• শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৭ ১৪৩১

  • || ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

সম্মান সুখ্যাতির আকাঙ্ক্ষা ও পরিণতি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০২০  

সম্মান ও সুখ্যাতি আল্লাহ তায়ালার দান। আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। যার থেকে ইচ্ছা ছিনিয়ে নেন। আল কোরআনে এসেছে, ‘আপনি বলুন, ‘হে সাম্রাজ্যের মালিক আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন। আর যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্চিত করেন। আপনারই হাতে সব কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ২৬)।

বর্তমানে যেকোনো কাজের পেছনে বড় উদ্দেশ্য থাকে তা দ্বারা খ্যাতি লাভ করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি বা মানবতার কল্যাণ এখানে তুচ্ছ। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা পাপ। আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের পাপীদের দ্বারা জাহান্নাম উদ্বোধন করবেন। 

রাসূল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্ব প্রথম বিচার হবে এক প্রকার শহিদের। তাকে বিচারের জন্য আনা হবে। শাহাদাতের নেয়ামতসমূহ দেখানো হবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি এই নিয়ামতের জন্য দুনিয়াতে কি কি করেছো? সে উত্তর দেবে, আপনার জন্য লড়াই করে শহিদ হয়েছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি লড়াই করেছো যেন মানুষ তোমাকে যোদ্ধা বলে। তোমার সাহসিকতার খ্যাতি দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। দুনিয়াতে তুমি তা পেয়েছো। এখানে তোমার কোনো অংশ নেই। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর একজন আলেমকে উপস্থিত করা হবে। আলেমের জন্য যেসব  নেয়ামত আছে তা দেখানো হবে। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি দুনিয়ায় থেকে এর জন্য কি করেছো? বলবে, আমি ইলম শিখে তা মানুষকে শিখিয়েছি। আমি আপনার জন্য কোরআন তেলাওয়াত করেছি। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছো। তুমি ইলম শিখেছো, যেন মানুষ তোমাকে আলেম বলে। তেলাওয়াত করেছো, কারী হিসেবে খ্যাতি লাভের জন্য। আর দুনিয়াতে তুমি এগুলো পেয়েছো। তাই এখানে তোমার কোনো অংশ নেই। তারপর জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। একজন সম্পদশালীকেও এই কথাগুলো বলা হবে। ওই রকম প্রশ্ন করা হবে। পূর্ববর্তীদের ন্যায় উত্তর দেবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে বলবেন, তুমি দান করেছিলে দাতা হিসেবে খ্যাতি লাভের জন্য। আমার জন্য না। তাকেও প্রথমে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯০৫)।

মানুষের হৃদয় দূর্গের মতো সংরক্ষিত। হৃদয় দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালার প্রেম-ভালোবাসাকে জায়গা দেয়ার জন্য। শয়তান মানুষের দুশমন। সে মানুষের হৃদয়ে হানা দেয়। ওর প্রবেশের দরজা হচ্ছে মানুষের নৈতিক দুর্বলতাগুলো। কেউ যখন নৈতিক দুর্বলতার শিকার হয়, শয়তান সেগুলোর আশ্রয়ে মানুষের ভিতর প্রবেশ করে। তাই উচিত হলো নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করা। শয়তানের প্রবেশের দরজাগুলোয় মজবুত পাহারার ব্যবস্থা করা। নৈতিক দুর্বলতার অনেক দিক উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন খায়েশাতের অনুসরণ করে চলা। কেউ যখন নিজের খায়েশের পেছনে ছুটে, শয়তান তাকে নিজের কবজায় নিয়ে নেয়। দুর্বলতার আরো দিক হচ্ছে, রাগ, হিংসা, বিদ্বেষ, কাজে তাড়াহুড়া, কৃপণতা ও লোভ ইত্যাদি।

মানুষের ভেতর অনেক ধরনের লোভ থাকে। যেমন কেউ ঘরবাড়ি, আসবাব, পোশাক-আশাকের প্রতি লোভী। তাকে কবজা করার জন্য উপরোক্ত একটা বিষয় ধরিয়ে দিলেই হয়। কেউ থাকে অর্থের লোভী। কেউ থাকে পদ, সম্মান ও সুখ্যাতির প্রতি লোভী। তাকে অর্থ না দিয়ে সম্মানজনক একটা পদ দিলেই যথেষ্ট। মনুষ্যত্বহীন হওয়ার জন্য শুধু লোভ থাকলেই চলে। অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। কথায় আছে, লোভ মানুষকে বধির ও অন্ধ করে ফেলে। লোভ চলে আসলে মানুষের অধিকার, ন্যায়-অন্যায়ের দিকে তাকানোর সুযোগ হয় না।

খ্যাতি অর্জন সম্পর্কে হাদিসের নির্দেশনা:

ইসলাম, খ্যাতিমান হওয়াকেই মানুষের জন্য বিপদ সাব্যস্ত করেছে। কারণ, অনেক সময় খ্যাতি মানুষের ভেতর অহংকার ও দম্ভ সৃষ্টি করে। হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, কারো অনিষ্টতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, খ্যাতির কারণে মানুষ তার দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখায় (যেমন নামাজ পড়ার কারণে সর্বত্র খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। এখন মানুষ তার দিকে ইশারা করে বলে সে খুব নামাজি)। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সুরত দেখবেন না। তিনি দেখবেন তোমাদের হৃদয়ের অবস্থা ও কর্ম।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস: ৫৩১৪)। 

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে হাদিসে অখ্যাত থাকার ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘অনেক ব্যক্তি থাকেন, যারা নিম্ন মানের পোশাক পরেন। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদের অবস্থান হলো, তারা যদি কোনো বিষয়ে কসম করেন, আল্লাহ তায়ালা তার কসম পূরণের ব্যবস্থা করে দেন।’ কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, ‘তাদের দেখে মানুষ ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয়, বিবাহের প্রস্তাব দিলে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তারা খুবই মাকবুল।’ (মেশকাত, হাদিস: ৫২৩১)। 
দরজা লাগানোর ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ বলেন, ‘এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের হৃদয়ে তাদের প্রতি কোনো সম্মান থাকে না। মানুষ তাদের দেখে অভ্যর্থনার জন্য ওঠে আসে না। বরং তারা অখ্যাত। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য রয়েছে উঁচু মাকাম। হজরত ওমর (রা.) একদিন মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে দেখেন, হজরত মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) রাসূল (সা.) এর রওজার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। হজরত ওমর (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কাঁদছো কেনো? হজরত মুআজ (রা.) উত্তর দিলেন, আমি নবী করিম (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘কোন আমলে লোক দেখানোর নিয়ত সামান্য পরিমাণ থাকলেও তা শিরক। আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন মুত্তাকি ও গোপন ব্যক্তিদেরকে। যারা অনুপস্থিত থাকলেও কেউ খুঁজ করে না। উপস্থিত থাকলেও লোকেরা তাকে চিনে না। তাদের অন্তর হচ্ছে হেদায়েতের বাতি। (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস: ৫৩২৮)।

সম্মানের লোভ মানুষের মনে নেফাকি সৃষ্টি করে। রাসূল (সা.) হিজরত করার আগে মদিনাবাসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সুলূলকে মদিনার শাসক বানাবে। ইতোমধ্যে রাসূল (সা.) মদিনায় হিজরত করে চলে আসেন। মদিনাবাসীর সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। তার স্থলে নবী করিম (সা.) মদিনার শাসক হন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বিষয়টিকে কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। এর শোক সে কোনোদিন ভুলতে পারেনি। তাই সারা জীবন সে ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। কারণ ছিলো সে শাসকের মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। আল কোরআনেও সম্মান লাভের প্রত্যাশীদের নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা দুনিয়ার জীবন ও এর সৌন্দর্য কামনা করবে, আমি দুনিয়াতে ওদের আমলের ফল পুরাপুরি দিয়ে দেব এবং এখানে ওদের কম দেয়া হবে না। এরাই ওরা, যাদের জন্য আখেরাতে আগুন ছাড়া কিছু নেই এবং যা কিছু ওরা দুনিয়াতে করেছে, তা বরবাদ হবে এবং যে আমল ওরা করতো তা নিষ্ফল হবে।’ (সূরা: হুদ, আয়াত: ১৫, ১৬)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘এই আখেরাতের শান্তির জীবন আমি তাদেরকে দান করবো যারা দুনিয়াতে সম্মানের আকাঙক্ষা করে না এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। পরিণাম ভালো মুত্তাকিদের জন্য।’ (সূরা: কাসাস, আয়াত: ৮৩)।

সম্মান ও মালের লোভ হিংস্র প্রাণীর মতো। কারো ভেতর তা ঢুকে পড়লে ধ্বংস অনিবার্য। লৌকিকতার আশ্রয় ছাড়া খ্যাতি লাভ করা আল্লাহর নেয়ামত সুখ্যাতির আকাঙক্ষা নিয়ে কোনো কাজ করা নিন্দনীয়। তবে যদি কারো খ্যাতি, কোনো লৌকিকতা ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সমস্যা নেই। তখন তা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ হিসেবে বিবেচ্য হবে। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। ইমাম গাজ্জালি (রাহ.) বলেন, ‘খ্যাতি ও সম্মানের মালিক হওয়া, মালের মালিক হওয়ার মতো। দুনিয়ার অন্যান্য বিষয়ের মতো এটাও মানুষের জীবনের প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়। মৃত্যুর দ্বারা অন্যান্য বস্তু যেমন ব্যক্তি থেকে চলে যায় খ্যাতি ও সম্মানও তেমনি বিদায় হয়ে যায়। দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের ক্ষেত স্বরূপ। দুনিয়াতে যা কিছু আছে, তা থেকে আখেরাতের পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব। দুনিয়াতে থাকতে হলে মালের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া পানাহার ও পোশাক-আশাকের ব্যবস্থা করা অসম্ভব। অতএব, এর জন্য যে পরিমাণ মাল প্রয়োজন, সে পরিমাণ মালের মহব্বত অন্তরে থাকতে পারে। তেমনিভাবে মানুষের কাছ থেকে নিজের অধিকার পেতে চাইলে, মানুষের মনে তার প্রতি সম্মান থাকা দরকার। যে সম্মানের কারণে তার প্রাপ্য অধিকার দেবে। তাই এই পরিমাণ সম্মানিত হওয়ার ফিকির করতে কোনো সমস্যা নেই, যার দ্বারা সহযোগী, শিক্ষক ও শাসকের মনে মর্যাদার একটা আসন তৈরি হয়। আর তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা তার অধিকার দেয়। (ইহয়াহু উলুমিদ দ্বীন, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৬৩)।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সহজে খ্যাতি অর্জন করা যায়। তাই কেউ এই ময়দানে পিছিয়ে থাকতে চাচ্ছে না। অথচ বাস্তব জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও উপেক্ষা করে চলা আমাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষের সেবা, দক্ষতা অর্জন বা অন্য কিছুর কথা বলা হলেও এখানে আত্মপ্রচারই মূল লক্ষ্য থাকে। বাস্তবতার চেয়ে লৌকিকতাই সেখানে প্রাধান্য পায়। ইসলাম মানুষের আচরণ সুন্দর করার গুরুত্ব দিয়েছে। আধ্যাত্মিকতার পরিপন্থি লৌকিকতাকে হারাম করেছে। রাসূল (সা.) এই অধপতনকে কেয়ামতের আলামত হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। তিনি বলেন, ‘শেষ যমানায় এমন মানুষ আসবে, যারা কাজ প্রকাশ করাকে মঙ্গল মনে করবে এবং গোপন করাকে নিজেদের শত্রু  মতো মনে করবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করেন, এটা কীভাবে সম্ভব? রাসূল (সা.) বলেন, এটা তারা করতে পারবে কারো প্রতি মহব্বতের কারণে আর কারো প্রতি শত্রুতার কারণে। (মেশকাত, হাদিস: ৫৩৩০)। অর্থাৎ আল্লাহর জন্য তারা এ রকম করবে না। বরং জাগতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এই রকম করবে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ