• শনিবার ০৪ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২১ ১৪৩১

  • || ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

রাসুল (সা.) এর দূর্দশিতা সময়োপযোগী এবং অনন্যতার সাক্ষ্য বহন করে

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) তায়েফ থেকে মক্কা ফিরছিলেন। সঙ্গে জায়েদ ইবনু হারেসা (রা.)। মক্কার অনতিদূরে হেরা পর্বত পর্যন্ত পৌঁছে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। জানতে পেরেছিলেন, কুরাইশের কাফেররা আগে থেকে আরো বেশি তার বিরোধী ও মারমুখী হয়ে উঠেছে। সম্ভবত তায়েফবাসীদের অত্যাচারমূলক আচরণের সংবাদ তাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই কারো আশ্রয় নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করাটা ভালো হবে মনে করলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)।

মক্কার কাফেরদের ভুলগুলো আপন জায়গায়। তবে তাদের নিকট অপরকে আশ্রয়দানের নিয়ম-রীতি ছিল। মানসম্পন্ন কেউ যখন কোনো কাউকে আশ্রয় দিতো, তখন তার সম্মান করা হতো। যেহেতু এ নিয়মটা শরয়ি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) সেই মূলনীতির মাধ্যমে উপকৃত হতে চাইলেন।

পাঠক! এখানে রাসুল (সা.) এর দূর্দশিতা সময়োপযোগী এবং অনন্যতার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি যদি কোনো মুসলমানের আশ্রয় নিতেন, তাহলে তা যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর হয়ে যেত। বনি হাশেম নিঃসন্দেহে বড় খান্দান এবং তারা আশ্রয় দিতে পারে। তবে তাদের বড় সর্দার আবু তালেব তো মারা গেছেন। পরবর্তী সর্দার ছিল আবু লাহাব। কিন্তু সে তো রাসুল (সা.) এর ঘোর শত্রু। 

তাই আশ্রয়ের পয়গাম পৌঁছানোর জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) বনি খোজাআর এক ব্যক্তিকে দূত বানান। সিরাতপ্রণেতাগণ লিখেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমি তোমাকে একটি পয়গাম দিয়ে পাঠাবো। তুমি কি আমার পক্ষ থেকে পয়গামটি পৌছে দিবে?’

লোকটি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে নবী করিম (সা.) তাকে আখনাস ইবনু শুরাইকের কাছে পাঠান। বললেন, “তাকে গিয়ে বলো, ‘মুহাম্মদ (সা.) তোমাকে জিজ্ঞাসা করছেন, তুমি কি আমাকে আশ্রয় দিবে। যাতে আমি আমার রবের পয়গাম পৌঁছাতে পারি?”

সে ছিল বনি সাকিফের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে কুরাইশের শাখা বনি যাহরার অন্তর্ভূক্ত। তাই আখনাসের উত্তর ছিল, ‘আমি মিত্র এবং মিত্র কোনো কুরাইশিকে কুরাইশের বিরুদ্ধে আশ্রয় দিতে পারে না।’

তখন রাসুল (সা.) দূতকে এই আশায় সুহাইল ইবনু আমরের নিকট পাঠালেন যে, হয়ত সে আশ্রয় দিবে। কিন্তু সেও অপরাগতা প্রকাশ করল।

অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.) মুতইম ইবনু আদির নিকট পয়গাম প্রেরণ করেন। সেও মক্কার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এবং বনি নওফেল ইবনু আবদ মানাফের সর্দার ছিল। দূত রাসুল (সা.) এর পয়গাম নিয়ে তার নিকট গেলে সে বলল, ঠিক আছে। তিনি আসতে পারেন। 

সুতরাং ওই রাতে রাসুল (সা.) মুতইমের নিকট কাটালেন। মুতইম তার সন্তানদের এবং নিজের গোত্রকে ডেকে বলল, ‘তোমরা সবাই অস্ত্র ধারণ করো এবং বায়তুল্লাহর চার কোণায় দাঁড়িয়ে যাও। আমি মুহাম্মদ (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছি।’

আল্লাহর রাসুল (সা.) জায়েদ ইবনু হারেসা (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে বায়তুল্লাহ শরিফে যখন প্রবেশ করেন, তখন মুতইমের সন্তানেরা এবং গোত্রের লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় দন্ডায়মান ছিল। 

মুতইম তার সওয়ারি উটের উপর দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করলেন, ‘হে কুরাইশের দল! আমি মুহাম্মদ (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছি। অতএব কেউ যেন তার ব্যাপারে নিন্দামূলক শব্দ ব্যবহার না করে।’

আল্লাহর রাসুল (সা.) হাজরে আসওয়াদের পাশে আসলেন। পাথরে চুমো দিলেন। দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। এরপর নিজের ঘরে চলে গেলেন। 

ওই সময়ের মধ্যে মুতইম ও তার সন্তানরা রাসুল (সা.) এর চতুর্দিক থেকে নিরাপত্তা বেষ্টনী কায়েম করে রেখে ছিল।

ইমাম ইবন কাসির (রহ.) বলেন, মুতইম কর্তৃক আশ্রয় দানের পর রাসুল (সা.) তার নিকট তাশরিফ নিয়ে গেলেন। ঐ রাত তার কাছেই কাটান। সকালে তার ছয় কিংবা সাতছেলে সন্তান নিজ নিজ গলায় তরবারি ঝুলিয়ে রাসূলুল্লাহ সা.এর সঙ্গে সঙ্গে বের হয় এবং মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে। বলল, আপনি তাওয়াফ করুন। তারা তরবারি নিয়ে অত্যন্ত চৌকস ভঙ্গিতে কা‘বার প্রাঙ্গণে বসে গেল। এই দৃশ্য দেখে আবু সুফিয়ান কি আবু জেহেল মুতইমের নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি তাকে আশ্রয় দিয়েছ নাকি তার অনুগত হয়ে গেছো?’
মুতইম জবাব দিল, স্রেফ আশ্রয় দিয়েছি।

আবু সুফিয়ান বলল, তাহলে তো তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে না।

আবু সুফিয়ান মুতইমের পাশে বসে পড়ল। ইতিমধ্যে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাওয়াফ সমাপ্ত করেন। যখন তিনি ফিরে যাচ্ছেন, সবাই সঙ্গে সঙ্গে তার ঘর পর্যন্ত গেল। আবু সুফিয়ান তার মজলিসের দিকে চলে গেল।

প্রিয় পাঠক! রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অসংখ্য ভালো গুণের একটি এটাও ছিল যে, তার সঙ্গে কেউ ভালো আচরণ করলে তা তিনি কখনো ভুলতেন না। কোনো ব্যক্তি জীবনের কোনো অংশে রাসুল (সা.) এর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে থাকলে তা তিনি স্মরণ রাখতেন এবং উপযুক্ত সময়ে তা থেকে আরো বাড়িয়ে বিনিময় দিতেন। এটা উন্নত চরিত্রের উচ্চতম স্থান। আল্লাহর রাসুল সা. হিজরত করে মদিনা যাবার কিছু দিন পরেই মুতইমের ইনতিকাল হয়।

মুতইম রাসুলুল্লাহ সা.কে তায়েফ থেকে ফেরার পথে আশ্রয় দানের অনেক পূর্বে অবরোধের নিপীড়নমূলক দলিলটা ছিড়ে ফেলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। একারণেই সে যখন মারা যায়, হাস্সান ইবন সাবেত (রা.) তার স্মরণে শোকগাথা পড়েছেন। দুর্দিনের এ বন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

আল্লাহর রাসুল (সা.) মুতইম ইবন আদির উপকারসমূহের বিনিময় দিয়েছেন এভাবে যে, বদর যুদ্ধে আটককৃত মুশরিকদের সত্তরজন কয়েদি মদিনায় এলে তিনি সেই কয়েদিদের সম্পর্কে বলেন, ‘মুতইম ইবন আদি যদি জীবিত থাকত এবং তিনি এসব লোকদের ব্যাপারে কথা বলত, সুপারিশ করত, তাহলে আমি তার খাতিরে এদেরকে ছেড়ে দিতাম।’

বস্তুত এটাকেই বলে চরিত্র। এটাই হচ্ছে ভদ্রতা। যে কেউ কখনো নবী করিম (সা.) এর উপকার করেছে, বিশেষ করে তার দূর্দিনে..তিনি তার চেয়ে বেশি করে সেই উপকারের বদলা দিয়েছেন। রাসুল (সা.) এর এই চরিত্র তার শত্রুদের পর্যন্ত তার প্রতি মুগ্ধ করে তুলতো।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ