• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

সেরা ফিল্ডার : মাশরাফির চোখে এক নম্বর সাকিব

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৪ জুলাই ২০২০  

উত্তরটা যেন তৈরিই ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজার। সেরার বাছাইয়ে ভাবনার সাগরে ডুব দিতে হলো না বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই দশকের হৃদ্ধ অভিযাত্রীকে। দেশের সবসময়ের সেরা ফিল্ডার নিয়ে কথোপকথনের শুরুতেই মাশরাফির ঝটপট উত্তর, ‘সেরা তো অবশ্যই সাকিব।’

ধারাবাহিক আয়োজনে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা ফিল্ডার। বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে ফিল্ডিং বরাবরই গুরুত্ব পেয়েছে তুলনামূলক কম, বিশ্বমানের ফিল্ডারও তাই গড়ে উঠেছে কমই। যারা ভালো ছিলেন, তাদের মধ্য থেকেই সেরাদের বেছে নিচ্ছেন দেশের বর্তমান ও সাবেক ক্রিকেটাররা।

তিনটি ক্যাটেগরিতে আলাদাভাবে সেরার পাশাপাশি বাছাই করা হচ্ছে সার্বিকভাবে সেরা। আয়োজনের পঞ্চদশ পর্বে মাশরাফি জানালেন তার পছন্দ।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে প্রায় ২০ বছর ধরে বিচরণ মাশরাফির। মাঠের ভেতরে-বাইরে থেকে দেখেছেন অনেককে। নেতৃত্বের দীর্ঘ সময়েও অনেককে জেনেছেন আরও ভালো করে। তিনি নিজেও ফিল্ডিংয়ে সেরাদের একজন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণ থেকে মাশরাফি বেছে নিলেন তার মতে সেরাদের।

স্লিপে:

“ স্লিপে সেরা জুনায়েদ সিদ্দিক। বাংলাদেশে আমরা স্লিপ ফিল্ডার যাদের পেয়েছি, জুনায়েদই সবচেয়ে ভালো। রানিংয়ে খুব ভালো ছিল না ও, এ কারণেই হয়তো স্লিপে বেশি পরিশ্রম করেছে।”

“ বাংলাদেশে উইকেট বলেন বা বোলিংয়ের সার্বিক অবস্থা, স্লিপে তো বল আসেই কম। স্লিপ ফিল্ডারদের কঠিন পরীক্ষায় সেভাবে পড়তে হয় না। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তেমন পাওয়া যায় না। এজন্য প্র্যাকটিস করে করেই মূলত স্পেশালিস্ট হতে হয়। আমাদের বাস্তবতায়, স্লিপে ক্যাচ নেওয়ার ক্ষেত্রে মোটামুটি নিরাপদ হওয়াটাই অনেক। জুনায়েদ এগিয়ে থাকবে, কারণটা সিম্পল, ক্যাচ কম ছেড়েছে ও।”

৩০ গজ বৃত্তে :

“ বৃত্তের ভেতর নিঃসংশয়ে এগিয়ে থাকবে সাকিব। সবচেয়ে নিরাপদ হাত বরাবরই তার।”

“ খুব প্রচলিত ধারনার বাইরে একটা কথা আমি বলি। বৃত্তের ভেতর অনেকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে গতিকে। দ্রুততা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমি বেশি জরুরি মনে করি রিফ্লেক্স, পরিস্থিতি অনুযায়ী সাড়া দেওয়া এবং নিরাপদ হাত থাকা। এই তিনটিই সাকিবের খুব ভালো।”

“ ক্যাচিং বলুন বা গ্রাউন্ড ফিল্ডিং, সাকিবের মতো নিরাপদ হাত আমাদের দেশে আর দেখিনি। ওর আশপাশ দিয়ে বল পার হতে পারে কমই। খুব চটপটে ও প্রাণবন্ত থাকে মাঠে, যে কোনো পরিস্থিতিতে দারুণ তৎপর। ওর আশেপাশে বল গেলে ব্যাটসম্যানের রান নেওয়ার সুযোগ থাকে সামান্যই। খুবই ক্ষিপ্র সে, বল পিক করে খুব পরিষ্কার, রিলিজ করে চোখের পলকে। আর নিশানা তো দুর্দান্ত।”

“ থ্রোয়িংই সাকিবের সবচেয়ে বড় শক্তি। এখানে সে দেশের সবার চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। ওর এটা অসাধারণ এক ক্ষমতা। ২০টি থ্রো করলে ১৫টিই হয়তো সরাসরি স্টাম্পে লাগবে।  এই জায়গায় সত্যি বলতে সাকিব বিশ্বের শীর্ষ ফিল্ডারদের একজন। সরাসরি স্টাম্পে হিট করার ক্ষেত্রে হয়তো রিকি পন্টিংয়ের কথা বলবেন, বা মাইকেল ক্লার্ক,  আমি মনে করি সাকিবও এই সামর্থ্যে একই কাতারে থাকবে।”

“ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে (২০০৯) সনাৎ জয়াসুরিয়াকে করা সেই রান আউটের কথা মনে করুন। ডাইভ দিয়ে বল ধরেছে, ওই অবস্থায়ই থ্রো করেছে গুলির বেগে। জয়াসুরিয়া চমকে গেছে। বিশ্বের সেরা ফিল্ডারও অমন ফিল্ডিংয়ে গর্ববোধ করার কথা। ৯ বছর পর ২০১৮ এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে রহমত শাহকে রান আউট করেছে একইরকম অসাধারণ ফিল্ডিংয়ে। এমন নয় এসব হুট করে হয়ে গেছে। অনুশীলনে-ম্যাচে সে নিয়মিতই স্টাম্পে লাগায়।”

“ বয়সের সঙ্গে অবশ্যই রিফ্লেক্স কিছুটা কমেছে। তার পরও তার ওপর নির্ভর করা যায় চোখ বন্ধ করে। এখনও সে দলের সেরা ফিল্ডারদের একজন।”

“ বৃত্তের ভেতরে দারুণ আরও কিছু ফিল্ডার আমরা পেয়েছি। রাজিন সালেহ দুর্দান্ত ছিল, আফতাব আহমেদ, নাসির হোসেন খুব ভালো ছিল। সাব্বির রহমান ভালো এখন। তবে আমরা কথা বলছি সবসময়ের সেরা নিয়ে। সাকিব লম্বা সময় খেলেছে এবং নিজের মান ধরে রেখেছে। অবশ্যই সে সেরা।”

সীমানায় :

“ একটা সময় সীমানায় আমি অনেক ফিল্ডিং করেছি। আফতাব করেছে। এখন মাহমুদউল্লাহ, সৌম্য সরকার খুব ভালো করছে। তবে আমার মতে সেরা তামিম ইকবাল।”

“ আমি জানি, ফিল্ডার তামিমের কথা বললেই দুটি ক্যাচ ছাড়ার কথা মনে পড়ে অনেকের। ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, গত বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে। অনেক সমালোচনাও হয়েছে এসব নিয়ে। কিন্তু এটাও মনে রাখা উচিত, বাউন্ডারিতে বাংলাদেশের সেরা ক্যাচগুলোর বেশ কটিই তামিমের। সেরা ফিল্ডারদেরও ক্যাচ মিস হতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে ধারাবাহিক যে, তাকেই তো এগিয়ে রাখতে হবে!”

“ বাউন্ডারিতে ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও গতিকে বেশি গুরুত্ব দেন অনেকে। আমি মনে করি, এখানে আরও বেশি প্রয়োজন নির্ভরতা। তামিমের গতি হয়তো চোখধাঁধানো নয়। তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ফিল্ডার সে।”

“ বাউন্ডারিতে তামিমের দুটি বিশেষত্বের কথা বলব আমি। প্রথমত, সে ‘ফিয়ারলেস।’ ফিল্ডিংয়েও কিন্তু ভয়ডরহীন ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় আছে, ফিল্ডার হয়তো আগেই হাল ছেড়ে দেয় বা যথেষ্ট চেষ্টা করে না। বলের কাছেই যাবে না, কিংবা কাছাকাছি গেলেও ডাইভ দেবে না। তাহলে আর ক্যাচ মিস করার ভয় নেই! কিন্তু তামিম কখনোই হাল ছাড়ে না। সে বল তাড়া করে, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্যাচ নেওয়ার চেষ্টা করে।”

“ বল তাড়া করে শেষ পর্যন্ত ক্যাচ নিতে না পারলে কোচের বকা, লোকের গালি খাওয়ার ভয় থাকে। কিন্তু তামিম সেটিকে পাত্তা না দিয়ে দলের কথাই ভাবে, চেষ্টা করে সর্বোচ্চ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলও হয়। যারা টেকনিক্যাল দিকগুলো বোঝেন, তারা এটা ভালো বুঝতে পারবেন।”

“ দ্বিতীয় যে কারণে তামিম এগিয়ে, তাকে নিয়ে বোলারদের দৃষ্টিভঙ্গি। ফিল্ড পজিশনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাউন্ডারির ফিল্ডারদের ক্ষেত্রে বোলারদের রায় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। টিম মিটিংয়ে বলুন বা মাঠের ভেতরে, সব বোলারই তামিমকে চায় সীমানায়। সেই ভরসা ও আস্থার জায়গা সে অর্জন করে নিয়েছে।”

“ পাওয়ার প্লে শেষে সীমানায় ফিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে লং অফ, লং অন ও মিড উইকেট বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটা পজিশনের জন্য সব বোলারই নিশ্চিন্তে তামিমকে ধরে রাখে। অন্য দুই পজিশন নিয়ে হয়তো কথা চলে যে কাকে রাখা যায়। বোলাররা এটা জানে, তামিম চেষ্টার কোনো কমতি রাখবে না। এই সবকিছু মিলিয়েই তামিম সবচেয়ে এগিয়ে।”

সব মিলিয়ে সেরা:

“ চোখ বন্ধ করে সেরা সাকিব। বৃত্তের ভেতর তার দক্ষতার কথা তো বলেছিই। সে দুর্দান্ত অলরাউন্ড ফিল্ডারও।”

“ কোন পজিশনে সে ফিল্ডিং করেনি! সব জায়গায়ই খুবই নিরাপদ। এখনও ওকে বাউন্ডারিতে ফিল্ডিংয়ে পাঠালে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। একটা পজিশনেই হয়তো খুব বেশি ফিল্ডিং করেনি, গালিতে। এমনকি স্পিন বলে স্লিপেও যখন ফিল্ডিং করেছে, খুব ভালো করেছে। সোহাগ গাজীর হ্যাটট্রিক উইকেটের ক্যাচটি যেমন অসাধরণ ছিল। পেস বলে অবশ্য স্লিপে কখনও ফিল্ডিং করেছে বলে মনে হয় না। তবে সাকিব যে ধরনের ক্রিকেটার, আমার মনে হয়, চেষ্টা করলে গালি বা পেস বোলিংয়ে স্লিপেও সে ভালো পারবে! সব মিলিয়ে সে প্রায় পরিপূর্ণ ফিল্ডার।”

“ সেরার বাছাইয়ে আরেকটা ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ, কে কত লম্বা সময় সেরা মান ধরে রেখেছে। ভালো ফিল্ডার আমরা বেশ কিছু পেয়েছি। কেউ কেউ হয়তো কোনো একটা নিদির্ষ্ট সময় বা দুই-তিন-চার বছর খুব ভালো ফিল্ডিং করেছে। সাকিব এক যুগ ধরে টপক্লাস ফিল্ডিং করে চলেছে। এত লম্বা সময় মান ধরে রাখাই ওকে সবার চেয়ে এগিয়ে নিয়েছে।”

“ হ্যাঁ, অবশ্যই একই মান সবসময়ই থাকেনি। ফিল্ডিংয়েও ভালো-খারাপ দিন আসে। কিন্তু একটা স্ট্যান্ডার্ড সাকিবের সবসময়ই ছিল। মনে করার চেষ্টা করুন, ক্যারিয়ারে কয়টা ক্যাচ ছেড়েছে? বড়জোর দু-তিনটা মনে করতে পারবেন হয়তো। এক যুগের ক্যারিয়ারে এটা দারুণ ব্যাপার।”

“ দ্বিতীয় সেরা ফিল্ডারের কথা বলতে গেলে হয়তো আমাকে অনেক ভাবতে হবে। বেশ কিছু নাম আসবে। রাজিন সালেহ শর্ট লেগে, সিলি পয়েন্টে দারুণ ছিল। আমার মনে আছে, যখন আমাদের কেউ ওসব জায়গায় দাঁড়াতে চাইত না অস্বস্তির কারণে, রাজিন সালেহ বুক চিতিয়ে বলেছে, ‘আমি করব।’ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফিল্ডিং করে গেছে ওখানে। অন্যান্য জায়গাতেও ভালো ছিল সে, অলরাউন্ড ফিল্ডার ছিল।”

“বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ও ঘরোয়া ক্রিকেটে নাদিফ চৌধুরি একসময় দারুণ ছিল। আফতাব ভালো ছিল। অনেকেই হয়তো জানেন না বা মনে নেই, ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েক বছর আব্দুর রাজ্জাক দুর্দান্ত ফিল্ডার ছিল। পরে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিটা ওর ক্ষতি করে দেয়। নাসির, সাব্বির, সৌম্য, ওরাও ভালো।”

“ তবে আবারও বলছি, এখানে সর্বকালের সেরার আলোচনা হচ্ছে। আবেগ দিয়ে ভাবলে চলবে না। দুই-তিন বছর সেরা থাকার ব্যাপার এটি নয়। দীর্ঘ সময় ধরে ম্যাচের পর ম্যাচ কাটাছেঁড়া ও বিশ্লেষণ করলে, সাকিবের চেয়ে ভালো আমি কাউকে দেখি না।”

“ আরেকজনের কথা বলব বিশেষভাবে। যাকে এখনই হয়তো দুইয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে পারি। আফিফ হোসেন। অবিশ্বাস্য গতিময়। এত দ্রুত বলের কাছে ছুটে যেতে আমি বাংলাদেশে কাউকে দেখিনি, বিশ্ব ক্রিকেটেও খুব কম দেখেছি। অন্যরা যদি বলের কাছে ৫ সেকেন্ডে যেতে পারে, আফিফ সেখানে ২-৩ সেকেন্ডে চলে যায়। তার মানে ৩-৪ মিটার এগিয়ে থাকে সে।”

“এমন কিছু সেভ আমি ওর দেখেছি, যা কেবল অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা-নিউ জিল্যান্ডের ফিল্ডারদের আমরা করতে দেখি। ফিল্ডিংয়ে আফিফ একটা সিরিয়াস ট্যালেন্ট, খুবই সম্ভাবনাময়। গতির দিক থেকে আমি বলব, এখন বিশ্বক্রিকেটেই সে সবচেয়ে গতিময়দের একজন। আমার মনে হয় না, শীর্ষ ফিল্ডার আমরা যাদের বলি, তারাও ওর বয়সে এতটা গতিময় ছিল। ফিটনেস দুর্দান্ত। ওর মতো শরীর আমি কমই দেখেছি, ‘এইট প্যাক’। ব্যাটে-বলে ঠিক পথে থাকলে আফিফ যেমন সাকিবের মতো হতে পারে, তেমনি লম্বা সময় নিজেকে ধরে রাখতে পারলে পন্টিং-ডি ভিলিয়ার্সদের মানের ফিল্ডার আমরা পাব।”

“ তবে এখনই ওকে সেরার কাতারে রাখছি না, কারণ যথেষ্ট পরীক্ষিত নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক চাপের মুহূর্ত আসবে, বড় ম্যাচ খেলতে হবে। দর্শকের চাপ থাকবে। ব্যাটে-বলের নিজের খারাপ সময় আসবে। মিডিয়ার চাপ থাকবে। ওই সময়টায় নিজের মনোযোগ ধরে রাখা, মাঠে একইরকম প্রাণবন্ত থাকা, মানের হেরফের হতে না দেওয়া, এসব গুরুত্বপূর্ণ।”

“ সেরা হওয়ার সব উপকরণ আফিফের আছে। তবে যেটা বললাম, অনেক দূর যেতে হবে। অনেক পথ পাড়ি দিয়েই এখনও পর্যন্ত সেরা সাকিব।”

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ