• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

মানবিকতা চর্চায় সার্থক হোক রমজান

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০২০  

মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল হালিম হেলালী
রমজান এমন একটি মাস, যে মাসে শারীরকি মানসকি ও আত্মিকভাবে সুস্থ থাকা সহজ। রমজানের রোজা আমাদরে এ সুযোগ এনে দিয়েছে। যারা রমজানের রোজার বিধান যথাযথ পালন করবেন তারা শারীরকি মানসকি ও আত্মকিভাবে উপকৃত হবনে।

রোজা নিয়ে এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও ডায়টে বশিষেজ্ঞরাও কথা বলছনে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই রোজার নাম দিয়েছেন ‌অটোফেজি'। এর উপকারিতা নিয়ে গবষেণা করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওশোমি। কারণ রোজার যে উপকারতিা, তিনি তা বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা করে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন।

গত বছরের মতো এবারও রমজানের রোজা গ্রীষ্মকালে এসেছে। এজন্য আমাদরে বিশেষভাবে আল্লাহ্‌র শুকরয়িা আদায় করা উচিত। কারণ এই র্দীঘ সময়ের রোজা শরীররে জন্যে অনকে বেশি উপকারি। এ বছরও প্রায় পনের ঘণ্টা খাবার-পাণীয় পরিহার করতে হবে। এ দীর্ঘ সময় খাবার ও পাণীয় থেকে বিরত থাকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক-

আমাদরে দেহকোষগুলোতে নিয়মিত টক্সিন ও বিষাণু সৃষ্টি হয়। আর এর দেহকোষগুলো যতক্ষণ র্পযন্ত বাহির থেকে খাবার পায় সে খাবার খেতে থাকে। আর যত খাবার পাবে তত সে খতেে থাকবে। কিন্তু যখন র্দীঘসময় রোজা রাখার কারণে বাহির থেকে খাবার পায় না। ফলে এ দেহকোষগুলো ক্ষুধার্ত হয়ে যায়।

আমাদের যেরকম বেশি ক্ষুধা লাগলে খাবারের মান নিয়ে কোনো বাছবিচার করি না। যা পাই, তা-ই খাই। তেমনি দেহকোষগুলো যখন ক্ষুধায় আক্রান্ত হয়, তখন ভালো-মন্দ বিচার করে না। দেহের ভেতরে থাকা বিষাণুগুলোকেই তারা খেয়ে ফেলে। ফলে দেহের ভেতরে জমতে থাকা টক্সিনগুলো দূর হয়ে যায়।

যে টক্সিনগুলো ছিল দেহের আবর্জন, সেগুলোকেই দেহকোষ তখন হজ করে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়াটির সেরা মুহূর্ত হচ্ছে রোজার ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা খাবার ও পাণীয় থেকে বিরত থাকার সময়। তাই গ্রীষ্মের র্দীঘ সময়ের রোজা শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারি।

এবারের রমজান আরেকটি কারণে মানুষের মানসিক ও আত্মিক উন্নতির সুযোগ করে দিতে পারে। বর্তমানে মহামারি করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ, আতঙ্ক, অমানবিকতা ও বিশ্বাসহীনতা বা ঈমানের দুর্বলতাও বিরাজ করছে। এসব থেকে নিজে বের হওয়ার এবং অন্যকে বের করার চমৎকার সুযোগ হচ্ছে রমজান।

রমজানের এ সুযোগে তারাই ভাগ্যবান হবেন যারা কুরআনের মধ্যে ডুবে গিয়ে নিজেদের মানবিকতার পুনরুত্থান ঘটাতে পারবেন। প্রকৃত অর্থে তারা ঈমানদারও হতে পারবেন। আর একজন ঈমানদার বা বিশ্বাসী মানুষ যেমন কখনো অমানবিক আচরণ করতে পারে না। তেমনি মনুষ্যত্বকেও বিসর্জন দিতে পারে না।

মনুষ্যত্বের কতটা অভাব হলে একজন মা তার এক ছেলের লাশ নিয়ে সৎকার করার জন্য চিৎকার করছে অথচ তার অন্য ছেলেরা আপন ভাইয়ের লাশ সৎকারে এগিয়ে আসছে না। অথচ মা তার ছেলের লাশ নিয়ে দীর্ঘ ২১ ঘণ্টা বসেছিলেন! যেখানে রাসুলের আরাবির ঘোষণা হলো- মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।'

কত অমানুষ হলে, কত আতঙ্ক পাগল হলে ৫০ বছরের বৃদ্ধা মাকে সকালে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে গভীর রাতে জঙ্গলে ফেলে রেখে যেতে পারে।

কত অমানুষ হলে সাত বছরের একটি শিশু প্রতিবেশির ঘরের দরজায় গিয়ে কাকুতি মিনতি করছে যে, ‘আমার বাবাবাকে একটু হাসপাতালে নিয়ো যান।’ কিন্তু কেউ তাকে সহযোগিতা করেনি। ফলে ঘরেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। মৃত্যুর পরও দাফন-কাফনেও এগিয়ে আসেনি প্রতিবেশিরা।

ভয় আতঙ্ক র্স্বাথপরতা অমানবকিতা কোন স্তরে পৌছেছে! কোন জাহেলিয়াতে আমরা প্রবেশ করেছি!

আল্লাহ তাআলা সুরা মুলক-এ উল্লেখ করেন-

‘তোমাদরে মধ্যে সৎ কর্মে কে অগ্রগামী তা পরীক্ষার জন্যই তিনি জীবন সৃষ্টি ও মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন।’-এ থেকেও বোঝা যায়, জীবন ও মৃত্যুর পুরো বিষয়টিই আসলে আমাদের জন্য এক মহা পরীক্ষা।

প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের এ সময়টা নিঃসন্দেহে একটি বড় পরীক্ষা। সৎ কর্মে কে অগ্রগামী হতে পারবে আর কে মানুষের ক্ষতি করে মন্দ কাজে অগ্রগামী হচ্ছে তা মহান আল্লাহ ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছেন।

এ পরিস্থিতিতে বেশি বেশি মানব কল্যাণমূলক কাজ করে আমরা অগ্রগামী হয়ে থাকবো কিনা তা আমাদেরই ভেবে দেখতে হবে।

করোনাভাইরাসকে আমরা আমাদের মনুষ্যত্ব মাপার কিচ বলতে পারি। করোনা নামক কিট দিয়ে আমরা মাপতে পারি আমরা আসলেই মানুষ কিনা? আমাদের মধ্যে মানবিকতা আছে কিনা? নাকি আমরা জাহেলিয়াতে আক্রান্ত বর্বর অমানুষ?

মানুষের মনুষ্যত্বের প্রমাণ হচ্ছে তার সহমর্মিতা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরার্থপর ও সহমর্মী।

একজন মানুষ আসলেই মানুষ কিনা তার প্রমাণ হচ্ছে তার সহমর্মিতা, সমব্যথিতা, তার দয়া, তার মমতা। অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার মানসিনকতা, সাহায্য করার মানোভাব। সেই হচ্ছে মানুষ, যে অন্যের বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারে।

বিপদে এগিয়ে আসার মানসিকতা, সাহায্য করার মানোভাব। সেই হচ্ছে মানুষ। অন্যের বিপদে সাহায্য করতে যে এগিয়ে আসতে পারে। মুমূর্ষ প্রতিবেষিশর পাশে যে দাঁড়ায় না সে কি মানুষ? রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখেও যে এগিয়ে আসে না, সে কি মানষ?

দাফনের জন্য যে খাট দেয় না সে কি মানুষ? যে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায় না বা বিপন্ন প্রাণের পাশে দাঁড়ায় না, তাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের আলোকে তাঁর উম্মত ভাবার সুযোগ নেই।

আজকের সমাজবিচ্ছিন্ন স্বার্থকেন্দ্রিক অমানুষ হওয়ার পেছনে বোধ করি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারী এক শ্রেণির বিবেক বিবর্জিত মানুষ। তাদের নেতিবাচক আগ্রাসন ও ভয়ংকর প্রভাব তার ফলাফল হচ্ছে এ অমানবিকতা। স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে অসাধূ শ্রেণি-গোষ্ঠী গুজব ও মিথ্যাচার ছড়ানো পেছনেও ভূমিকা রাখছে।

কুরআনুল কারিম আরবের জাহেলিয়াত থেকে আরববাসীদের মুক্ত করেছিল। গত মাসাধিক কালব্যাপী আমরা সমাজের যে জাহেলিয়াতের রূপ প্রত্যক্ষ করছি তা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথও হচ্ছে পবিত্র কুরআনুল কারিম।
সমজের এসব অমানবিকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হচ্ছে কুরআন। আল্লাহর রহমতে প্লাবিত হওয়ার পথ হচ্ছে কুরআন। আপনি যত বেশি কুরআন অধ্যয়ন করবে, ততই আপনার দেহ-মন-আত্মা নিরাময় হতে থাকবে।

এ ভয়-আতঙ্ক ও অমানবিকতার যে পাগলামি ও জাহেলিয়াত তা থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে পারবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যারা বিশ্বাস ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদের যথাযথ পুরস্কারের পাশাপাশি অনুগ্রহ করে আরো অতিরিক্ত দান করেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৭৩)

রমজান মাসে যেখানে এমনিতেই যে কোনো ভালো কাজের পুরস্কার সত্তর থেকে সাতশ গুণ বেশি, সেখানে বৈশ্বিক মহামারির সময়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণ করার পুরস্কার আল্লাহর কাছে কতো বেশি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

প্রকৃতপক্ষে যারাই এ সময়ে মানবিকতার পুনরুত্থান ঘটাবেন, তারাই এ রমজানে সবচেয়ে ভাগ্যবান বলে বিবেচিত হবেন। তাই সাধ্যমতো মানুষের কল্যাণে কাজ করা, নেতিবাচক আলোচনা করা ও শোনা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

নিয়মিত সঙ্ঘবদ্ধভাবে দান-সহযোগিতা করা। অহেতুক আতঙ্কিত না হয়ে অন্যকেও আতঙ্কমুক্ত থাকতে সহযোগিতা করার প্রতি মনোযোগী হওয়া।

বিশেষ করে রমজানের শুদ্ধাচার যত অনুসরণ করবেন, রমজানের করণীয়-বর্জনীয়গুলো যত সুন্দরভাবে পালন করবেন, ততবেশি শারীরিক মানসিক কল্যাণ আপনি লাভ করবেন।

সব পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। যিনি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন তিনি কখনো স্বার্থপর অমানবিক হতে পারেন না। আর স্বার্থপর অমানবিক ব্যক্তি কখনো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হতে পারে না। বরং বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো নিঃস্বার্থ মানুষই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রকৃত উম্মত।

তাই আসুন আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে রমজানের ফজিলত ও মর্যাদা লাভে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলো যথাযথ মেনে চলি। গুজব পরিহার করি। রমজানের করণীয় ও বর্জনীয়গুলো যথাযথ অনুশীলন করি। মানবিক গুণাবলী অর্জনে যত্নশীল হই। আল্লাহর সান্নিধ্য ও ক্ষমা লাভে বেশি বেশি মানবিকতায় ব্রতী হই। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমিন।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ