• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

‘হজ’ একটি সার্বিক ইবাদত

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩ জুলাই ২০২০  

‘হজ’ ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি বা স্তম্ভ। এটি হচ্ছে বান্দার ওপর মহান আল্লাহ তায়ালার হক। যারা বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি ও সামর্থ্য রাখে, তাদের জন্য আল্লাহর হক আদায় করা ফরজ।

হজের আভিধানিক অর্থ:

হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ সঙ্কল্প করা বা জিয়ারতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় হজের অর্থ হচ্ছে সেই সার্বিক ইবাদত, যা একজন মুমিন ব্যক্তি পবিত্র বায়তুল্লাহ শরিফে পৌঁছে সম্পন্ন করে থাকে। মুসলমানরা আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ জিয়ারতের সঙ্কল্প করে থাকে বিধায় একে হজ বলা হয়।

হজের মহত্ত্ব ও গুরুত্ব:

হজের মহত্ত্ব ও গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে হজের হিকমত, ইসলামি বিধানের মধ্যে হজের মর্যাদা এবং হজের মহত্ত্ব ও গুরুত্বের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষের ওপর আল্লাহর এ অধিকার যে, বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার শক্তি ও সামর্থ্য যে রাখে সে যেন হজ করে এবং যে এ হুকুম অমান্য করে কুফরি আচরণ করবে, তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ বিশ্ব প্রকৃতির ওপর অবস্থানকারীদের মুখাপেক্ষী নন।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)।

কোরআনের এ আয়াতে দু’টি সত্যের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত করা হয়েছে-

(১) হজ হচ্ছে বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক। যারা বায়তুল্লাহ পর্যন্ত যাওয়ার শক্তি ও সামর্থ্য রাখে, তাদের জন্য আল্লাহর হক আদায় করা ফরজ। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ করে না, তারা আল্লাহর হক নষ্ট করে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, হে লোকেরা! তোমাদের ওপর হজ ফরজ করা হয়েছে। অতএব, তোমরা হজ আদায় করো। (সহি মুসলিম)।

(২) হজের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ হক হচ্ছে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করা একটি কুফরি আচরণ। যেমন বলা হয়েছে। ঠিক যেভাবে কোরআনে নামাজ ত্যাগ করাকে এক স্থানে মুশরিকি কার্যকলাপ বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নামাজ কায়েম করো এবং মুশরিকদের মধ্যে শামিল হয়ো না।’ (সূরা: রুম, আয়াত: ৩১)। 

নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির কাছে হজের জরুরি খরচের অর্থসামগ্রী মজুদ আছে, যানবাহন আছে যার দ্বারা সে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, তারপরও সে হজ করে না, তাহলে সে ইহুদি হয়ে মরুক অথবা খ্রিষ্টান হয়ে মরুক তাতে কিছু আসে যায় না। এ থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি, সামর্থ্য থাকার পর যদি কেউ হজ না করে তাহলে তার আচরণকে কুফরি আচরণ বলা হয়েছে এবং তাকে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সুন্দর সুষ্ঠুভাবে হজ সম্পাদনকারী ব্যক্তিকে জন্মদিনের মতো নিষ্পাপ বলা হয়েছে।

হজের প্রতিদান জান্নাত:

হজের পুরস্কার হচ্ছে জান্নাত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি হজ করে তার মধ্যে অশ্লীল ও অন্যায় আচরণ করেনি, সে নিজের গুনাহ থেকে তার জন্মদিনের মতো মুক্ত ও পাক পবিত্র হয়ে ফিরে যায়। (সহি বুখারি ও মুসলিম)।

অন্য একটি হাদিসে আছে, কোনো ব্যক্তির হজ কবুল হলে তার জন্য মহাপুরস্কার হচ্ছে জান্নাত। নবী করিম (সা.) এ প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন; এক ওমরাহ থেকে আর এক ওমরাহ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন গুনাহর কাফফারা হয়। আর কবুল হওয়া হজের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত। (সহি আল বুখারি)।

‘হজ’ একটি সার্বিক ইবাদত: 

ইসলামে দুই ধরনের ইবাদত রয়েছে-

(এক) দৈহিক ইবাদত। যেমন নামাজ, রোজা ইত্যাদি দৈহিক ইবাদত।

(দুই) আর্থিক ইবাদত। যেমন জাকাত, সাদকা, দান-খয়রাত ইত্যাদি আর্থিক ইবাদত। 

কিন্তু হজ একটি ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে। এ ইবাদত একই সঙ্গে জান ও মালের ইবাদত। অর্থাৎ হজ একটি দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত। অন্যান্য ইবাদতের দ্বারা তাকওয়া, বিনয়, এখলাস, নম্রতা আনুগত্য, ত্যাগ ও আত্মসমর্পণ, কোরবানি, আল্লাহর নৈকট্য হাসিল ইত্যাদির ভাবাবেগ ও প্রেরণা বিকশিত হয়। আর হজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উপর্যুক্ত সব অনুভূতি একই সঙ্গে তৈরি হয় ও বিকশিত হয়। এ জন্য হজকে সার্বিক ইবাদতও বলা হয়। সুতরাং মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও জান্নাত লাভের প্রত্যাশায় প্রত্যেক সচ্ছল ব্যক্তির জন্য এ ইবাদত পালন করা অবশ্য কর্তব্য।

হজের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি এখলাসের সঙ্গে তাওহিদের ঘোষণা দিয়ে থাকেন। হজের মাধ্যমে জালিম শক্তির বিরাট প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে মুসলিমরা ঈমান, এখলাস, তাকওয়া এবং মহান আল্লাহর প্রতি ভালবাসার প্রেরণা পেয়ে থাকেন। ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তারা নিরঙ্কুশ ও ভেজালমুক্ত আল্লাহর আনুগত্য প্রতিষ্ঠা ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক প্রেরণা ও নেক আমলের মাধ্যমে ইসলামের পরিপূর্ণ ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হন।

প্রতি বছর হজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নতুন করে স্মরণ করার জন্য এবং মানুষের মাঝে আবেগ, অনুভূতি ও উচ্ছ্বাস সৃষ্টির জন্য পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে ঈমান, ইসলাম ও তাওহিদের প্রেমানুগ মানুষেরা পবিত্র বায়তুল্লাহতে জমায়েত হয়ে এমন সব কিছু করে থাকেন, যা মুসলিম জাতির পিতা ও পথ প্রদর্শক হজরত ইব্রাহিম (আ.) করেছিলেন।

মুসলমানরা দুই খণ্ড সাদা কাপড় পরিধান করে অত্যন্ত আবেগ ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে থাকেন। কখনো সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী অংশে দৌড়ান। কখনো আরাফাতের বিশাল ময়দানে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনায় মশগুল থাকেন। কখনো মিনা ও মুজদালিফায় অবস্থান করেন। কোনো সময় জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন এবং কখনো কোরবানিগাহে পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল ও ভালবাসার শপথ গ্রহণ করে থাকেন।

চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে প্রতিক্ষণে মুমিনদের কণ্ঠে বায়তুল হারামের সমগ্র পরিবেশ মুখরিত হতে থাকে এ বাক্যের মাধ্যমে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ানি’মাতা লাকাল মুলক লা-শারিকা লাকা।’ প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার ব্যক্তি নিজেকে পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর ওপর সোপর্দ করার নামই হজ।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ