• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

সূরা বাকারা: ২৬-৭৯ নম্বর আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩ নভেম্বর ২০১৯  

সূরা বাকারার ২৬-৭৯ নম্বর আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট ও ফজিলত। 

আমরা এখানে সূরা বাকারার ২৬-৭৯ নাম্বার আয়াতসমূহের উল্লেখযোগ্য শানে নুযুল তুলে ধরছি-

إِنَّ اللهَ لاَ يَسْتَحْيِي أَن يَضْرِبَ مَثَلاً مَّا بَعُوضَةً فَمَا فَوْقَهَا فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُواْ فَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ.

অর্থ : আল্লাহ পাক নি:সন্দেহে মশা বা তদুর্ধ্ব বস্তু উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুত যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর মতলবই বা কী ছিল। এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অনেককে বিপথগামী করেন। আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাকেও বিপথগামী করেন না। (আয়াত : ২৬)।

শানে নুযুল : বর্ণিত আছে যখন আল্লাহ তায়ালা কোরআনের মধ্যে মুশরিকদের মাবুদের আলোচনা করতে গিয়ে মশা মাছির উদাহরণ পেশ করলেন, তখন তারা অভিযোগ করল যে, আল্লাহ তায়ালার কোরআনে কারিমের মধ্যে মশা ও মাছির মত নগন্য বস্তুর আলোচনা আল্লাহর শানের পরিপন্থী। এর দ্বারা মূলত তারা কোরআনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করল, তখন আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করেন।

وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلاَئِكَةِ اسْجُدُوْا لِآدَمَ فَسَجَدُوْا إِلاَّ إِبْلِيْسَ أَبٰى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِيْنَن
অর্থ : এবং (সে সময়ের আলোচনা শুন) যখন আমি ফেরেস্তাদেরকে বললাম, আদমকে সেজদা কর! সকলে সেজদা করল, ইবলিস ব্যতীত। সে অমান্য করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। সুতরাং সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।

শানে নুযুল : মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর আহ্কাম কার্যকর করানের জন্য তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে তাঁর মর্যাদা সাব্যস্ত করার লক্ষ্যে ফেরেশতাদেরকে সেজদা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ফেরেশতাগণ সবাই সেজদা করলেও ইবলিস অহংকার করে হচরত আদম (আ:)-কে সেজদা করেনি। সেজন্য আলাহ তায়ালা ইবলিসকে অভিশপ্ত অবস্থায় বেহেশত থেকে বের করে দিলেন। তখন থেকেই ইবলিস হজরত আদম (আ.) এর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করার প্রতিজ্ঞা করল যে, সে হজরত আদম (আ.)-কে বেহেশতে থাকতে দেবে না। এমনকী সে আল্লাহ তায়ালার নিকট দরখাস্ত করে কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকার সুযোগ গ্রহণ করল। অত:পর আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম (আ:)-কে বিভ্রান্ত করার জন্য কী পদ্ধতি নিলো এবং ফল দাঁড়ালো ইত্যাদি বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে।

أَتَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَتَنسَوْنَ أَنفُسَكُمْ وَأَنتُمْ تَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلاَ تَعْقِلُونَ
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও, এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভুলে যাও অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা করা না।
(আয়াত-৪৪)।

শানে নুযুল : হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। উক্ত আয়াতটি ইহুদি ওলামায়ে কেরামের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। ইহুদি ওলামায়ে কেরাম তাদের নিকটতম মুসলিম আত্মীয়দের বলত তোমরা দ্বীনে মোহাম্মদের ওপর অটল থাক। কেননা এটা সত্য ধর্ম। কিন্তু নিজেরা ঈমান আনতো না। তাদের এই দ্বিমুখী আচরণের জবাবে এই আয়াত নাজিল হয়।

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ.
অর্থ : নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, তাদের মধ্যে থেকে যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। (আয়াত-৬২):

শানে নুযুল : এই আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে হজরত সালমান ফারসী (রা.) বলেন যে, একবার আমি হুজুর (সা.) এর সামনে আমার সাবেক ধর্মের বন্ধু-বান্ধবদের দ্বীননদারি সম্পর্কে আলোচনা করলাম। তখন হুজুর (সা.) বললেন, তারা জাহান্নামী। একথা শুনার পর মনে হলো যে, আমার ওপর অন্ধকার নেমে আসল। আমি পেরেশান হয়ে গেলাম। তখন এই আয়াত নাজিল হয়। (ইবনে কাসীর)।

وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ الَّذِينَ اعْتَدَواْ مِنكُمْ فِي السَّبْتِ فَقُلْنَا لَهُمْ كُونُواْ قِرَدَةً خَاسِئِينَ.
অর্থ : সে লোকদের সম্পর্কে তোমরা ভালো করে জানো, যারা শনিবারকে ব্যবহারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিলো। আমি তাদেরকে বলেছিলাম, তোমরা ঘৃণিত বানর হয়ে যাও।

শানে নুযুল : হজরত মূসা (আ.) ইবাদতের জন্য জুমার দিন নির্দিষ্ট করেন; কিন্ত বনী ইসরাঈল তার বিরোধিতা করে এবং শনিবার দিন ইবাদতের জন্য পছন্দ করে। তারা যুক্তি দেখিয়ে বলল, আলাহ তায়ালা আসমান জমিনকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন, শনিবার দিন কোনো কাজ করেননি। আমরাও ওই দিন কোনো কাজ করব না। কাজেই তাদেরকে বলা হলো ঠিক আছে তোমরা ওই দিন ইবাদত করবে, কোনো কাজ করবে না, এমনকী মাছও শিকার করবে না। তারা নদীর তীরে অবস্থিত ঈলা নামক চরে বসবাস করত। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে শনিবারেই প্রচুর মাছের সমাগম ঘটান। তারা লোভ সামলাতে না পেরে কৌশলিপন্থায় মাছ শিকার শুরু করে। নদীর তীরে গর্ত খোদাই করে নদীর নালার সঙ্গে সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেয়, এতে শনিবারে আগত প্রচুর মাছ সে গর্তে আটকা পড়ে যেত। এরপর রবিবার দিন তারা সে মাছ শিকার করত। আর বলত আমরা শনিবার মাছ শিকার করিনি। সে ঘটনা আলোচনা প্রসঙ্গে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়।

أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُواْ لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلاَمَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِن بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ.
অর্থ : হে মুসলিমরা! তোমরা কি লোভ করো যে, এরা তোমাদের কথায়ই ঈমান আনবে? অথচ এদের এক সম্প্রদায় আল্লাহর কালাম শুনে এবং তারা জেনে বুঝে তা বিকৃত করে।

শানে নুযুল : নবী করিম (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরাম আশা করতেন যে, ইহুদীরা মহানবী (সা.) এর উপদেশ শুনে সত্যধর্ম গ্রহণ করবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, হেদায়েত আল্লাহর হাতে, আল্লাহ-ই ভালো জানেন কার তাকদীরে হেদায়েত আছে আর কার তাকদীরে নেই। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিরাশ করে বলছেন- যখন তারা এরূপ বড় বড় নিদর্শন দেখে ও নিজেদের অন্ত:করণ কঠিন পাথরের মতো করে নিয়েছে, আল্লাহর কালাম শুনে বুঝে তাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বিকৃত করেছে তাদের কাছে তোমরা কি আশা করতে পার? এ প্রসঙ্গেই বর্ণিত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (আয়াত-৭৫)।

وَإِذَا لَقُواْ الَّذِينَ آمَنُواْ قَالُواْ آمَنَّا وَإِذَا خَلاَ بَعْضُهُمْ إِلَىَ بَعْضٍ
অর্থ : যখন তারা মুসলমানদের সাসঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে আমরা মুসলমান হয়েছি। আর যখন পরস্পরের সঙ্গে নিভৃতে অবস্থান করে, তখন বলে, পালনকর্তা তোমাদের জন্য যা প্রকাশ করেছেন, তা কি তাদের কাছে বলে দিচ্ছ? তাহলে যে তারা এই নিয়ে পালনকর্তার সামনে তোমাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। তোমরা কি তা উপলব্ধি করা না? (আয়াত-৭৬)।

শানে নুযুল : একবার রাসূল (সা.) কুরাইজা দুর্গ অবরোধ কালে দূর্গের নিচে দাঁড়িয়ে ইহুদীদেরকে লক্ষ করে বললেন, হে বানরের সন্তান! যেহেতু কোনো এক সময় ইহুদীরা বানর হয়ে গিয়েছিল আর এই ইহুদীরা ছিল তাদেরই বংশধর, তাই রাসূল (সা.) তাদেরকে বানরের সন্তান বলেছেন। নবীজির (সা.) মুখে এরকম গালী শুনে তারা আশ্চর্য হয়ে গেল। কারণ তাদের ধারনা ছিল যে, আমাদের পূর্ব পুরুষের এই কলংকের খবর কেউ জানেন না, তাহলে মুহাম্মাদ (সা.) জানলো কি করে? নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে কেউ এই গোপন তথ্য গোমর ফাস করে দিয়েছে। তাই তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগল তোমরা এই ঘটনাটি বলে দিচ্ছ নাকি ? তাহলে তারা তোমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ করার সুযোগ পেয়ে যাবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয়।

وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لاَ يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلاَّ أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَظُنُّونَ.
অর্থ : এদের কিছু লোক মূর্খ যারা (তাওরাতের) জ্ঞান রাখে না। তারা কিছু মিথ্যা আকাক্সক্ষা পোষণ করে। আর তাদের কাজ হচ্ছে সন্দেহ ও অমূলক ধারণা পোষণ করা। (আয়াত-৭৮)

শানে নুযুল : হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝা যায়, উপরিউক্ত ইহুদি সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচ্য আয়াত নাজিল করা হয়েছে। কারো মতে মাজুস বা অগ্নিপূজারীদের সম্পর্কে আলোচ্য আয়াত নাজিল করা হয়েছে। হজরত আলী (রা.) ও এ মত পোষণ করেছেন। কারো মতে আলোচ্য আয়াত ইহুদী ও মুনাফিক স ম্প্রদায় সম্পর্কে নাজিল করা হয়েছে।

فَوَيْلٌ لِّلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَذَا مِنْ عِندِ اللَّهِ لِيَشْتَرُواْ بِهِ ثَمَناً قَلِيلاً فَوَيْلٌ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا يَكْسِبُونَ.
অর্থ : অতএব, ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজের হাতে কিতাব লেখে অত:পর (লোকদেরকে) বলে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। এর বিনিময়ে তারা তুচ্ছ মূল্য অর্জন করে। তাদের জন্য শাস্তি অবধারিত সেই রচনার জন্য যা তারা হাত দিয়ে লিখেছে। এবং ধ্বংস ও শাস্তি তার জন্য, এর বিনিময়ে তারা যা উপার্জন করেছে। (আয়াত-৭৯)।

শানে নুযুল : আলোচ্য আয়াত ইহুদি পণ্ডিতদের সম্পর্কে নাজিল করা হযেছে। ঘটনা প্রবাহ হচ্ছে যে, ইহুদিদের মধ্যে থেকে একটি দল, যারা তাদের কিতাবসমূহে রাসূল (সা.) এর বর্ণিত গুনাবলি ও চরিত্রের বর্ণনাসমূহকে পরিবর্তন করে ফেলে, রাসূল (সা.) এর গঠন-আকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁকে লম্বাকৃতিতে একজন আদম সন্তান রূপে পরিচয় করিয়ে করে। অত:পর তাদের অনুসারীদেরকে বলত যে, দেখ সর্বশেষে যে আদর্শে নবী আগমন করবেন, হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর মাঝে সে চরিত্র ও গুণ নেই। এমন কী ইহুদী পণ্ডিতদের ভয় ছিল যে, নবীর গুণাবলী ও পরিচিতি বর্ণনা যদি যথাস্থানে থেকে যায়, তাহলে তাদের তাদের হাদিয়া তোহফা বন্ধ হয়ে  যাবে। সে জন্য নবীর গুণাবলির বর্ণনা পরিবর্তন করে দেয়। তাদের পক্ষ থেকে সত্যকে গোপন করার ভয়াবহ পরিণতির বর্ণনা করা সম্পর্কে আলোচ্য আয়াত নাজিল করা হয়েছে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ