয়শিল্পীদের স্ক্রিপ্ট দিতে পারছে না। আগে স্ক্রিপ্ট না পেলে একজন অভিনেতা কী করে তার চরিত্র বিশ্লেষণ করবে? এখন ঠিকমতো স্ক্রিপ্টই তো পাওয়া যায় না। এজন্য আসলে কাকে দোষ দিব? এত নাটকের ভিড়ে ভালো নাটক হারিয়ে যাচ্ছে। আর চ্যানেলগুলোর ব্যবসায়ীক দৃষ্টিভঙ্গি। বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় মানুষ বিরক্ত হয়ে যায়।

সমাধান তো হচ্ছেই না বরং সংকট দীর্ঘ হচ্ছে…

কাদের: এসব সমস্যার তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান করা যাবে না। আমাদের মতো দেশে এত চ্যানেল, এটা একটু বেশি। এগুলো বন্ধ করারও উপায় নেই। আর বন্ধ করুক সেটা চাইও না। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। তবে তাদেরও ভালো কিছু করার চেষ্টা করা উচিৎ।       

ঘুরেফিরে কয়েকজন তারকাশিল্পী নিয়েই বেশি নাটক নির্মিত হচ্ছে। এতে নতুন শিল্পীরা সুযোগ পাচ্ছেন না।

কাদের: এটি ঠিক বলেছেন। আমরা যখন বিটিভিতে নাটক করতাম তখন একটি সিরিয়ালে অভিনয় করলে আরেকটি সিরিয়ালে অভিনয় করতে পারতাম না। যতক্ষণ না আগের সিরিয়ালের প্রচার শেষ না হতো ।এর কারণ এই সপ্তাহে দর্শক আমাকে দেখেছেন, পরের সপ্তাহে যেন আমাকে দেখা না যায়। এসব বিষয় তখন মানা হতো। কারণ দর্শক একই মুখ দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে যান। কিন্তু বেসরকারি টিভি চ্যানেল এসব মানে না। স্পন্সররা যাদের কথা বলছে তাদের নেওয়া হচ্ছে। তখন কোনো চরিত্রের জন্য যদি হুমায়ুন ফরীদিকে প্রয়োজন হতো, তবে তাকেই নেওয়া হতো। এজন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হলেও প্রযোজক করত। এগুলো এখন আর হয় না। হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই দাঁড় করিয়ে দেয়। তাতে চরিত্রটি ফুটে উঠুক আর না উঠুক।  

খেয়াল করে দেখবেন কলকাতার টিভি চ্যানেলের নাটকে অনেক সময় বক্তব্য থাকে। তারা নিয়ম মেনে কাজগুলো করেন। যেমন: তাদের চ্যানেলে সপ্তাহে ৫ দিন নাটক প্রচার হয়। এই সময়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর, রূপচর্চার অনুষ্ঠান, টক শো থাকে না। নিউজ চ্যানেলে সপ্তাহে দুই দিন নিউজ, রিয়েলিটি শো প্রচার হয়। নাটক যখন প্রচার হয় তখন নির্ধারিত সময়ে ধারাবাহিকভাবে নাটক প্রচার হতে থাকে। দর্শক এগুলো মিস করলে পরের দিন রিপিট দেখতে পারেন। ওদের কাজ যে সব ভালো হয় সেটা না। কিন্তু পুরো কাজটি ওরা যত্ন নিয়ে করে।

আপনি একজন কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব। কমেডিও খুব ভালো করেন। দুটো বিষয় বিপরীতমুখী। আসলে ব্যক্তি কাদের কেমন মানুষ?

কাদের: এটা তো আপনারা বলবেন। দর্শকের প্রতিক্রিয়া তো ভালো পাই। আমি যখন কর্পোরেট চাকরি করতাম তখন ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করতাম। আমি এটা সবসময় করি। সপ্তাহে শুক্র-শনিবার শুধু নাটক করতাম। কারণ এই দুদিন আমার ছুটি ছিল। যাদের আমাকে প্রয়োজন তারা আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। তাদের সঙ্গে কখনো দ্বন্দ্ব তৈরি হয়নি। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার অফিস মানে অফিস, শুটিং মানে শুটিং। 

পর্দায় মানুষকে হাসাতে দেখি। ব্যক্তিগত জীবনেও কী আপনি হাস্যজ্জ্বল থাকেন?

কাদের: হ্যাঁ, ব্যক্তিগত জীবনেওেআমি হাস্যজ্জ্বল। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই জীবনের পুরো সময়টা শুধু গম্ভীর ও সিরিয়াস হয়ে থাকলেন— এটা হয় না। আপনার হিউমার থাকতে হবে, হাসিখুশি থাকতে হবে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি পরিবারে হিউমারাস ক্যারেক্টার থাকে। তারা বাসায় আসলেই অন্যরা খুশি হয়। কারণ সে কিছু মজার কথা বলবেই। আসলে মানুষের জীবন হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ মিলিয়েই। জীবন থেকে হাসি বাদ দেওয়া যাবে না।

ইন্ডাস্ট্রি এক প্রকার কমেডিয়ান শূন্য…

কাদের: কমেডিয়ান শব্দে আমি বিশ্বাসী না। সবাই অভিনেতা। এ শব্দ বিদেশি কিছু শোয়ে ব্যবহৃত হয়। যাইহোক, বাংলাদেশে এখন এক প্রকার জোর করে হাসানোর চেষ্টা করা হয়। রঙিন কাপড়-চোপড় বা অদ্ভুত পোশাক পরে হাসানোর চেষ্টা করা হয়।

দিলদার মারা যাওয়ার পর পরবর্তী প্রজন্মের কেউ তৈরি হয়নি।

কাদের: শূন্যতা চলচ্চিত্রে বেশি। এগুলো তো হিউমারাস ক্যারেক্টার। এই চরিত্র রূপায়ন করতেন টেলি সামাদ, খান জয়নুল, হাসমত, দিলদার ভাই। এরা আসলে কিংবদন্তি। এদের মতো কেউ তৈরি হচ্ছে না। আসলে এগুলো বাই বর্ন হতে হয়। জোর করে এদের মতো হওয়া যায় না। হয়তো এক সময় কেউ চলে আসবে।  

জনপ্রিয় কমেডি রিয়েলিটি শো ‘মার্সেল হা-শো’ এনটিভিতে প্রচার হয়। এ ধরণের অনুষ্ঠান কমেডিয়ান তৈরিতে কতটা ভূমিকা রাখছে?

কাদের: এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। অনুষ্ঠানটির দ্বিতীয় সিজনের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছি। এটাকে জোকস পারফর্মিং অ্যাক্টিং বলে। দ্বিতীয় সিজনে ভালো ভালো কিছু ছেলে উঠে এসেছিল। কিন্তু সমস্যা হলো এরা হারিয়ে যায়। আসলে এদের ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। 

বর্তমানে কী নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন?

কাদের: বেছে বেছে নাটক করছি। ‘শহর আলী’ নামে নতুন একটি ধারাবাহিক নাটকে কাজ করছি। এটি এনটিভিতে প্রচার হবে। এজাজ মুন্না ভাই পরিচালনা করছেন। মুন্না ভাই শুটিংয়ের ১৫-২০ দিন আগেই স্ক্রিপ্ট দিয়ে দেন। পুরোনোদের মধ্যে যারা আছেন তারা এসব মেইনটেইন এখনো করেন। তারপর ইত্যাদিতে মামা-ভাগ্নের পর্বটা নিয়মিত করছি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ