• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অভিন্ন শিক্ষক’ নিয়োগ কতটা বাস্তবসম্মত?

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০১৯  

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা থাকলেও এবারই বেশ ঘটাও করে একটি নিয়োগবিধির খসড়া সরকার তৈরি করতে যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে বেশ কয়েকদিন ধরে খবর আসছে।

গণমাধ্যমে আসা এই খসড়া নিয়োগবিধিতে বলা হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে প্রার্থীকে ১০০ নম্বরের একটি লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় বসতে হবে। যদিও গত কয়েক দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল একটি মৌখিক পরীক্ষায় নিয়োগ পাওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল।

২০১৭ সালে ১৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের ১৪৮তম সভায় গৃহীত এই নীতিমালা তাদের ওয়েব সাইটে ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশ হয়েছে

(http://ugc.portal.gov.bd/sites/default/files/files/ugc.portal.gov.bd/policies/301597c0_6e7b_40a1_9a94_70836cb8dcfa/Unified%20Guidelines%20for%20Recruitment%20and%20Promotion%20&%20Up-Gradation%20of%20Public%20University%20Teachers.pdf)

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে বৈষম্যের কথা উল্লেখ করে ‘অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা’ প্রয়োজনীয়তা ইউজিসি অনুধাবন করছে বলে নীতিমালার ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।

১৮ পৃ্ষ্ঠার এই নীতিমালা পড়ে যতটুকু বোঝা গেছে, তাতে শিক্ষক নিয়োগে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একই কাতারে আনতে ইউজিসির প্রচেষ্টা গুরুত্ব বহন করে। তবে সম্প্রতি এ খসড়ার চূড়ান্তকরণে ছয় সদস্যের একটি কমিটি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আদেশে বৈঠক করার পর বিতর্ক শুরু হয়েছে।

মজার বিষয় হলো খসড়া প্রণয়ন কমিটির ছয়জন সদস্যই ইউজিসির কর্মকর্তা বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন, শিক্ষক সমিতি ও শিক্ষক ফোরামের মতো শিক্ষকদের সংগঠনগুলো। সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার দুয়েকের মতো শিক্ষক বিবৃতি দিয়ে খসড়া এই ‘অভিন্ন’ শিক্ষক নিয়োগ বিধির বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন।

বিবৃতিতে তারা বলার চেষ্টা করেছেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি সংক্রান্ত অভিন্ন নীতিমালায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের  শিক্ষকদের নিয়ে সাব-কমিটি করলে শিক্ষকদের মতামতের মূল্যায়ন থাকতো।

প্রায় দেড় বছর আগে এ খসড়া নীতিমালা করা হলেও শিক্ষকরা কেন বাধা দিচ্ছেন, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে তার আগে আমাদের জানতে হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালায় আসলে কী বলা হয়েছে।

২০১৮ সালে ২২ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি অভিন্ন নীতিমালায় বলছে, কোন প্রার্থীকে প্রভাষক, সহকারী, সহযোগী এমনকি অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেতে হলে তার স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৪ পাল্লায় ৩ দশমিক ৫ পেতে হবে। পাশাপাশি এইচএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ ৫ স্কেলে ৪ দশমিক ৫ থাকতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা পদ হিসেবে প্রভাষক পদে এই যোগ্যতার পাশাপাশি প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শর্টলিস্ট করে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পিএইচডি/এমফিল থাকলেও যোগ্যতার শিথিলতার কোন প্রকার সুযোগ থাকছে না।

অন্যদিকে সহকারী অধ্যাপক পদ পেতে হলে প্রার্থীদের উপরের শিক্ষকতার যোগ্যতার পাশাপাশি তাদেরকে তিন বছরের সক্রিয় শিক্ষকতা ও ৩টি প্রকাশনা থাকার কথা বলা হচ্ছে যেখানে একটি প্রকাশনার প্রথম ‘অথর’ থাকতে হবে।

তবে মজার বিষয় হলো ওই নীতিমালায় সহযোগী অধ্যাপক পদের জন্য ৬ প্রকাশনার মধ্যে দুইটির ‘ফার্স্ট অথর’ হিসেবে থাকার কথা বলা হচ্ছে, যেখানে ন্যূনতম একটি গবেষণার ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর থাকার কথা বলছে ইউজিসি। 

এইসব সহকারী পদে প্রকাশনার ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (গবেষণাটি কতটি গবেষণাপত্রে উদাহরণ হিসেবে গবেষকরা রেখেছেন, যাকে আমরা সাইটেশন বলি। আর সারা বছর এই সাইটেশনের উপর ভিত্তি করে থমসন রয়টার্স প্রতিবছর জার্নালগুলোর একটি ডাটাবেইজ করে নম্বর দেয়, যেটিকে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বলা হয়) থাকবে কিনা, সেটা উল্লেখ করা না হলেও সহযোগী অধ্যাপকের পদে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে। এই প্রকাশনার সাথে সহকারী পদে সাত বছরের শিক্ষকতাসহ মোট চৌদ্দ বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক।

সক্রিয় শিক্ষকতা বলতে ইউজিসি, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কিংবা সবেতনে শিক্ষা ছুটির সময়কালকে বুঝিয়েছে। যেখানে একজন প্রার্থী মাস্টার্স ও পিএইচডির জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছরের শিক্ষা ছুটি গ্রহণ করতে পারবেন।

আর অধ্যাপক হতে সহযোগী অধ্যাপক থাকা অবস্থায় ৬ টি প্রকাশনাসহ মোট ১২টি গবেষণা প্রবন্ধ থাকতে হবে। আর এইসব গবেষণা প্রবন্ধের মধ্যে ন্যূনতম ৩ টি প্রবন্ধের প্রথম অথর কিংবা করেসপন্ডিং অথর হতে হবে, যার মধ্যে ২ টি প্রকাশিত জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর থাকা বাঞ্ছনীয়। এছাড়াও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ১০সহ মোট ২২ বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। মজার বিষয় হলো, এইসব গবেষণাপত্র জাতীয় না আন্তজার্তিক জার্নালে প্রকাশিত হবে সেটার উল্লেখ নেই। স্বীকৃত জার্নাল বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এই হলো আমাদের গরীব দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজকীয় শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থার রূপকল্প। আমাদের মতো দেশের এমন নিয়োগ ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোন কোন দেশে রয়েছে, তা নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেও মিল খুঁজে পাইনি।

এই ধরেন, পৃথিবীর সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়ার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিন (https://academicpositions.harvard.edu/postings/9213) দেখবেন, সেখানে একাডেমিক পদ পাওয়ার জন্য প্রার্থীদের যোগ্যতার খাতায় বলা হয়েছে- Candidates must hold a PhD and/or MD degree. অর্থাৎ প্রার্থীকে অবশ্যই পিএইচডিধারী হতে হবে। এর বাইরে বলা হয়েছে, Strong research record and a commitment to undergraduate teaching and graduate training. অর্থাৎ শিক্ষকতার জন্য শক্তিশালী অঙ্গীকার ও প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।

আবেদনের যোগ্যতার সাথে টিচিং স্টেটমেন্ট দেয়া জরুরি বলে তারা মনে করেন। শিক্ষকতার দর্শন কেমন হবে, তার বিশদ ব্যাখ্যায় মূল্যায়ন করা হবে সে পাঠদানের যোগ্য হবে কি না। এছাড়াও বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গবেষণার সারাংশও তুলে ধরার কথা বলা হয়।

অনেকেই ভাবছেন, এইসব বড় বিশ্ববিদ্যালয় বলে যোগ্যতা কম লাগে নাকি? নাকি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় এইসব বিশ্ববিদ্যালয়কে টপকিয়ে গেছে?

এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে চলুন দেখি আসি, আমাদের এশিয়ার অন্যতম ছোট একটি দেশ নেপালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। সম্প্রতি কাঠমন্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি- (http://www.ku.edu.np/news/gallery/1/Ford%20Foundation%20Chair%20Professor.pdf ) দিকে একবার নজর দিন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতায় প্রার্থীর পিএইচডি ডিগ্রির পাশাপাশি ১২ বছরের গবেষণা ও কমপক্ষে ২টি প্রকাশনা থাকার কথা বলা হয়েছে।

বড় ও ছোট দেশের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে কোথাও কি দেখা গেল সিজিপিএ ও সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা?

অথচ আমাদের দেশে লিখিত পরীক্ষার আগে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠিতে রাখা হয়েছে সিজিপিএ দৌড়। পিএইচডি কিংবা প্রকাশনার আগে ফাঁক বের করে রাখা হয়েছে সিজিপিএ/জিপিএ-কে।

আর এইসব শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে অর্থতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও স্বজনপ্রেমের অভিযোগ আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। নিয়োগ চূড়ান্ত করতে আগে থেকে পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচিত করা হতো। এই তো কয়েকদিন আগেও এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের দরকষাকষির একটি অডিও ফাঁসের খবর পত্র-পত্রিকায় বেশ খোড়াক জুগিয়েছিল।

এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নয়নে অভিন্ন নীতিমালা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বেশ কয়েকজন সচিব ত্রাতা হিসেবে আর্বিভাব হয়েছেন।

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আমলাদের যেখানে শিক্ষকতার কোন অভিজ্ঞতায় নেই সেখানে শিক্ষক নিয়োগ বিধির কমিটিতে তারাই সিদ্ধান্ত নেবে তা কখনো প্রাসঙ্গিক হতে পারে না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। কেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে শিক্ষকরা মানতে পারছেন না কিংবা আদৌ এ নিয়োগের নিয়ম-নীতি বাস্তবিক কিনা তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

দেখুন, বাংলাদেশের প্রধান যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই অ্যাক্টের ২৫ তম ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,

The Academic Council shall be the academic body of the University, and shall, subject to the provisions of this Order, the Statutes and the University Ordinances, have the control and general supervision over, and be responsible for maintenance of standards of, instruction, education and examination within the University, and shall exercise such other powers and perform such other duties as may be conferred or imposed upon it by the Statutes. It shall have the right to advise the Syndicate on all academic matters.

এছাড়াও এই ৭৩’ অ্যাক্টের ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক  উন্নয়ন ও বাজেট নির্ধারণ করবে প্লানিং বা পরিকল্পনা কমিটি। মূলত বিভাগের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে করা প্লানিং কমিটির সুপারিশে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে প্রার্থীদের আবেদন যাচাই বাছাই করে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডিন, বিভাগীয় সভাপতি ও অধ্যাপকের সমন্বিয়ে গঠিত একটি যাকে ৩৪ ধারার (ক)(খ) উপধারায় স্পষ্টত সিলেকশন বোর্ডের বলা হচ্ছে তারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক নিয়োগে সুপারিশ করবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করা হয়। 

স্বায়ত্বশাসিত দাবি করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যেকোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই একাডেমিক কাউন্সিল হয়ে গৃহীত হয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মেধা তালিকায় থাকায় প্রথমদিকের শিক্ষার্থীদের নামে মাত্র মৌখিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়োগ দিয়ে আসছে।

যেটি কখনো স্ট্যান্ডার্ড ছিল না। শুধু ফলাফল আর মৌখিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে শিক্ষক হওয়া বাংলাদেশের চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ প্রার্থীদের চেয়ে সহজ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

আর এই কৌশলটিকে কাজে লাগিয়েছে আমাদের দেশে বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়া আমলারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে খড়গ বসাতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলছেন তারা।

প্রশ্ন হলো, আমলারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা তৈরির কে? কেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাত দিয়েছেন? নিজেদের কিসের যোগ্যতার/অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তারা এই নীতিমালা করার সাহস পাচ্ছেন?

অন্যদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষকরা আজও মনে করেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা মাপবেন। বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা কখনো এক হতে পারে না বলে তারা মনে করছেন।

অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে চলমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিধান যে বাস্তবতার আঙ্গিকে হচ্ছে না তা স্বীকার করতে হবে। পৃথিবীর কম বিশ্ববিদ্যালয়ই পাওয়া যাবে, যেখানে একজন সদ্য মাস্টার্স পাস করা শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ানোর সুযোগ পান। অবাস্তবিক এই নিয়োগ বিধির বিপরীতে অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে পারে যুগান্তরকারী পদক্ষেপ।

কিন্তু খসড়া নীতিমালায় যা এসেছে, তা কখনো সম্পূর্ণ নীতিমালা হতে পারে না। যে নীতিমালার প্রধান মাপকাঠি হচ্ছে, সিজিপিএ/জিপিএ মূল্যায়ন! দ্বিতীয়টি হচ্ছে শিক্ষকদের বাছাইয়ে লিখিত পরীক্ষা, যেটা আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে হয় কিনা আমার জানার বাইরে।

প্রচলিত নীতিমালায় অনেকটা স্পষ্ট বলা হচ্ছে, কেউ যদি একাডেমিকভাবে পিএইচডি, ভাল গবেষণা, পেটেন্টও থাকে সে সরাসরি সহকারী, সহযোগী কিংবা অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাবেন না। সক্রিয় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকলে আপনার রাতদিনের পরিশ্রম করা গবেষণার ফসল এই নীতিমালার কাছে মূল্যহীন। যেটা এক ধরনের গোঁড়ামি ছাড়া কিছু নয়। যেটাকে আমি সেকেলে পদ্ধতি হিসেবে মনে করি।

আপনার যোগ্যতা নিরূপণ হবে আপনি কতটা সফলভাবে গবেষণায় এগিয়ে। আপনার যদি পিএইচডি, গবেষণার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, আন্তজার্তিক  কনফারেন্স, ভাল ভাল পাবলিকেশন থাকে, তাহলে আপনাকে কেন ১০ বছরের শিক্ষকতা নিয়ে অধ্যাপক কিংবা চৌদ্দ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে ঢুকতে হবে?

যে যোগ্যতা নিয়ে আপনি হার্ভার্ড কিংবা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সুযোগ পেতে পারেন, সেই যোগ্যতা দিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সুযোগ আপনি পাবেন না।

দেশের বাইরে শত শত তরুণ পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে, ভাল একাডেমিক রেকর্ড নিয়ে দেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে, অথচ আপনাদের ভূতুড়ে নীতিমালার কড়াজালে তারা আটকা পড়ছে। কারণ, আপনারা ভাল করেই জানেন, এই দেশে প্রভাষক নিয়োগ পেতে হলে, আপনারা সেই মাস্টার্স পাশ করিয়ে নিয়োগ দেবেন। আর এইভাবে শিক্ষার বারটা বাজাবেন। আবার বলবেন, দেশটা মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে।

নীতি নির্ধারকদের দ্বিচারী মনোভাবের কারণে, উচ্চশিক্ষালয়গুলোতে এই ভঙ্গুর দশা। এই দশা সৃষ্টির জন্য আমাদের শিক্ষকরাও দায়ী।

আপনি যদি প্রচলিত অভিন্ন নীতিমালায় কার্যকর করতে যান, তাহলে কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না, শিক্ষক হতে হলে  সিজিপিএ দৌড়ে এগিয়ে থাকতে হবে। যে ছেলে/মেয়ে জিপিএ এইচএসসিতে জিপিএ ৩.৫ দিয়ে ভর্তি  হয় সেই ছেলে/মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিজিপিএ ৪ স্কেলে ৩.৯ পেলেও শিক্ষক হতে পারবে না- কেবল এইচএসসি ও এসএসসির ফলাফল কম থাকার কারণে। আবার এইচএসসি/এসএসসিতে ভাল ফলাফল থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য সিজিপিএ ৩.৫ নিচে ফল করার  জন্য নিয়োগ পাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতার সাথেও শিক্ষক নিয়োগবিধি সাংঘর্ষিক, যা অনেকটা প্রতারণার সামিল।

তাছাড়া, সহকারী, সহযোগী কিংবা অধ্যাপক হওয়ার যে নিয়মনীতি ‘অভিন্ন শিক্ষক’ বিধি কিংবা চলমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতি নীতির গ্রহণযোগত্যা নিয়ে প্রশ্ন করা অবান্তর হবে না।

যে ছেলেটি ১০ বছর গবেষণা করলো, ভালো জার্নালে পেল প্রকাশনা, সেই ছেলেটি কিভাবে আপনাদের নিম্ন মাধ্যমিক/মাধ্যমিকের আদলে লিখিত পরীক্ষা দেবে? এটার প্রয়োজনীয়তা কি? বিসিএস যেভাবে নেয়া হচ্ছে, সেটিই তো প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়া, সেখানে আমলা নির্ভর এই অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার কমিটির সদস্যেদের করা লিখিত পরীক্ষা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এরচেয়ে বড়জোড় শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের অতীত গবেষণার উপর প্রেজেন্টশন নেয়া যেতে পারে, মৌখিক পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। এর বেশি কিছু কাম্য নয়।  

এই যে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, তাদের রাজনীতি/অর্থনীতির ধস নামুক কিংবা উঠুক তাতে সেই দেশের শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতার বিন্দু পরিমাণ হেরফের হয় না।

একাডেমিক ফলাফলে যদি ৩০ মার্ক দেয়া হয়, তবে বাকী ৭০ ভাগ থাকে প্রার্থীদের প্রকাশিত গবেষণা সাময়িকীর উপর, গবেষক হিসেবে অভিজ্ঞতার উপর। এই নম্বর দেয়াটি প্রার্থীদের মধ্য থেকে জার্নাল বা সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত গবেষণাপত্র সাইটেনশন, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরগুলোর যোগফলের উপর নির্ভর করে।

এন্ট্রি পদে নিয়োগ পেতে হলে যেখানে মাস্টার্স ডিগ্রি ও সিজিপিএকে মোক্ষম ধরা হচ্ছে. সেখানে বাইরের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে প্রার্থীকে অবশ্যই পিএইডি ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। বড় দেশগুলোর কথা বাদ দিলাম, এই এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যেমন ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, মালয়শিয়ার মতো দেশগুলোতে পিএইচডি ও প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

তামাম দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের জন্য একই নীতি অনুসরণ করা হয়, সেই ক্ষেত্রে আমরা কেন পিছিয়ে যাব?

কেন আপনারা শিক্ষক নিয়োগে কেন উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনায় গুরুত্ব দেন না? একজন প্রাইমারি শিক্ষককে তো লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় বসতে হয়, সেই ক্ষেত্রে আপনাদের কেবল মৌখিক পরীক্ষা নির্ভর নিয়োগ দেয়া কখনোই যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত হতে পারে না।

দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান যেমন এক হওয়া উচিত তেমনি শিক্ষক নিয়োগে একই পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিত। কিছুতেই ছোট/বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাপকাঠি ধরে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়। মানসম্মত শিক্ষক যেমন মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা উপহার দিতে পারে, তেমনি যোগ্যতার শীতলতার সুযোগে স্বজনপ্রীতির দণ্ডে এগিয়ে দেয়া কখনো সুখবর হতে পারে না।

‘অভিন্ন শিক্ষক’ নিয়োগ আইডিয়া মোটেই খারাপ কিছু নয়। তবে যে প্রস্তাবনা আসতে যাচ্ছে, সেটি কখনো বাস্তবতার নিরিখে হচ্ছে না। একজন শিক্ষক নিয়োগে সবচেয়ে কম যে যোগ্যতা হওয়া উচিত তাহলো- তার পিএইচডি ডিগ্রি আছে কিনা সেটি দেখা এবং দ্বিতীয় যোগ্যতা যেটি থাকা উচিত তাহলো- প্রকাশিত গবেষণাপত্র সংখ্যা। খসড়ায় প্রকাশিত গবেষণাপত্রের কথা বলা হলেও সেটির মানের বিষয়ে কোন কিছু বলা হয়নি।

বর্তমানে মানহীন/ইমফ্যাক্ট ফ্যাক্টর বিহীন অনেক প্রকাশনা দিয়ে এই দেশে শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়েছেন, এমনকি অন্যের প্রকাশনা মেরে দিয়ে নিজেদের পদোন্নতি পাওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। আমরা সেইদিকে আর না যাই। এইবার সময় এসেছে বিষয়টিকে সংশোধনের। পিয়ার রিভিউ ছাড়া কোন প্রকাশনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ডে রাখা উচিত নয়।

আবার প্রকাশনার সংখ্যা বাড়িয়ে যে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে সেটিও যথেষ্ট নয়। একজন প্রার্থীর ফার্স্ট অথরশিপের প্রকাশনাকে যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি ধরা প্রয়োজন। কতটি প্রথম অথর হিসেবে প্রকাশনা রয়েছে, সেইগুলোর মোট ইমফ্যাক্ট ফ্যাক্টর ও সাইটেশনকে গুরুত্ব দেয়া উচিত।

যারা পিএইচডি করছে, পোস্ট ডক করছে, ভালো পাবলিকেশন থাকছে, এরচেয়ে কিভাবে তাদের এইচএসসি/এসএসসির যোগ্যতাকে মুখ্য ধরা যেতে পারে।

অন্যদিকে ভাল জার্নাল পেতে হলে, প্রয়োজন ভাল গবেষণা। আর গবেষণার জন্য দরকার বরাদ্দ। সরকার যদি মনে করেন, কেবল পড়াশোনা করানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রয়োজন, তাহলে প্রাইমারি, হাইস্কুলের মতো সমন্বিত শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষক নিয়ে নিক।

আর এইজন্য দরকার সরকারের যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত। আজকে যদি দেশেই গবেষণার খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে যে ছেলেগুলো থিসিস করে শিক্ষক হচ্ছে, তাদেরকে পিএইচডি করেই শিক্ষক হিসেবে নেওয়া কঠিন কিছু হবে না। আমরা চাই শিক্ষার মানের পরিবর্তন হোক। এইভাবে গলাটিপে উচ্চশিক্ষাকে মেরে না ফেলে, এখন বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা দোষের কোন বিষয় নয়, এটার সংশোধন এনে দক্ষ একাডেমিশিয়ানে ভরে উঠুক আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে এগিয়ে যাক নতুন প্রজন্মের উচ্চশিক্ষা।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ