• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

দেবালয়েও লোকালয়ের শয়তান

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৪ এপ্রিল ২০১৯  

দানবীয় দাপট নিরঙ্কুশ হয়ে যাচ্ছে সবখানে। মানবের পরাজয় দুনিয়ার সব গোলার্ধেই। কাশ্মীর থেকে ফিলিস্তিন। প্যারিস থেকে অরল্যান্ডো। ক্রাইস্টচার্চ থেকে বৈরুত, মুম্বাই, গুজরাট। পেশোয়ার থেকে কাবুল। লন্ডন থেকে বার্সেলোনা? টুইনটাওয়ার থেকে ইরাক। বেসলান থেকে ইস্তাম্বুল। ঢাকা থেকে কলম্বো। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে আর শ্রীলংকায় গির্জায় বোমায় মারা যাওয়া দুই জায়গার মানুষই ছিল তাদের স্রষ্টার কাছে নতজানু অবস্থায়।

বিশ্বজুড়ে দানবীয় রাজত্ব হোটেল-রেস্তোঁরা, সিনেমা হল, জনসভাসহ লোকালয় ছাড়িয়ে মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় এসে ঠেকেছে। দেখতে-শুনতে এ দানবরারা মানুষের মতোই। এই শ্রেণির মানুষের সাথে জন্তুর অন্যতম তফাত হচ্ছে- মানুষ নিজের হিংস্রতাকে ঢেকে রাখতে পারে। জন্তুরা পারে না। জন্তুর কোন মুখোশ নেই। মুখোশ খোলার পর মানুষের মতো হিংস্র, বীভৎস, ভয়ংকর প্রাণী আর হতে পারে না।

 ‘মনুষ্যত্বে কেন এতো খরা? বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্বের যে কোনো দেশের ঘটনা-দুর্ঘটনা অন্য যে কোনো দেশের জন্যও ভাবনার। এ থেকে নিজেকে আলাদা বা মুক্ত ভাবা যায় না। ধর্মীয়-সামাজিক সংযোগ থাকলে আরেকটু বেশিই আমলে নিতে হয়। শঙ্কাও তাই একটু বেশি।’ 

নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলার পর পর কেন এ সময়কে শ্রীলঙ্কায় গির্জায় হামলার জন্য মোক্ষম হিসেবে বেছে নেওয়া হলো- এ প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। শ্রীলঙ্কা ক্ষতবিক্ষতের পেছনে কার বা কাদের হাত-এ নিয়ে কথামালা অন্তহীন। শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার মুখপাত্র রাজিথা সিনারত্নের উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, হামলায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক জড়িত।

আবার 'হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী'-এমন শিরোনামও প্রচার হয়েছে। অথচ তথাকথিত এই জঙ্গি গোষ্ঠী ব্যাপারে আর কোনো তথ্য নেই। এ ধরনের আরেকটি ঘটনার আগ পর্যন্ত চলতে থাকবে কথার কচলানি। ঘটনার খপ্পরে এক সময় তা থেমে যাবে। আমরাও ভুলে যাবো।

বাংলাদেশেও এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা নিয়ে এ চর্চার সাথে আমরা ঢের পরিচিত। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর ঘটনায়ও তা দেখেছি। কতো প্রশ্ন, কতো যুক্তি! দানবগুলো দেশি না বিদেশি? বাংলাদেশি না হিন্দুস্তানি? না-কি পাকিস্তানি? জাতে হিন্দু না মুসলমান? ওরা সচরাচর টাইপের সন্ত্রাসী না জঙ্গি?

সরকার পক্ষের না বিএপি-জামায়াত ঘরানার? এর আগে, রমনা বটমূল, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঝালকাঠির আদালত, ময়মনসিংহের সিনেমা হল, একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলার সময়ও এ ধাঁচের কুকথা-কুতর্ক চলেছে। বিশ্বব্যাপীই ছড়িয়ে পড়েছে বাতিকটা। ইহুদি মারে মুসলমান, খ্রিস্টান মারে মুসলমান, মুসলমান মারে খ্রিস্টান-হিন্দু। আবার বৌদ্ধ মারে মুসলমান।

আদিম কালে যখন মানুষ গুহায় থাকতো জন্তুর সঙ্গে লড়াই করে খাবার যোগাড় করত, তখন কি ধর্ম বলে কিছু ছিল? হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ছিল? মানুষের সভ্যতা এগুবার সাথে ধর্মের বিস্তার ঘটেছে। হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ইত্যাদি নামে তালিকাটা দীর্ঘ হয়েছে।

প্রত্যেক ধর্মের লোককেই আজ স্বীকার করতে হবে যে, তার ধর্ম আর শান্তিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে নেই। কবি নজরুল তা উপলব্ধি করে গেছেন সেই কবেই? যে উপলব্ধি থেকেই লিখেছেন- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন জন! কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র’।

ইসলাম এবং সনাতনি হিন্দু দুই ধর্মেই শ্রীলঙ্কার একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইসলাম ধর্মের কিছু বর্ণনায় বলা হয়ে থাকে আদমকে শ্রীলঙ্কা (সরনদীপে) নিক্ষেপ করা হয়েছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সীতা-রাবনের বর্ণনায়ও এসেছে শ্রীলঙ্কার নাম। সেখানে বলা হয়েছে, রাবন সীতাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন লঙ্কায়। সীতার উদ্ধারকল্পে কিষ্কিন্ধ্যার বানরসেনার সাহায্যে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলে রাবণের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়। এই ঘটনা রামায়ণ মহাকাব্যের মূল উপজীব্য।

ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার গির্জা ও হোটেলে সিরিজ বোমা হামলায় বিদেশিসহ শত শত নিহতের পর দেশটিতে কারফিউ জারি করা হয়েছে। তা জরুরি অবস্থায়ও গড়িয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দেশ শ্রীলঙ্কার মাত্র ছয় শতাংশ মানুষ ক্যাথলিক খ্রিস্টান। দেশটির দুই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তামিল ও সিংহলি উভয়ের মধ্যেই রয়েছে এই ধর্মাবলম্বীরা।

বলার অপেক্ষা রাখে না এ হামলায় বিশেষ টার্গেট করা হয় খ্রিস্টানদের। এই আক্রমণের পেছনে সুদক্ষ পরিকল্পনা ও বড় শক্তি কাজ করেছে তা বলতেই হয়। আবার এ কথাও সত্য, খ্রিস্টানরা শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী নয়। জনসংখ্যায়ও তাদের হিস্যা সামান্য মাত্র ৬.৭ শতাংশ। ক্ষুদ্র এ জনগোষ্ঠীর ওপর ১৯৯৫ সালে গৃহযুদ্ধ চলাকালেও বোমা হামলা হয়। হত্যা করা হয় ১৪৭ জন খ্রিস্টানকে।

নিউজিল্যান্ডের মসজিদের পর শ্রীলঙ্কার গীর্জায় হামলায় খ্রিস্টান বা ভিন্ন ধর্মের মানুষ মারা গেছে ভেবে স্বস্তি পাওয়া আজকের দুনিয়ায় মোটাদাগের সমস্যা। এভাবেই পৃথিবী বিভক্ত। কোন ধর্মগ্রন্থেই এভাবে পরস্পরকে হত্যার কথা বলা নেই। বরং তা বারণ করা হয়েছে। তাহলে কেন এভাবে খুনের উৎসবে মেতে ওঠা? কেন সারা পৃথিবীতে আজ কট্টরপন্থার জয়জয়কার?

মনুষ্যত্বে কেন এতো খরা? বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্বের যে কোনো দেশের ঘটনা-দুর্ঘটনা অন্য যে কোনো দেশের জন্যও ভাবনার। এ থেকে নিজেকে আলাদা বা মুক্ত ভাবা যায় না। ধর্মীয়-সামাজিক সংযোগ থাকলে আরেকটু বেশিই আমলে নিতে হয়। শঙ্কাও তাই একটু বেশি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ