• বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

২০২৩, বাংলাদেশের সুফল পাওয়ার বছর

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৭ জানুয়ারি ২০২৩  

বাংলাদেশের জন্য ২০২২ সালটা ছিল বিশ্বকে অবাক করে দেওয়ার বছর। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ পরিচয় পাওয়া বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের শিখরে অবস্থান করছে। এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বড় মেগা প্রকল্প নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের পর এক এক করে মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ করে জনসাধারণের জন্য তা খুলে দেওয়া হয়েছে। বছরের প্রথমার্ধে জুনে পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পরে বছরের শেষ দিকে এসে খুলে দেওয়া হলো স্বপ্নের আরেক মেগা প্রকল্প ‘মেট্রোরেল’। এর মধ্য দিয়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে আরেকটি মাইলফলক। এই দুটি উন্নয়ন প্রকল্প জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে খুলে দেওয়া হয়েছে কালনা সেতু। এর পরে একসঙ্গে খুলে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের ১০০ সেতু। সব মিলিয়ে উন্নয়নের রেকর্ড করার বছর ২০২২।

সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বছরের মাঝামাঝি সময় ২৫ জুন নতুন ভোর শুরু করেছে বাংলাদেশে। এদিন আনুষ্ঠনিকভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে পদ্মা সেতুর দুয়ার। ২৫ জুন পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজের হাতে টোল পরিশোধ করে সেতুর উপর দিয়ে পদ্মা নদী পার হয়ে ওপারের জাজিরায় কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন তিনি। পরেরদিন ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে এই সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর পাইলিং ও নদীশাসনের কাজ উদ্বোধন করেন। এরপর একে একে সব ধাপ পেরিয়ে পদ্মার বুকে ৪২টি পিলারের ওপর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে স্বপ্নের সেতু। এ সেতু চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জিডিপি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে।

এর আগে এই সেতুকে আরও অর্থবহ করতে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল। করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত সারাবিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ছিল না বাংলাদেশ। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন। এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা প্রান্ত থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে সাধারণভাবে সময় লাগছে মাত্র ৪২ মিনিট। আর ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে সময় লাগবে ২৭ মিনিট।

জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক) এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার অংশের কাজ। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এসে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। মোট ১১ হাজার ৩কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ হয়। চার লেনের এই এক্সপ্রেসওয়েটি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন-এসডব্লিউও (পশ্চিম)। সেতুর দুই পাশে ধীর গতির যানবাহন চলাচলের জন্য সাড়ে ৫ মিটার প্রশস্ত সড়ক রাখা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে টোল আদায় শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে রবিবার (২৬ জুন) সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এ আদেশ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যেটি ২৭ জুন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। সরকারের ‘টোল নীতিমালা ২০১৪ অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে টোল হার নির্ধারণের পূর্ব পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কের (এক্সপ্রেসওয়ে) টোল হার (মিডিয়াম ট্রাক) সমন্বিতভাবে প্রতি কিলোমিটার ১০ টাকা হারে নির্ধারণ করা হলো। এতে অর্থ বিভাগের সম্মতি রয়েছে। পরবর্তীতে টোল নীতিমালা ২০১৪ অনুসারে যথাসময়ে টোল হার চূড়ান্ত—ভাবে নির্ধারণ করা হবে।’ ‘জনস্বার্থে এ আদেশ ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর বুধবার জনসাধারণের জন্য দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে রাজধানীতে সরকারের আরেক মেগাপ্রকল্প মেট্রোরেলের। বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেলের দুয়ার ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্মুক্ত করেন। পরেরদিন ২৯ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) সকাল ৮টা থেকে সাধারণ যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে মেট্রোরেল। সাধারণ যাত্রীদের নিয়ে মেট্রোরেল প্রথমবারের মতো বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে উত্তর নর্থ স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশনে উদ্দেশে ছেড়ে আসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার সকাল ১১টায় ফলক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে উত্তরার দিয়াবাড়ীতে উত্তর নর্থ স্টেশন থেকে প্রথমবারের মতো যাত্রী হিসেবে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চলতি ২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর সরকারের আরেক মেগা প্রকল্প কর্ণফুলী টানেলের প্রথম টিউবের উদ্বোধন করা হয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে আয়োজিত উৎসবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রথম টিউব উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ টিউব দিয়ে আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রাম শহরে এবং উত্তর টিউব দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আনোয়ারার দিকে যান চলাচল করবে। দুটি টিউবের অপরটির বাকি কাজ এ বছরের ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে টানেল দিয়ে যান চলাচল করতে পারবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। টানেলটি ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে। নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের কাজ উদ্বোধন করেন।

একই বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর খুলে দেওয়া হয়েছে সারা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ১০০ সেতু। সারা দেশে ১০০টি সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সেতুগুলো উদ্বোধনের পর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ওইদিন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে একসঙ্গে নবনির্মিত সেতুগুলোর উদ্বোধন করেন তিনি। ১০০টি সেতুর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫টি, সিলেট বিভাগে ১৭টি, বরিশাল বিভাগে ১৪টি, ময়মনসিংহে ছয়টি, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী ও রংপুরে পাঁচটি করে, ঢাকায় দুটি ও কুমিল্লায় একটি রয়েছে।

অপরদিকে এর আগেই পদ্মা সেতুর সুফল শতভাগ পেতে কালনার মধুমতি সেতুর দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর। সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যশোর, নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত কালনা ঘাটে নির্মিত ‘মধুমতি সেতু’র দ্বার উন্মোচিত করা হয়েছে। ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এ সেতুর উদ্বোধন করবেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যশোর ও নড়াইলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে কালনা ঘাটে সেতুর প্রয়োজনীয়তা বহুগুণ বেড়ে যায়। পদ্মা সেতু পার হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের প্রবেশদ্বার কালনাঘাট। তাই পদ্মা সেতুর সুফল পেতে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মধুমতি নদীর এ সেতু। দৃষ্টিনন্দন এ সেতু দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু। এ সেতুর পূর্ব পারে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা এবং পশ্চিম পারে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা।

এ সেতু চালুর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ১০ জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর নড়াইলের নির্বাচনি জনসভায় এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সেতুর কাজের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে বেনাপোল-ঢাকা ও যশোর-ঢাকার দূরত্ব ১১৩ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকার দূরত্ব ১২১ কিলোমিটার এবং নড়াইল-ঢাকার দূরত্ব ১৮১ কিলোমিটার কমেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জানিয়েছেন, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শেষ করে তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার বছর হচ্ছে ২০২২। কাজেই নতুন ২০২৩ সালকে উন্নয়নের সুফল পাওয়ার বছর বলা যেতেই পারে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ