• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সরকার

সংস্কারে ব্যাংক খাতের নবযাত্রা

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০২৪  

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নানা নেতিবাচক প্রবণতা কাটাতে দেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা (মার্জার) হচ্ছে। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য ব্যাংকগুলোকে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলো নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে এরপর একীভূত হতে বাধ্য করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন উদ্যোগকে দেশের ব্যাংক খাতের নবযাত্রার সূচনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ব্যাংক মার্জার করলে এ খাতে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এটা কতখানি কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর। কারণ একটি সবল ব্যাংক যখন একটি দুর্বল ব্যাংকের দায় নেবে, তখন দুর্বল ব্যাংকটির আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে—দুর্বল ব্যাংকের ক্ষতির দায় কে নেবে? এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাই সরকার যদি

আন্তরিকভাবে এটি চায়, তাহলেই কেবল বাংলাদেশ ব্যাংক এটি বাস্তবায়ন করতে পারবে।’

জানা গেছে, বর্তমান মেয়াদে দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চায় আওয়ামী লীগ সরকার। সেই লক্ষ্যে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে শুরু হয়েছে ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া। সেইসঙ্গে ব্যাংকের পরিচালকদের যোগসাজশে নিজেদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বন্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় ও বিদেশে অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক খাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পাশাপাশি অর্থ পাচার বন্ধ করতেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার।

পাচারের টাকা দেশে ফেরত এনে বিনিয়োগের বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই দেশের ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে ডজনখানেকের বেশি ব্যাংক মূলধন ঘাটতি ও তারল্য সংকটসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সমস্যাগ্রস্ত এসব ব্যাংককে ‘দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত করে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংককে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজ সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে এই দুই ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষর হবে।

কেবল পদ্মা ব্যাংক নয়, খেলাপি ঋণ এবং নানা কেলেঙ্কারিতে এক ডজনের বেশি ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। এসব ব্যাংক এখন দেশের পুরো ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা হয়ে ওঠায় আর্থিক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে ব্যাংক একীভূতকরণ বা মার্জারের দিকে হাঁটছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অর্থনীতির আকারের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও মনে করছে, এ সংখ্যা কমানোর দরকার। তবে বর্তমানে সক্রিয় ৬১টি ব্যাংক থেকে কমিয়ে কতটি রাখা হবে— সে ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ব্যাংক, যাদের ঋণ ও আমানতের অঙ্ক ১০ হাজার কোটি টাকার আশপাশে, তাদের দিকেই প্রথম ধাপে নজর দেওয়ার কথা জানাচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এদিকে একীভূতকরণের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ব্যাংক খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যাংক খাতের স্বার্থেই দ্রুত এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘মার্জার করতে চাইলে খুব বেশি সময় নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ এতে দুর্বল ব্যাংকগুলো আরও বেশি অর্থ পাচার করে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে এখনই দুর্বল ব্যাংকের আমানত গ্রহণ এবং বিতরণ ছাড়া অন্য সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া উচিত।’

ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়াটি আন্তর্জাতিক মানের ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হবে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত হওয়া নিয়ে নানা ধরনের স্পেকুলেশন হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংক একীভূত হোক না কেন, এতে আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না, সেখানে আমানতকারীদের স্বার্থ শতভাগ রক্ষা করা হবে।’

এদিকে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া ব্যাংকের আমানতকারীদের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণেরও তাগিদ দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক দেশেই ব্যাংক মার্জারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমাদের এটা করার জন্য সেসব দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো আমানতকারীদের স্বার্থের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। তবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। কারণ সবল এবং দুর্বল উভয় ব্যাংকই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এবং দুর্বল ব্যাংকের শেয়ারের দায় যদি কোনো সবল ব্যাংক নেয়, তাহলে সেই ব্যাংকের শেয়ারের দামও কমে যেতে পারে।’

অন্যদিকে দেশের ব্যাংক খাতের সংকট নিরসনে শুধু একীভূতকরণই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মার্জার আসলে কম বেশি সব দেশেই হয়। তবে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা এটা দিয়ে সমাধান করা যাবে না। কারণ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ এবং গুটি কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত ঋণ। যার অধিকাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বিদেশে পুঁজি পাচার বর্তমানে অর্থনীতির অন্যতম সমস্যা। ব্যাংক মার্জারের মাধ্যমে এটার কোনো সমাধান মিলবে না।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘অধিগ্রহণ করলে দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহক, আমানতকারীর বাজারটি পাবে সবল ব্যাংক। তেমনি দুর্বল ব্যাংকের জনবল, খেলাপি ঋণ, বেনামি ঋণের দায়ও নিতে হবে সবল ব্যাংককে। ফলে দুর্বল ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটটা যোগ হবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে। এতে ভালো ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ বেড়ে যাবে, প্রভিশন রাখতে গিয়ে মুনাফা কমবে প্রথমদিকে। আর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার চাপও বাড়বে। এসব সামলে নিতে পারলেই সবল ব্যাংকটি লাভবান হতে পারবে। অবশ্য এর ফলে ব্যাংকের কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কাও রয়েছে।’

একই আশঙ্কা প্রকাশ করে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে পারলেও কর্মী ছাঁটাইয়ের শঙ্কা থাকবে। কেননা, একই এলাকায় উভয় ব্যাংকের দুটি শাখা থাকলে সেখানে একটি শাখা কমানো হবে। ফলে ওই শাখার কর্মীরা কোথায় যাবেন? শুধু শাখা পর্যায়ে নয়, ব্যাংকের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিয়োজিত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি হারাতে পারেন।’

অবশ্য একীভূত হলেও দুর্বল ব্যাংকের কোনো জনবল তিন বছরের আগে ছাঁটাই বা বাতিল করা যাবে না—এমন শর্ত রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৭ দফা ‘রোডম্যাপে’। ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে এই ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়িত হওয়ার কথা রয়েছে।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ