• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

রাসূলের (সা.) এর নিকট উত্তম যে ব্যক্তি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৮ জুন ২০২০  

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নিজেকে রাসূলুল্লাহর (সা.) একজন খাদেম হিসেবে উৎসর্গ করেন। রাসূল (সা.)-ও তাকে খাদেম হিসেবে নিয়োগ করেন। সেইদিন থেকে এ সৌভাগ্যবান বালক ছাগলের রাখালী থেকে সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠতম মানুষের খাদেমে পরিণত হন।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ছায়ার মতো নিজের মনিবকে অনুসরণ করেন। সফরে বা ইকামতে, গৃহের অভ্যন্তরে বা বাইরে সব সময় তিনি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন। রাসূল (সা.) ঘুমালে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন, গোসলের সময় পর্দা করতেন, বাইরে যাবার সময় জুতো পরিয়ে দিতেন, ঘরে প্রবেশের সময় জুতো খুলে দিতেন এবং তাঁর লাঠি ও মিসওয়াক বহন করতেন। তিনি যখন হুজরায় অবস্থান করতেন তখনও তাঁর কাছে যাতায়াত করতেন। রাসূল (সা.) তাঁকে যখনই ইচ্ছা তাঁর কামরায় প্রবেশ এবং কোনো প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংকোচ না করে তাঁর সব বিষয় অবগত হওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ কারণে তাকে ‘সাহিবুস সির’ বা রাসূলুল্লাহর (সা.) সব গোপন বিষয়ের অধিকারী বলা হয।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ নবী-গৃহে প্রতিপালিত হন, তাঁকে অনুসরণ করেন এবং তাঁরই মতো আচার-আচরণ, ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন। এ কারণে তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হিদায়াত প্রাপ্তি, আচার-আচরণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তিনিই হচ্ছেন রাসূলুল্লাহর (সা.) নিকট উত্তম ব্যক্তি।’

ইবনে মাসউদ খোদ রাসূলাল্লাহর (সা.) শিক্ষালয়ে শিক্ষালাভ করেন। তাই সাহাবীদের মধ্যে যারা কোরআনের সবচেয়ে ভালো পাঠক, তার ভাব ও অর্থের সবচেয়ে বেশি সমঝদার এবং আল্লাহর আইন ও বিধি-বিধানের সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ, তিনি ছিলেন তাদেরই একজন।

একবার হজরত ওমর (রা.) আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘আমীরুল মুমিনীন! আমি কুফা থেকে এসেছি। সেখানে আমি দেখে এসছি, এক ব্যক্তি নিজের স্মৃতি থেকেই মানুষকে কোরআন শিখাচ্ছেন।’ একথা শুনে তিনি এত রাগান্বিত হলেন যে, সচরাচর তাকে তেমন রাগ করতে দেখা যায় না। তিনি উটের হাওদার অভ্যন্তরে রাগে ফুলতে থাকেন। তারপর প্রশ্ন করেন- তোমার ধ্বংস হোক! কে সে লোকটি?’

–‘আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ।’

জ্বলন্ত আগুনে পানি ঢেলে দিলে যে অবস্থা হয়, ইবনে মাসউদের নাম শুনে তারও সে অবস্থা হলো। তার রাগ পড়ে গেল। তিনি স্বাভাবিক অবস্তা ফিরে পেলেন। তারপর বললেন, তোমার ধ্বংস হোক! আল্লাহর কসম, এ কাজের জন্য তার চেয়ে অধিক যোগ্য কোনো ব্যক্তি বেঁচে আছে কিনা আমি জানি না। এ ব্যাপারে তোমাকে আমি একটি ঘটনা বলছি।’ ওমার (রা.) বলতে লাগলেন, ‘একদিন রাতের বেলা রাসূল (সা.) আবু বকরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। তাঁরা মুসলমানদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে ছিলাম। কিছু সময় পর রাসূল (সা.) বের হলেন, আমরাও তাঁর সঙ্গে বের হলাম। বেরিয়েই আমরা দেখতে পেলাম, এক ব্যক্তি মসজিদে নামাজে দাঁড়িয়ে; কিন্তু আমরা তাকে চিনতে পারলাম না। রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তার কোরআন তিলাওয়াত শুনলেন। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ‘যে ব্যক্তি বিশুদ্ধভাবে কোরআন পাঠ করে আনন্দ পেতে চায়, যেমন তা অবতীর্ণ হয়েছে, সে যেন ইবন উম্মু আবদের পাঠের অনুরূপ কোরআন পাঠ করে।’ এরপর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বসে দোয়া শুরু করলেন রাসূল (সা.) আস্তে আস্তে তাকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন, ‘চাও, দেয়া হবে, চাও, দেয়া হবে।’

ওমর (রা.) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আগামীকাল প্রত্যুষেই আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের নিকট গিয়ে তার দোয়া সম্পর্কে রাসূলের (সা.) মন্তব্যের সুসংবাদটি তাকে দেব। সকাল সকাল আমি তার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি আবু বকর সিদ্দীক (রা.) আমার আগেই তার কাছে পৌঁছে গেছেন এবং তাকে সুসংবাদটি দিয়ে ফেলেছেন। সত্যিই যখনই কোনো সৎকাজে আবু বকরের সঙ্গে আমি প্রতিযোগিতা করেছি তখন তিনিই প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজয়ী হয়েছেন।

আল্লাহর কিতাব কোরআনের জ্ঞানে তিনি কতখানি পারদর্শী ছিলেন সে সম্পর্কে তার নিজের একটি মন্তব্য এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, ‘যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই সেই আল্লাহর কসম! আল্লাহর কিতাবের এমন কোনো একটি আয়াত নাজিল হয়নি যে সম্পর্কে আমি জানিনা যে, তা কোথায় নাজিল হয়েছে এবং কি সম্পর্কে নাজিল হয়েছে। আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে আমার থেকে অধিক পারদর্শী কোনো ব্যক্তির কথা আমি যদি জানতে পারি এবং তার কাছে পৌঁছা সম্ভব হয়, তাহলে আমি তার কাছে উপস্থিত হই।’

নিজের সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ যে কথাটি বলেছেন তাতে অতিরঞ্জন নেই। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা পাঠকদের কাছে তুলে ধরা সমীচীন বলে মনে করি। একবার হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কোনো এক সফরে রাত্রিবেলা একটি অপরিচিত কাফিলার সাক্ষাত লাভ করেন। রাতের ঘোর অন্ধকারে কাফিলার কোনো লেকজনকে দেখা যাচ্ছিল না। ঘটনাক্রমে সেই কাফিলায় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদও ছিলেন; কিন্তু ওমর (রা.) তা জানতেন না। ওমর (রা.) একজন লোককে তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, কাফিলা কোথা থেকে আসছে? অন্য কাফিলা থেকে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ জবাব দিলেন-

– ‘আমীক উপত্যকা থেকে।’

– ‘কোথায় যাচ্ছে?’

– ‘ইলাল বাইতিল আতীক- বাইতুল আতীকে (অর্থাৎ কাবা শরিফে)।’ জবাব শুনে ওমর (রা.) বললেন, ‘নিশ্চয় তাদেরমধ্যে কোনো আলেম ব্যক্তি আছেন।’ তিনি আবার জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘কোরআনের শ্রেষ্ঠতম আয়াত কোনটি?’

– ‘আল্লাহু লাইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম, লা তাখুজুহু সিনাতুন ওয়ালা নাওম’- সেই চিরন্তন চিরঞ্জীব সত্তা আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। তন্দ্রাও তাকে স্পর্শ করেনা এবং নিদ্রাও তাঁকে পায়না।’

– ‘সর্বাধিক ন্যায়-নীতির ভাব প্রকাশক আয়াত কোনটি?’

– ‘ইন্নাল্লাহা ইয়া’মুরু বিল আদলি ওয়াল ইহসানি ওয়া ইতায়িজিল কুরবা’- আল্লাহ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, পরোপকার এবং নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদেরকে দান করার নির্দেশ দিচ্ছেন।’ আবার প্রশ্ন হলো,

– ‘সর্বাধিক ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত কোনটি?’

– ‘ফামাই ইয়া’মাল মিসকালা জাররাতিন খাইরাই য়ারাহ, ওয়ামাই ইয়া’মাল মিসকালা জার্‌রাতিন শাররাই য়ারাহ’- ‘যে ব্যক্তি এক বিন্দু পরিমাণ সৎকজ করবে সে তার বিনিময় লাভ করবে, তেমনিভাবে যে ব্যক্তি এক বিন্দু পরিমাণ অসৎকাজ করবে তার বিনিময়ও সে লাভ করব।’

– ‘সর্বাধিক ভীতিপ্রদ আয়াত কোনটি?’

– ‘লাইসা বআমানিয়্যিকুম ওয়ালা আমানিয়্যি আহলিল কিতাবি মান ই’মাল সুআন ইউজযা বিহি ওয়ালা ইয়াজিদ লাহু মিন দুনিল্লাহ ওয়ালিয়্যান ওয়ালা নাসীরান’- ‘না তোমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, আর না আহলে কিতাবদের কামনা-বাসনা অনুযায়ী সবকিছু হবে। যে ব্যক্তি খারাপ কাজ করবে তাকে তার প্রতিফল ভোগ করতে হবে। আর আল্লাহ ছাড়া তার জন্য আর কোনো অভিভাবকও পাবে না এবং কোনো সাহায্যকারীও না।’

‘সর্বঅধিক আশার সঞ্চারকারী আয়াত কোনটি?’

– ‘কুল ইয়া ’ইবাদিল্লাজীনা আসরাফু ’আলা আনফুসিহিম লা-তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহু ইন্নাল্লাহা ইয়াগফিরজ্জুনুবা জামীয়া। ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম’- ‘হে নবী আপনি বলুন। হে আমার বান্দারা, যারা নিজের ওপর বাড়াবাড়ি করছো, আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব পাপই ক্ষমা করে দেবেন। তিনিই তো গাফুরুর রাহীম।’

– ‘আচ্ছা আপনাদের মাঝে কি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আছে?’

– হ্যাঁ।’

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কেবল একজন ভালো ক্বারী, আলেম, আবিদ ও যাহিদিই ছিলেন না, সেইভাবে তিনি ছিলেন একজন কর্মঠ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি এবং কঠিন বিপদ মুহূর্তে অগ্রগামী একজন মুজাহিদ। তার জন্য এ গৌরবটুকুই যথেষ্ট যে, রাসূলুল্লাহর (সা.) পর তিনিই ভূ-পৃষ্ঠের প্রথম মুসলিম যিনি প্রকাশ্যে কুরাইশদের মাঝে কোরআন পাঠ করেছিলেন।

রাসূলুল্লাহর (সা.) সাহাবিরা একদিন মক্কায় একত্রিত হলেন। তারা তখন সংখ্যায় অল্প ও দুর্বল। নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করলেন, ‘আল্লাহর শপথ, প্রকাশ্যে কোরআন তিলাওয়াত করে কুরাইশদেরকে কখনও শুনানো হয়নি। তাদেরকে কোরআন শোনাতে পারে এমন কে আছে?’

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন, ‘আমিই তাদেরকে শোনাবো।’ অন্যরা বললেন, ‘তোমার ব্যাপারে আমাদের ভয় হচ্ছে। আমরা এমন এক ব্যক্তিকে চাই, যার লোকজন আছে, কুরাইশরা তার ওপর কোনরূপ অত্যাচার করতে চাইলে তারা তখন বাধা দিতে পারবে।’ ইবনে মাসউদ বললেন, ‘আমাকে অনুমতি দিন। আল্লাহ আমাকে হেফাজত করবেন।’ একথা বলে তিনি মসজিদের দিকে রওয়ানা হলেন এবং মধ্যাহ্নের কিছু আগে মাকামে ইব্রাহিমে এসে পৌঁছলেন। তিনি মাকামে ইব্রাহিমের নিকট দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কোরআন তিলাওয়াত শুরু করলেন, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আররাহমানু আল্লামাল কোরআন, খালাকাল ইনসানা আল্লামাহুল বায়ান……।’

তিনি তিলাওয়াতে করে যেতে লাগলেন। কুরাইশরা শুনে ক্ষণিকের জন্য চিন্তা করলো। তারপর একে অপরকে প্রশ্ন করলো, ‘ইবন উম্মু আবদ কি বলে? তার সর্বনাশ হোক! মুহাম্মাদ যা বলে তাই তো সে পাঠ করছে।’ তারা সবাই উঠে তার দিকে ধেয়ে গেল এবং তার মুখে নির্দয়ভাবে মারতে লাগলো। এ অবস্থায় আল্লাহ যতটুকু চাইলেন ততটুকু তিনি তিলাওয়াত করলেন। তারপর রক্তাক্ত দেহে সংগীদের কাছে ফিরে এলেন। তারা বললেন, ‘আমরা এরই আশংকা করছিলাম।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহর শত্রুরা এখন আমার কাছে অতি তুচ্ছ যা আগে ছিল না। আপনারা চাইলে আগামী কালও আমি এমনটি করতে পারি।’ তারা বললেন, ‘না, যথেষ্ট হয়েছে। তাদের অপছন্দনীয় কথা তুমি তাদেরকে শুনিয়ে দিয়েছ।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ইসলাম গ্রহণ করার পর কুরাইশদের অত্যাচারের শিকারে পরিণত হন। বাধ্য হয়ে দুইবার হাবশায় হিজরত করেন। অবশেষে মদিনায় চিরদিনের জন্য হিজরত করে চলে যান। মদিনায় প্রখ্যাত আনসারী সাহাবি হজরত মুয়াজ ইবন জাবালের অতিথি হন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আসার পর তাদের দু’জনের মধ্যে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন এবং তার বসবাসের জন্য মসজিদে নববীর পাশে একখণ্ড ভূমি দান করেন

রাসূলুল্লাহর (সা.) সঙ্গে সব গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বদর যুদ্ধে দু’জন আনসারী যুবক ইসলামের কট্টর দুশমন আবু জাহলকে হত্যা করে ময়দানে ফেলে আসে। যুদ্ধ শেষে রাসূল (সা.) বললেন, ‘কেউ যেয়ে আবু জাহলের অবস্থা একটু দেখে আস তো।’ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ দৌড়ে চলে গেলেন। আবু জাহলের প্রাণস্পন্দন তখনও থেমে যায়নি। আবদুল্লাহ তার দাড়ি সজোরে মুট করে ধরে বললেন, ‘বল, তুই আবু জাহল কি না।’

উহুদ, খন্দক, হুদাইবিয়া, খাইবারসহ মক্কা বিজয়েও তিনি রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথী ছিলেন। হুনাইন যুদ্ধে কাফিরদের অতর্কিত আক্রমণে দশ হাজারের মুসলিম বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। মাত্র আশিজন যোদ্ধা নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে রাসূলুল্লাহর (সা.) চতুষ্পার্শে অটল থাকেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ সেই আশিজনের একজন। এ যুদ্ধে রাসূল (সা.) মুশরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে যে এক মুঠো ধূলো নিক্ষেপ করেছিলেন, রাসূলুল্লাহর (সা.) হাতে তা তুলে দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ওফাতের পর দীর্ঘদিন যাবত সব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকেন। তবে হজরত ওমরের (রা.) খিলাফতকালে হিজরি ১৫ সনে তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। জিহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ইয়ারমুক যুদ্ধে বেরিয়ে পড়েন এবং বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

হিজরি ২০ সনের খলিফা ওমর (রা.) তাকে কুফার কাজী নিয়োগ করেন। কাজীর দায়িত্ব ছাড়াও বায়তুল মাল, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং কুফার ওয়ালীর উযীরের দায়িত্বও তার ওপর ন্যস্ত করা হয়।

পুরো দশ বছর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এতগুলো দায়িত্ব তিনি পালন করেন। এ দীর্ঘ সময়ে খলিফা ওমরের (রা.) শাহাদাত বরণ, হজরত উসমানের খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণসহ কুফার ওয়ালীর রদবদল হয়েছে, কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ স্বীয় পদে বহাল থাকেন। খলিফা উসমানের খিলাফতের শেষ পর্বে আবদুল্লাহকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি সংগীসাথী ও পরিবার পরিজনসহ কুফা থেকে হিজাযের দিকে যাত্রা করেন। পথে মরুভূমিতে ‘রাবজা’ নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবু যার গিফার (রা.) সেখানে অন্তিম শয্যায়। তার পৌঁছার অল্পক্ষণ পরেই আবু যার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তার জানাযার নামাজে ইমামতি করেন এবং কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে তিনি মক্কা চলে যান এবং ওমরা আদায় করে মদিনায় পৌঁছেন। বাকী জীবন মদিনায় চুপচাপ কাটিয়ে দেন।

হিজরি ৩২ সনে আবদুল্লাহর বয়স যখন ষাট বছরের ওপরে, হঠাৎ একদিন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলতে লাগলো, ‘আল্লাহ আমাকে আপনার জানাযা থেকে বঞ্চিত না করুন। গতরাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি, রাসূল (সা.) একটি মিম্বরের ওপর আর আপনি তাঁর সামনে। তিনি আপনাকে বলছেন, ‘ইবনে মাসউদ, আমার পরে তোমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়া হয়েছে। এস, আমার কাছে চলে এস। এ স্বপ্ন সত্যে পরিণত হলো। এ অল্প কিছুদিন পরেই তিনি রোগে আক্রান্ত হন এবং সেই রোগেই মারা যান।

হজরত উসমানের (রা.) খিলাফতকালে পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। তিনি যখন অন্তিম রোগ শয্যায়, তখন উসমান (রা.) একদিন তাকে দেখতে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

– ‘আপনার অভিযোগ কিসের বিরুদ্ধে?’

– ‘আমার পাপের বিরুদ্ধে।’

– ‘আপনার চাওয়ার কিছু আছে কি?’

– ‘আমার রবের রহমত বা করুণা।’

– ‘বহু বছর যাবত আপনার ভাতা নিচ্ছেন না, তা কি আবার দেয়ার নির্দেশ দেব?’

– ‘আমার কোনো প্রয়োজন নেই।’

– ‘আপনার মৃত্যুর পর আপনার কন্যাদের প্রয়োজনে আসবে।’

– ‘আপনি কি আমার কন্যাদের দারিদ্রের ব্যাপারে ভীত হচ্ছেন? আমি তো তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন প্রত্যেক রাতে সূরা ওয়াকিয়া পাঠ করে। কারণ আমি রাসূকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি প্রত্যেক রাতে সূরা আল-ওয়াকিয়া পাঠ করবে, কখনও দারিদ্র তাকে স্পর্শ করবে না।’

দিনশেষে রাত্রি নেমে এলো, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তার রফীকে’আলা- শ্রেষ্ঠতম বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হলেন। খলিফা উসমান তাঁর জানাযার নামাজ পড়ান এবং হজরত উসমান ইবন মাজউনের (রা.) পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

সূত্র: আসহাবে রাসূলের জীবনকথা: ১ম খন্ড

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ