• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

সিরিয়ায় অভিনব কূটনীতি

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০১৯  

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আরো একটি সমঝোতার পর সিরিয়ার রণাঙ্গনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। সারসংক্ষেপে বিষয়টিকে বিবৃত করার চেষ্টা করেছি এভাবে—

চতুষ্পক্ষীয় বিজয় নিশ্চিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে মুখ রক্ষা করেছে; তুরস্ক নিশ্চয়তা পেয়েছে, তুর্কি-সিরীয় সীমান্তের নিয়ন্ত্রণে থাকবে সিরিয়ার সেনাবাহিনী। রাশিয়া যুদ্ধবিস্তার রোধ করেছে এবং রাশিয়া-ইরান-তুরস্ক শান্তি প্রক্রিয়াকে সঞ্জীবিত রেখেছে। আর ঘটনাক্রমে পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে সিরিয়া।

ভিয়েতনামের পর সিরিয়াই হয়তো সিআইএর সবচেয়ে বড় পরাজয়ের নাম। কী করে এ বক্তব্যে পৌঁছলাম, দীর্ঘ ইতিহাসের স্কেচ এঁকে সে কথাই বলার চেষ্টা করি এখন। গত মাসে লেবানন, সিরিয়া ও অধিকৃত ফিলিস্তিনের ত্রিসংযোগ এলাকায় এটি আমি অনুভব করেছিলাম—বৈরুতে প্রসিদ্ধ লেবাননি, সিরীয়, ইরানি, রুশ, ফরাসি, ইতালীয় বিশ্লেষকদের সঙ্গে সিরিজ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে; ১৯৯০ সাল থেকে সিরিয়ায় যত সফর করেছি তার পরিপ্রেক্ষিতে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয়রা অটোমান খিলাফতের এ অঞ্চলে ঢোকে। ফরাসিরা পায় সিরিয়া-লেবানন; পরে মারাস ও মসুল (ইরাক) বিলায়েতের নিয়ন্ত্রণ পায়। ফিলিস্তিনকে শাম (লেবন্ত) থেকে আলাদা করা হয়; উদ্দেশ্য এলাকাটিকে আন্তর্জাতিক নজরে আনা। দামেস্ক বিলায়েতের উত্তরাংশ ফ্রান্সের ও দক্ষিণাংশ ব্রিটেনের অধিকারে যায়। সিরিয়া ও লেবাননের খ্রিস্টীয় অঞ্চল আলাদা করা হয় পরে।

সিরিয়া-ইরাক সীমান্ত নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল, প্রাচীনকাল থেকে। সাইকস-পিকো চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসীমার ধারণা আরোপ করে। বিংশ শতকের শুরুর পর্বেও ওই অঞ্চলে কোনো জাতিরাষ্ট্র ছিল না। ১৯২৫ সালে ফরাসিরা আলেপ্পো ও দামেস্ককে একীভূত করলে সিরিয়ায় সুন্নিরা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ১৯২০-এর দশকে ফরাসিরা পূর্ব সিরিয়ার সীমান্তও নির্ধারণ করে। ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির পর তুরস্ক সব অটোমান অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য হয়, তবে তাদের খেলার বাইরে রাখা হয়নি।

শিগগিরই তুর্কিরা ফ্রেঞ্চ ম্যান্ডেটে অনুপ্রবেশ শুরু করে এবং কুর্দি স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বাধাগ্রস্ত করতে শুরু করে। ১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্স আরো ছাড় দেয়—শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯ সালে আলেকজান্দ্রেত্তা সানজাক (বর্তমানে তুরস্কের হাতাই প্রদেশের ইস্কেন্দেরুন) দখল করে নেয় তুরস্ক। এ ঘটনায় হাজার হাজার আর্মেনীয় বাস্তুচ্যুত হয়; সিরীয় জাতীয়তাবাদীদের জন্য এটি ছিল বড় আঘাত।

তুরস্ক, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও অনেক স্থানীয় গোষ্ঠীর স্বার্থের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট সিরিয়া কোনো সম্প্রদায়ের স্বার্থই পুরোপুরি রক্ষা করতে সক্ষম নয়, পারেওনি। বর্তমান যুদ্ধে এত পক্ষের, এত ঝামেলার সূত্র এতেই নিহিত। ১৯৬৩ সালে ধর্মরিপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদী বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭০ সালে ক্ষমতাসীন হন হাফেজ আল আসাদ। তিনি শুধু তাঁর আলাভি সম্প্রদায়ের ওপর নির্ভর না করে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলেন।

এভাবেই সিরিয়ার কাঠামো সংহত করা হয়। তবে সত্তরের দশকেই এতে চিড় ধরে—বড় শহর বনাম দরিদ্র প্রান্ত; পশ্চিম বনাম বেদুইন পূর্ব; আরব বনাম কুর্দি। কিন্তু শহুরে অভিজাতরা কখনো দামেস্কের বিপরীতে যায়নি। বাশার আল আসাদ ক্ষমতাসীন হন ২০০০ সালে। তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার জন্য আলাভিদের ওপর ভরসা করেন। অভ্যুত্থান এড়ানোর জন্যই তিনি এটি করেছেন; কিন্তু এর ফলে তিনি দরিদ্র সিরীয়দের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সিরিয়ায় ‘আরব বসন্ত’-এর শুরু ২০১১ সালের মার্চে। এটি ছিল আলাভি ও দামেস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এটিকে পুরোপুরি বিদেশি স্বার্থে কাজে লাগানো হয়েছে, যদিও বিদ্রোহের শুরুটা ছিল একেবারেই দরিদ্র প্রান্তিক সুন্নি এলাকায়। পশ্চিমারা বুঝতে পারেনি যে এটি সিরীয় জাতির বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল।

যুদ্ধের প্রকৃতি স্পষ্ট হয় ২০১৪ সালে। কুর্দি এবং নানা ধরনের জিহাদি, অপরাধী ও ভাড়াটে সমবেত হয়—কেউ আল-কায়েদায়, কেউ আইএসে। কাউকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে মার্কিনরা; কোনো পক্ষ দ্রুত টাকা কামাতে চেয়েছে। সালাফিদের অর্থ দিয়েছে সৌদি আরব ও কুয়েত। তুরস্ক ঢুকেছে হারানো অটোমান এলাকা পুনরুদ্ধার এবং আসাদকে গদিচ্যুত করতে। এরদোয়ান এ যুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুড ও তুর্কমেন গ্যাঙগুলোকে সংশ্লিষ্ট করেছেন। তিনি কার্যত জিহাদ হাইওয়ে সৃষ্টি করেছেন। আবার তেল চুরির জন্য আইএসের সঙ্গে ধোঁয়াটে সম্পর্ক রেখেছেন।

২০১৫ সালের গ্রীষ্মে (৩০ সেপ্টেম্বর) রণমঞ্চে ঢোকে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফোরাতের উত্তরের এলাকা প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে নিজের অধিকারে রাখা। সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে। মানবিজ থেকে কামিশলি পর্যন্ত কুর্দি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের স্বপ্নও শেষ। তারা এখন দামেস্ক ও রাশিয়ার কাছে সুরক্ষাপ্রার্থী। আরব গোত্রপতিরা প্রচুর সময় ব্যয় করেছেন আসাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য। দামেস্ক ও সিরীয় সেনাবাহিনী এখন বিজয়ী পক্ষ। এখন সিরিয়ার পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখবে চীন, রাশিয়া ও ইরান। তুরস্ককে তেহরান ও মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সিরিয়া সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক : ব্রাজিলীয় সাংবাদিক ও লেখক

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ