• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণের উপায়

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২০  

মহান আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে পাঠিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে। সুতরাং মানুষ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে, এটা তার জন্য ফরজ কর্তব্য।

কিন্তু মানুষ বিভিন্ন সময়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে, তাঁর অবাধ্য হয়। সে আল্লাহর শাস্তির কথা ভুলে গিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। স্রষ্টার প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে গিয়ে নিজেকে পৃথিবীতে শক্তিধর হিসেবে যাহির করার চেষ্টা করে। আর এই স্পর্ধা থেকে নানা অনাচার-পাপাচার করে পৃথিবীকে কলুষিত করে তোলে।

ফলে তাদের উপরে নেমে আসে আল্লাহর আজাব-গজব হিসেবে নানা ধরনের বালা-মুসিবত। নিম্নে এসব বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেশ করা হলো-

বালা-মুসিবতের কারণ সমূহ: বিভিন্ন কারণে মানুষের উপরে বালা-মুসিবত আপতিত হয়। তন্মধ্যে আল্লাহর সঙ্গে শিরক ও কুফরি, মানুষের ওপরে জুলুম-নির্যাতন করা, অধিক পাপাচার করা ও সৎকাজের আদেশ কম করা, অবাধ্যতা ও অহংকার করা, মিথ্যাচার করা, আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অস্বীকৃতি, দুনিয়াবী বিষয়ে প্রতিযোগিতা ও কৃপণতা, রাসূল (সা)-কে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা, সালাত পরিত্যাগ করা, জাকাত অস্বীকার করা, জিহাদ পরিত্যাগ করা, অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো, আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, সূদ-ঘুষ আদান-প্রদান করা বা হারাম ভক্ষণ করা, আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান দ্বারা ফায়সালা না করা ইত্যাদি কারণে মানুষের উপরে বালা-মুসিবত নেমে আসে।

বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণের উপায় সমূহ:

বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণের উপায়গুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ক. বালা-মুসিবত নাজিল হওয়ার পূর্বে করণীয় খ. বালা-মুসিবত নাজিল হওয়ার পরে করণীয়।

ক. বালা-মুসিবত নাজিল হওয়ার পূর্বে করণীয়:

মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে চললে তাদের উপরে আল্লাহর আজাব-গজব হিসেবে বালা-মুসিবত নেমে আসবে না।  বালা-মুসিবত যাতে না আসে সেজন্য কিছু করণীয় আছে। সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

১. আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা: আল্লাহর আদেশ প্রতিপালন করা এবং তাঁর নিষিদ্ধ বিষয় পরিত্যাগ করা বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি লাভের অন্যতম উপায়। রাসূলুল্লাহ (সা) ইবনু আববাস (রা.)-কে বলেন,

يَا غُلاَمُ إِنِّى أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَىْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلاَّ بِشَىْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ لَكَ وَلَوِ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوْكَ بِشَىْءٍ لَمْ يَضُرُّوْكَ إِلاَّ بِشَىْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللهُ عَلَيْكَ رُفِعَتِ الأَقْلاَمُ وَجَفَّتِ الصُّحُفُ

‘হে তরুণ! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি- তুমি আল্লাহ তায়ালার (বিধি-নিষেধের) রক্ষা করবে, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহ তায়ালার বিধানের প্রতি লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ তায়ালাকে তুমি তোমার সামনে পাবে। তোমার কোনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে আল্লাহ তায়ালার নিকট চাও, আর সাহায্য প্রার্থনা করতে হলে আল্লাহ তায়ালার নিকটেই কর। আর জেনে রাখো, যদি সব উম্মতও তোমার কোনো উপকারের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তারা তোমার ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্যে লিখে রেখেছেন। অপরদিকে যদি তারা সবাই তোমার ক্ষতি করার জন্য সমবেত হয়, তাহলে তারা তোমার ততটুকু ক্ষতিই করতে সক্ষম হবে, যতটুকু আল্লাহ তায়ালা তোমার তাকতিরে লিখে রেখেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে।  (তিরমিযী হা/২৫১৬; মিশকাত হা/৫৩০২; সহিহুল জামে‘ হা/৭৯৫৮; যিলালুল জান্নাহ হা/৩১৬-৩১৮)।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে,

احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ وَاحْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ أَمَامَكَ، وَتَعَرَّفْ اِلَى الله فِي الرَّخَاءِ، يَعْرِفْكَ فِي الشِّدَّةِ، 

‘তুমি আল্লাহর বিধান হেফাজত কর আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহর বিধান হেফাজত কর আল্লাহকে তোমার সামনে পাবে। তুমি সুখের সময় আল্লাহকে স্মরণে রাখ, বিপদের সময় আল্লাহ তোমাকে স্মরণে রাখবেন’।  (হাকেম হা/৬৩০৩; যিলালুল জান্নাহ হা/৩১৫, সনদ সহিহ)।

২. উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া: সচ্চরিত্র মানুষকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। যেমন: হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন,

فَرَجَعَ بِهَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَرْجُفُ فُؤَادُهُ، فَدَخَلَ عَلَى خَدِيْجَةَ بِنْتِ خُوَيْلِدٍ رضى الله عنها فَقَالَ زَمِّلُوْنِى زَمِّلُوْنِى فَزَمَّلُوْهُ حَتَّى ذَهَبَ عَنْهُ الرَّوْعُ، فَقَالَ لِخَدِيجَةَ وَأَخْبَرَهَا الْخَبَرَ لَقَدْ خَشِيْتُ عَلَى نَفْسِى فَقَالَتْ خَدِيجَةُ كَلاَّ وَاللهِ مَا يُخْزِيْكَ اللهُ أَبَدًا، إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَحْمِلُ الْكَلَّ، وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ، وَتَقْرِى الضَّيْفَ، وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ. 

‘অতঃপর এ আয়াত নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) প্রত্যাবর্তন করলেন। তাঁর হৃদয় তখন কাঁপছিল। তিনি খাদিজা বিনতু খুওয়ায়লিদের নিকটে এসে বললেন, আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর, আমাকে চাদর দ্বারা আবৃত কর। অতঃপর তাঁকে চাদর দ্বারা আবৃত করা হলো। এমনকি তাঁর শংকা দূর হলো। তখন তিনি খাদিজা (রা.) এর নিকটে ঘটনা জানিয়ে বললেন, আমি আমার নিজেকে নিয়ে শংকা বোধ করছি। খাদিজা (রা.) বললেন, ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’।  (বুখারি হা/৪৯৫৩; মুসলিম হা/১৬০; মিশকাত হা/৫৮৪১ ‘ফাজায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়, ‘অহির সূচনা’ অনুচ্ছেদ)।

ইমাম নববী (রহ.) বলেন,

قَالَ الْعُلَمَاءُ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ مَعْنَى كَلَامِ خَدِيجَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا إِنَّكَ لَا يُصِيبُكَ مَكْرُوهٌ لِمَا جَعَلَ اللهُ فِيكَ مِنْ مَكَارِمِ الْأَخْلَاقِ وَكَرَمِ الشَّمَائِلِ وَذَكَرَتْ ضُرُوبًا مِنْ ذَلِكَ وَفِي هَذَا دَلَالَةٌ عَلَى أَنَّ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ وَخِصَالَ الْخَيْرِ سَبَبُ السَّلَامَةِ مِنْ مَصَارِعِ السُّوْءِ 

‘বিদ্বানরা বলেন, খাদিজা (রা.) এর কথার অর্থ হচ্ছে, আপনার উপরে কোনো কষ্ট-ক্লেশ বা অপসন্দনীয় কিছু আপতিত হবে না। কেননা আল্লাহ আপনার মধ্যে উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও উত্তম গুণাবলী দান করেছেন। যেগুলি তিনি উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, উত্তম চরিত্র ও সৎ স্বভাব ধ্বংস-যজ্ঞ বা বিনাশ হওয়া থেকে রক্ষা করে’। (নববী, শরহু মুসলিম, ২/২০২)।

ইমাম কিরমানী (রহ.) বলেন,

وفيه أن خصال الخير سببٌ للسلامة من مَصارِع السوء، والمكارم سببٌ لدفع المكاره

‘আর এতে (খাদিজা রা.-এর বক্তব্যে) রয়েছে যে, উত্তম স্বভাব-চরিত্র ধ্বংস থেকে নিরাপত্তা লাভের উপায়। সচ্চরিত্র কষ্ট-ক্লেশ বা অপসন্দনীয় বিষয় প্রতিরোধের উপায়’।  (শরহুল কিরমানী আলা সহিহীল বুখারি, ১ম খন্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়া), পৃঃ ২০৬)।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) বলেন,

,فِيهِ أَنَّ مَكَارِم الْأَخْلَاق وخصال الْخَيْر سَبَب للسلامة من مصَارِع الشَّرّ والمكاره فَمن كثر خَيره حسنت عاقبته ورجى لَهُ سَلامَة  الدِّيْن وَالدُّنْيَا 

‘এতে (খাদিজা রা.-এর বক্তব্যে) রয়েছে যে, উত্তম স্বভাব-চরিত্র ধ্বংস ও কষ্ট-ক্লেশ থেকে নিরাপত্তা লাভের মাধ্যম। অতএব, যার সৎকর্ম বেশি তার পরিণতি সুন্দর হবে। আর তার জন্য দ্বীন ও দুনিয়ার নিরাপত্তার আশা করা যায়’।  (বদরুদ্দীন আইনী, উমদাতুল ক্বারী শরহু সহিহীল বুখারি, (বৈরূত : দারু ইহয়াইত তুরাছিল আরাবি), ১/৬৩ পৃঃ)।

৩. তওবা ও ইস্তেগফার করা: পরীক্ষা ও বিপদে পতিত হওয়া গোনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যম। তবে শর্ত হলো ওই পরীক্ষা ও বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং তার জন্য সওয়াবের আশা পোষণ করতে হবে। সেই সঙ্গে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং তাঁর নিকটে তওবা করতে হবে।

কেননা কোরআন ও হাদিস প্রমাণ করে যে, মানুষের গোনাহের কারণেই বিপদ-মুসিবত আপতিত হয় এবং তওবা ব্যতীত তা দূরীভূত হয় না। সুতরাং মানুষকে বেশি বেশি তওবা করতে হবে। দুনিয়াতে আমরা যে বিপদে-আপদে পতিত হই, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য বা সেগুলো হালকা হওয়ার জন্য মুসিবত দূরীভূত হওয়ার উপায়সমূহ অবলম্বন করা উচিত।

আল্লাহ বান্দাকে তওবার নির্দেশ দিয়ে বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا تُوْبُوْا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَّصُوْحاً 

‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহর নিকট খাঁটি তওবা কর’ (সূরা: তাহরীম ৬৬/৮)। 

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, 

وَاسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوْبُوْا إِلَيْهِ 

‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট গুনাহ মাফ চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো’ (সূরা: হূদ ১১/৯০)। 

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, 

وَتُوْبُوْا إِلَى اللهِ جَمِيْعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ 

‘হে মুমিনরা! তোমরা সবাই আল্লাহর নিকট তওবা কর, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।’ (সূরা: নূর ২৪/৩১)। 

তিনি আরো বলেন,

وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيْهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ- 
‘অথচ আল্লাহ কখনো তাদের উপর শাস্তি নাজিল করবেন না যতক্ষণ তুমি (হে মুহাম্মাদ) তাদের মধ্যে অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না যতক্ষণ তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে।’ (সূরা: আনফাল ৮/৩৩)।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ