• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

বিশেষ ধারা প্রয়োগে বেসামাল এরশাদ!

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১২ মে ২০১৯  

সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীনদের আশপাশে থেকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি দলটি। বরং দলটিজুড়ে চলছে অস্থিরতা আর আতঙ্ক। আর এ অস্থিরতা মূল নায়ক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কখন কোন সিদ্ধান্তের প্রেস বিজ্ঞপ্তি আসে, কার ভাগ্য পোড়ে আর কার ভাগ্য খোলে— এমন অজানা আতঙ্কে সময় পার করছে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা।

তথ্য মতে, গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে পর থেকেই জাতীয় পার্টিজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। হঠাৎ করেই বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। চেয়ারম্যানের বিশেষ ক্ষমতাবলে তিনি দল পরিচালনায় এককর্তৃত্ব কায়েম করেছেন। গত ৬ মাসে দলের মহাসচিব পদে পরিবর্তন এনেছেন চারবার।

কো-চেয়ারম্যান পদেও পরিবর্তন এনেছেন ৪ বার। কোন কারণে অপছন্দ হলেও গভীর রাতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির গণমাধ্যমে পাঠিয়ে কেড়ে নিচ্ছেন পদ। অনেক উপজেলা পর্যায়ের নেতাকেও দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য করছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকটা নাকানি-চুবানির মধ্যে রেখেছেন। এসব নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত নিতেও বাধ্য হচ্ছেন।

জাপা সূত্র মতে, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণি ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য সংখ্যা হবে ৪১ জন। কিন্তু গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা করছেন না এরশাদ। চেয়ারম্যানের বিশেষ ক্ষমতাবলে তিনি সকাল-বিকাল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

এসব সিদ্ধান্ত নিতে তিনি কারো সাথে আলাপও করছেন। দলের কো-চেয়ারম্যান এবং মহাসচিবের মতো পদে পরিবর্তন আনতেও কোনো সভার প্রয়োজন বোধ করেন না। ইচ্ছা হলেই রাত-বিরাতে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একপেশে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে দিচ্ছেন। এতে চরম বেকায়দায় পড়েছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। আজ যাকে পদে বসাচ্ছেন-কাল তাকে বাদ দিবেন না— এমন ভরসা পাচ্ছেন না কেউ। সবার ভিতরেই প্রেস রিলিজ আতঙ্ক কাজ করছে।

জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে এরশাদকে অনেকটাই স্বেচ্ছাচারী ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ২০-এর উপধারা(১)-এ বলা হয়েছে, ‘গঠনতন্ত্রের অন্যধারায় যাহাই উল্লেখ থাকুক না কেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত থাকবেন। এ ক্ষমতাবলে তিনি প্রয়োজন বোধে প্রতিটি স্তরের কমিটি গঠন, পুনর্গঠন, বাতিল, বিলোপ করতে পারবেন। তিনি যেকোনো পদ সৃষ্টি বা অবলুপ্ত করতে পারবেন। চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির যেকোনো পদে যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, যেকোনো পদ থেকে যেকোনো ব্যক্তিকে অপসারণ ও যেকোনো ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারবেন।

এ ছাড়া দলের কাউন্সিলে দেয়া সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করে এরশাদ যখন যা খুশি তা করতে পারেন। যখন তখন যাকে খুশি বাদ দিতে পারেন। তিনি তাই করছেন। যখন যাকে খুশি দলে ঢুকিয়ে এক লাফে প্রেসিডিয়াম সদস্য বানাচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত সিনিয়র ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে জুনিয়রদের, এমনকি উপজেলাপর্যায়ের নেতাদেরও প্রমোশন দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন। শুধু গুরুত্বপূর্ণ পদে নয়, যে কাউকে তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য করে বড় নেতা বানিয়ে নিতে পারেন।

গঠনতন্ত্রের ২০/১ ক ধারার ক্ষমতা ভয়ঙ্কর প্রয়োগ করে অনেক আগেই ৪১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামকে ৪৬ জনে এনেছেন। এরমধ্যে গত ৯ মে বৃহস্পতিবার কোনো সভা ছাড়াই ৮ জনকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। নতুন প্রেসিডিয়াম সদস্যরা হলেন— কাজী মামুনুর রশিদ (ব্যবসায়ী), সৈয়দ দিদার বখত্ (সাবেক মন্ত্রী), জাফর ইকবাল সিদ্দিকী (সাবেক এমপি), সংসদ সদস্য নাজমা আকতার, আব্দুস সাত্তার মিয়া, আলমগীর সিকদার লোটন (সাবেক ছাত্রনেতা), এমরান হোসেন মিয়া এবং সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল। এখন প্রেসিডিয়ামের সদস্য সংখ্যা ৫৪।

এই আটজন নেতার মধ্যে দুই জনের ব্যাপারে তেমন কোনো আপত্তি না থাকলেও ছয় জন নেতার বিরুদ্ধে জাপার তৃণমূলের পাশাপাশি আপত্তি তুলেছেন খোদ দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা। এমনকি এরশাদের স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদও তার অসুসারীদের মধ্যেও চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।

দলটির একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্যার (এরশাদ) শেষ সময়ে এসে যা শুরু করেছে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। স্যারের এসব কর্মকাণ্ডের কারণে অন্য দলের নেতাদের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। তারা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করেন। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলে এতো প্রেসিডিয়াম সদস্য আছে বলে আমার জানা নেই। তাছাড়া হঠাৎ করে অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের দলে প্রেসিডিয়াম সদস্য করার কারণে সিনিয়র নেতারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

জাতীয় পার্টির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সর্বোচ্চ ফোরাম হলে স্যার (এরশাদ) নিজে ৫৪ জন প্রেসিডিয়াম সদস্যের নাম ঠিক মতো বলতে পারবেন না। এ নিয়ে শুধু নিজের দলের নেতাকর্মীরা নয়, অন্যদলের নেতাকর্মীরাও হাসাহাসি করছেন।

এদিকে, জাপাপ্রধানের এমন স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন— সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, জাতীয় স্বেচ্ছাসেক পার্টির সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা। শীর্ষ নেতৃত্বের অযোগ্যতাকে তিনি পদত্যাগের কারণ হিসেবে জানিয়েছেন। এছাড়া দলের যুববিষয়ক সম্পাদক বেলাল হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক আবু সাঈদ স্বপনও পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, আমার পরিচয় আমি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টির একজন সাধারণ কর্মী। সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে সুযোগ সন্ধানী অযোগ্য নেতৃত্ব জাতীয় পার্টির সাধারণ কর্মীদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।

তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির জন্মলগ্ন থেকে আমি এ পার্টি করে আসছি। পার্টির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর আমার আস্থা নেই। পল্লীবন্ধু এরশাদকে অসুস্থ অবস্থায় একটি মহল পার্টির ভেতর যেভাবে প্রমোশন দিচ্ছে তা মেনে নেয়া যায় না।

আবু সাঈদ স্বপন বলেন, এভাবে প্রমোশন মেনে নেওয়া যায়। তারা দলের জন্য ত্যাগী, তাদের না দিয়ে সুবিধাবাদী এবং তৃণমূলের নেতা হবারও যোগ্য নয়, এমন লোকদের কেন্দ্রীয় নেতা বানানো হচ্ছে। এসময় আরও অনেকে পদত্যাগের লাইনে আছে বলে জানান তিনি।

এক সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, প্রেসিডিয়াম সভার আর কোনো মান ইজ্জত থাকলো না। সর্বোচ্চ পরিষদ এখানে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও অভিজ্ঞদের মূল্যায়ন করা উচিৎ ছিল।

তিনি আরও বলেন, একই ব্যক্তিকে এক মাসের ব্যবধানে দুবার প্রমোশন দিয়েছেন। পার্টিতে যোগদানের আগেই সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ প্রেসিডিয়ামের সদস্য করা হয়েছে, এমন হাস্যকর নজিরও রয়েছে জাপায়।

তবে জাপার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন— জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দীর্ঘদিন ধরেই শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ। অনেকটা শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া বেশ কঠিন। এ সুযোগে একটি গ্রুপ তাকে ম্যানেজ করে এসব করাচ্ছেন। বিনিময়ে তারা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। তারা চাচ্ছেন জাতীয় পার্টি আর ঘুরে না দাঁড়াক।

জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, আমরা জাতীয় পার্টি করি এরশাদ সারের নেতৃত্বে। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন, আমরা তাই মেনে নেব। তার সিদ্বান্তের দ্বিমত করার সুযোগ নেই।আমার সংবাদ।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ