• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

দিল্লি-ঢাকা: প্রতিবেশিতার নতুন দৃষ্টান্ত

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২১  

এই সম্পর্কের শিকড় প্রোথিত রয়েছে ইতিহাসে, তবে উভয় রাষ্ট্রই অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করেছে, যা সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়ার সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ১৫-১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে ছিলেন।

বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবসে যোগ দিতে তার এই সফরে দু’টি উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। প্রথমত, এটি ভারত ও বাংলাদেশকে সংযুক্তকারী ঐতিহাসিক শিকড়কে প্রতিফলিত করে। দ্বিতীয়ত, এটি উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে গভীরতর হতে থাকা একটি বিশেষ এবং আদর্শ সম্পর্কের নতুন বাস্তবতাকে তুলে ধরে।

সফরজুড়ে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন উদযাপনে অংশ নেন, স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক ধ্বংসকৃত একটি মন্দির উদ্বোধন করেন। এই বিষয়গুলি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ সংগ্রামের প্রতিফলন ছিল। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়দান, মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা- এ সবই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সময় ভারত যে ত্যাগ স্বীকার করেছিল তার কয়েকটি মাত্র। উভয় জাতিই তাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই যৌথ স্মৃতিগুলিকে সংরক্ষণ করে তা থেকে শিক্ষা নিতে চায়।

রাষ্ট্রপতিকে এই আমন্ত্রণ ভারতের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করতে বাংলাদেশের আগ্রহকে তুলে ধরেছে। আজ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে বাকি প্রতিবেশীদের জন্য অনুকরণীয় হিসেবে দেখা যেতে পারে। নিশ্চিতভাবেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেও তাদের ন্যায্য মতপার্থক্য রয়েছে। ধর্মীয় সংঘর্ষ এবং সহিংস দেশভাগ ছাড়াও, পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি তৈরির জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এই সম্পর্কও একটি উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে যায়। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হন। তার অগ্রাধিকার ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জঙ্গি এবং আইএসআই-সমর্থিত উগ্রপন্থীদের দমন করে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী হামলা কমিয়ে আনা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অধীনে নয়া দিল্লিও এই অনুভূতির প্রতিদান দিয়েছে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। উভয় নেতা অত্যন্ত ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তারা ২০১৪ সাল থেকে একাধিকবার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং দ্বিপাক্ষিক সংযুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্যান্য প্রতিবেশীর মতো বাংলাদেশও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণে ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে চীনের প্রভাব সীমিত করা, ভারতের প্রতি অবিশ্বাস কাটিয়ে ওঠা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এই নতুন চ্যালেঞ্জগুলোই ছিল প্রতিবেশী প্রথমে এবং অ্যাক্ট ইস্ট নীতির বিপরীতে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ করার জন্য ভারতের আগ্রহের কারণ।

সম্প্রতি বাংলাদেশের আস্থা অর্জনের জন্য ভারত উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সামুদ্রিক সম্পদ অন্বেষণের জন্য বাংলাদেশকে সমর্থনকারী জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনালকে মান্যতা দেওয়া এবং সমস্যা সমাধানে ভারতের আগ্রহ প্রকাশ তেমনই একটি ঘটনা। ২০১৫ সালের স্থল সীমানা চুক্তিটি ছিল আরেকটি যুগান্তকারী অগ্রগতি, যা আস্থা বৃদ্ধি করেছে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধা করেছে। এছাড়া এক দশকের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প, বৃত্তি, এবং সীমান্ত হাটের প্রচারও এই সম্পর্কের মূলে রয়েছে। বাংলাদেশ ২ কোটি ১৮ লাখেরও বেশি ডোজ টিকা পেয়েছে ভারত থেকে, যা অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি।

সংযোগ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। উভয় রাষ্ট্রই একে পারস্পরিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করার একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ পারস্পরিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য তার উন্নয়ন সূচক, দারিদ্র্য বিরোধী পদক্ষেপ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং প্রবৃদ্ধির ক্রমোন্নতি দ্বারা ফুটে উঠেছে এবং তা ভারতের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি বিনিয়োগও আকৃষ্ট করেছে। এটি উত্তর-পূর্বেও ইতিবাচক ফল দিচ্ছে।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের বৈশ্বিক উন্নয়ন সহায়তার ৩০ শতাংশেরও বেশি পেয়েছে। এছাড়াও ভারত বাংলাদেশকে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে এবং ৪৬টিরও বেশি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। উভয় দেশই নতুন এবং ১৯৬৫-পূর্ব আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগ, বাস পরিষেবা, নৌ-পরিবহন এবং বাণিজ্য রুট স্থাপনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। বাংলাদেশ  চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে করে মালবাহী গাড়ি ও ট্রানজিটের অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া ভারত পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং ডিজেল রপ্তানিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

এই বিনিয়োগ এবং সংযোগগুলি চীনকে সীমিত রাখায় ভারতকে সাহায্য করছে এবং বাংলাদেশকে তার নিজস্ব কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন তৈরি করতেও সাহায্য করছে। ২০১৬ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয় এবং কৌশলগত প্রভাব রয়েছে এমন চীনা প্রকল্পগুলির বিষয়ে সতর্ক ছিল। এটা জানা কথা যে, চীনের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি হলে তা চীনের প্রভাব এবং আগ্রাসনও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের কোয়াডে যোগদানের বিষয়ে চীনের আক্রমণাত্মক মন্তব্য এবং ঢাকার তাৎক্ষণিক পুশব্যাক এক্ষেত্রে অকাট্য প্রমাণ। চীনের উপর তার অত্যধিক নির্ভরতা সীমিত করতে বাংলাদেশ বিচক্ষণতার সাথে ভারত, জাপান এবং পশ্চিমের বিনিয়োগ ব্যবহার করেছে।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কাহিনী ভারতের প্রতিবেশী প্রথমে নীতির সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ পালক। এটি এমন একটি শিক্ষা, যা শিখতে হবে এবং একই রকম চ্যালেঞ্জ এবং উদ্বেগের মুখোমুখি অঞ্চলসমূহে প্রয়োগ করতে হবে। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের সাথে কিছু সমস্যার এখনও কার্যকর এবং সময়োপযোগী সমাধান প্রয়োজন। তবে এই সম্পর্কের সাফল্যের কাহিনী এটি নিশ্চিত করবে যে, উভয় দেশ সমাধান খুঁজে বের করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। আশা করি, ক্রমবর্ধমান দিল্লী-ঢাকা সংযোগ এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটি নিরপেক্ষ বাংলাদেশি নীতির দিকে নিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে সীমান্তে অবৈধ অভিবাসন ও পাচার বন্ধ করবে। সবশেষে, সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং চরমপন্থার মতো আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলিও এই দুই প্রতিবেশীর কাছ থেকে আরও সহযোগিতা, সমন্বয় এবং চ্যালেঞ্জগুলি সমাধান করার প্রস্তুতি ও ইচ্ছা দাবি করা ছাড়া কোনো বিকল্প রাখে না।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ