• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

‘একটা মৃত্যু হলে তার বিচার দাবি করেন, আমিও ২১ বছর বিচার পাইনি’

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ৫ আগস্ট ২০২০  

শেখ কামাল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন উল্লেখ করে তার বোন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে সে কোনো সুযোগ গ্রহণ করেনি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন, একটা মৃত্যু হলে তার বিচার দাবি করেন আমার কাছে। আর আমি কিন্তু বিচার পাইনি। আমি মামলা করতে পারিনি। কারণ আইন করে সে সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ২১ বছর পর সরকারে এসে তারপর মামলা করে সেই বিচার করি।’

বুধবার (৫ আগস্ট) দুপুরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অডিটোরিয়ামে শহীদ শেখ কামালের বর্ণাঢ্য কর্মবহুল জীবনের ওপর ভার্চুয়াল আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া আদায় করি এবং কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। তারা অন্তত আমাকে তাদের এই সেবা করার যেমন সুযোগ দিয়েছে আর এই অন্যায় অবিচারের বিচার করার সুযোগ আমরা পেয়েছি।’

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শহীদ শেখ কামাল ‘আলোমুখী এক প্রাণ’ শীর্ষক স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বড় বোন হিসেবে দুই বছরের ছোট ভাই শহীদ শেখ কামালের সঙ্গে শৈশবের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিজের জন্য কোনোদিন সে কিছু চাইত না। লেখাপড়া, নাট্যচর্চা নিয়ে ব্যস্থ থাকতো। তার নাটক আমি নিজে দেখতে গেছি। বিভিন্ন সময়ের উপস্থিত বক্তৃতা, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই তার প্রতিভা ছিল।’

‘আব্বা তো বেশির ভাগ সময় জেলে থাকতেন। কামাল তো আব্বাকে আব্বা বলে ডাকারও সুযোগ পায়নি। আমরা একসঙ্গে যখন খেলতাম। আমি আব্বা বলে ডাকতাম ও আমাকে জিজ্ঞাসা করতো, হাসু আপা তোমার আব্বাকে আব্বা বলি’-এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অশ্রু সংরবণ করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য বিশেষ করে বাঙালি জাতির জন্য আমার বাবা যেমন করে সারাজীবন উৎসর্গ করে গেছেন, আমরা ভাইবোনও পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। সবাই বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, আমাদের সেই সুযোগ হয়নি। কিন্তু মা আমাদের সবসময় লেখাপড়ায় সবদিকে নজর দিতেন। ছোট বেলা থেকেই কামাল শুধু খেলার মধ্যে তা না, সাংসারিক কাজেও আমার মাকে সবরকম সহযোগিতা করতেন। ওই ছোট্ট বয়স থেকেই যে খুব দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতো। আজকে কামাল আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আজকে তার সৃষ্টি আবাহনী ক্লাব এখনো আছে।’

শহীদ শেখ কামালের পৃষ্ঠপোষকতার গড়া ওঠা স্পন্দন শিল্পগোষ্ঠীর কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি, স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠীর অনেকেই মারা গেছে, নতুনভাবে আবার স্পন্দন গড়ে তোলা হয়েছে। ফিরোজ শাহীর ছেলেসহ যারা উদ্যোগ নিয়েছে, তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।’

শেখ কামালের বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দেশজ গানগুলি রেকর্ড করে নিয়ে সেটাকে আধুনিক সুরে মানে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে সেগুলিকে জনপ্রিয় করা এবং সেখানে বসে বসে টিউনগুলি দেওয়া, আমাদের ধানমন্ডির বাসার ছাদে বসে বসে এই কাজগুলি কিন্তু অনেক সময় আমি নিজেও করতে দেখেছি। তার নতুন নতুন চিন্তাভাবনা ছিল। আজকে যদি বেঁচে থাকত হয়ত দেশকে অনেক কিছু দিতে পারত। আমি যে সব একদিনে এভাবে হারাব, এটা কখনোই চিন্তাও করতে পারিনি, কল্পনাও করতে পারিনি‘-বলে জানান শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫ আগস্ট কি ঘটেছে? কামাল মুক্তিযোদ্ধা, সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসার ছিল। শেখ জামাল সে মুক্তিযোদ্ধা। সে সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ডপ্রাপ্ত অফিসার। আমার চাচা শেখ আবু নাসের মুক্তিযোদ্ধা। শেখ ফজলুল হক মনি মুক্তিযোদ্ধা। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক ছিলেন। তার ভ্রাতুস্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত, সেও মুক্তিযোদ্ধা।

১৫ আগস্ট যাদের সঙ্গে কাজ করেছে, যাদের সঙ্গে একসাথে ছিল। এমনকি ওসমানী সাহেবের এডিসি আরেকজন, আর্মি অফিসার। সেও একসাথে কাজ করেছে। আর তাদের হাতেই নিহত হতে হল। কত নির্মমভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন? দেশ শুধু স্বাধীনই করেননি আমার বাবা। তিনি এই সেনাবাহিনী গড়েও তুলেছিলেন। কারণ যারা আমাদের বাড়িতে রীতিমতো আসা-যাওয়া করত, আমাদের বাড়িতে নাস্তা ভাত খায়নি, এরকম কেউ নেই। আর তারাই যেন কামালের সামনে এসে কামালকে গুলি করে বা জামালকে গুলি করে বা এই বাড়িতে এইভাবে গুলি করলো?’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আপনারা একবার চিন্তা করে দেখেন? একটা মৃত্যু হলে তার বিচার দাবি করেন আমার কাছে। আর আমি কিন্তু বিচার পাইনি। আমরা বিদেশে ছিলাম। আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। আমাদের দেশে ফিরতে বাধা দিয়েছে। এরপর আমি যখন ফিরলাম, আমি মামলা করতে পারিনি। কারণ মামলা করার কোনো অধিকার আমার ছিল না। আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যে এই মামলা আমি করতে পারবো না। ২১ বছর পর সরকারে এসে তারপর মামলা করে সেই বিচার করি।‘

‘তখন কেউ বিচার চায়, তখন আমার এই কথাই মনে হয়, আমাদের তো কত বছর লেগে গেছিল এই বিচার করতে। যখন আমি সরকার গঠন করেছি তারপরে এই আইন বাতিল করতে সক্ষম হয়েছি। এরপরেই বিচার হয়েছে। একজন রাষ্ট্রপতি যিনি দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। তার জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়ে গেছেন দেশের জন্য। তার সারাটা জীবন কারাগারে কেটেছে। তিনি আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি তার সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। আর তার পাশে থেকে শক্তি সাহস যুগিয়েছিলেন আমার মা। যার জীবনের কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না। তিনি নিজের জীবনের জন্য কিছুই চাননি। তিনিও সবসময় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।’

‘আজকে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের যে সামরিক কর্মকর্তারা মেজরের ওপরে উঠতে পারেনি। তারা মেজর জেনারেল হয়েছে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হচ্ছে, জেনারেল হচ্ছে, কেন হতে পারল, দেশ স্বাধীন হওয়ার ফলেই তা হতে পেরেছে।’

‘ওই মেজর জিয়া মেজর থেকে মেজর জেনারেল সেই প্রমোশনটা তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই দিয়েছিলেন এবং এটা সকলের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।’

‘রাসেল একটা ১০ বছরের ছোট শিশু। তার কি অপরাধ? একই সঙ্গে আরিফ সেও সমবয়সী। সুকান্তের মাত্র বয়স ছিল চার বছর। তাকেও হত্যা করেছে। একই দিনে একই সাথে তিনটা বাড়ি আক্রমণ করে হত্যাযজ্ঞ চালানো হল।’

‘আজকে কামাল নেই। আমারা পিঠাপিঠি ভাই-বোন ছিলাম। একসঙ্গে ওঠাবসা, একসঙ্গে খেলাধুলা, চলাফেরা, ঝগড়াঝাটি সবই আমরা করতাম। একসঙ্গে সাইকেল চালানো, যেহেতু আমরা দুই ভাইবোন কাছাকাছি বয়সের। পুতুল খেলায় যেমন আমার সাথে ও থাকত। ওর সাথে ছোট বেলার বাকি সব খেলায় আমিও ওর সঙ্গেই খেলতাম।’

শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমি যখন বিদেশে গেলাম ১৯৬৯ সালে আব্বার মুক্তি পাওয়ার পর। কামালের কথাই সবচেয়ে বেশি আমার মনে হত। কারণ আমরা এত বেশি আব্বাকে ঘিরে, মাকে ঘিরে ঘনিষ্ট ছিলাম যে, ওদের ছেড়ে যে থাকতে হবে, এটাই ভাবতে পারিনি।

এত বহুমুখী প্রতিভা কামালের। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসাবে তো সে কিছুই করেনি। আমাদের ধানমন্ডির বাড়িটা কিন্তু একটাই বাড়ি। তিনতলায় মা ওর জন্য আলাদা একটা ঘর করে দিলেন। সেখানে বিয়ে করার পর বউ নিয়ে ওখানে উঠল।

সুলতানা কামালকেও ওভাবে মৃত্যুবরণ করতে হল। মাত্র ১৪ জুলাই বিয়ে হল ১৫ আগস্ট শেষ। জামালেরও একই অবস্থা, স্পেশাল পারমিশন নিয়ে তার বিয়ে দেওয়া হল। ১৭ জুলাই জামালের বিয়ে হল। ছোট ফুফুর মেয়ে রোজীর সাথে। তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করল, কি নিষ্ঠুরতা? সেটা একবার ভেবে দেখেন?’

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ