• রোববার ১৯ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

  • || ১০ জ্বিলকদ ১৪৪৫

দৈনিক গোপালগঞ্জ

চিকিৎসক নিজেই যখন ক্যানসারে আক্রান্ত

দৈনিক গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০১৯  

তার নাম লিয ও'রিয়ারডান। তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করে আসছেন। কিন্তু নিজে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘অন্য অনেক নারীর মতো, আমি নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম আমার ক্ষেত্রে এটা ঘটতে যাচ্ছে না। কারণ আমি একজন স্তন ক্যান্সার সার্জন।’

২০১৫ সালে ৪০ বছর বয়সে তাকে মাস্টেক্টমি করতে হয় (অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্তন অপসারণ) এবং গত মে মাসে তিনি ফের এই রোগে আক্রান্ত হন।

ডক্টর ও'রিয়ারডান ভেবেছিলেন তিনি কুড়ি বছর ধরে সার্জন হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন কিন্তু কেবল দুয়েক বছর কাজ করতে পেরেছেন তিনি।

ক্যানসারের দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ তার কাঁধের নাড়া-চাড়াতে বাধাগ্রস্ত করে এবং মানসিকভাবে ভীষণ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার আগে ডক্টর ও'রিয়ারডান চাকার মতো অনুভব করেন এবং সেটি সিস্ট-এর দিকে যাচ্ছিল, যেখানে মাত্র ছয়মাস আগের এক মোমোগ্রাম রিপোর্টে তার স্তন সম্পূর্ণ সুস্থ বলে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আরেকটি চাকার পিণ্ড তৈরি হলে তার মার অনুরোধে তিনি স্ক্যানিং করান। যদিও তিনি জানতেন তার দ্রুত আরোগ্যের জন্য কি চিকিৎসা প্রয়োজন।

প্রথমে তিনি প্রথমে‘আতঙ্কগ্রস্ত’ হয়ে পড়েন এবং নানারকম প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরতে থাকে।

‘আমি স্ক্যান করে দেখেছি এবং জানতাম আমার স্তন অপসারণ করে ফেলতে হবে, এটাও জানাতাম আমার সম্ভবত কেমোথেরাপি প্রয়োজন হবে কারণ আমি বয়সে তরুণ ছিলাম এবং আমার দশ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটা সম্পর্কেও ভালো ধারনা ছিল। এবং সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে মাথার মধ্যে এতসব চিন্তার ঘুরপাক খাচ্ছিল।’

তার মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করে ‘কিভাবে স্বামীর সাথে এবং বাবা-মায়ের সাথে বিষয়টি শেয়ার করবেন তা নিয়ে। একজন ক্যান্সার সার্জন হিসেবে নিজের পথচলা থামিয়ে দিয়ে কেবলমাত্র একজন রোগী হিসেবে পরিণত হওয়া কতটা সম্ভব?’

যদিও তিনি নিজেই জানতেন ক্যানসার আক্রান্তের শরীরের ভেতরে কী ঘটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার অভিজ্ঞতা কতটা ভয়াবহ সে সম্পর্কে তার তো কোনো ধারণাই ছিলনা।

‘কারো ব্রেস্ট ক্যানসার আছে এটা তাদের বলা যে কেমন- তা আমি জানি। কিন্তু আমি জানতাম না যে ঠোঁট চেপে, চোখের জল লুকানো, ক্লিনিক থেকে বেরোনো, ওয়েটিং রুম আর হাসপাতালের করিডর পেরিয়ে গাড়ি পর্যন্ত কোনরকমে পৌঁছানো এবং তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা।’

স্বামী ডার্মটের সাথে আলাপ করার পরনিজের ১৫০০ টুইটার ফলোয়ারের কাছে বিষয়টি ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, যারা তাকে পছন্দ করতো বেকিং, ট্রায়াথলন এবং তার পেশার জন্য।

‘কীভাবে ক্যানসারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে সেটা আমাকে বললো স্বয়ং আমার রোগীরা। যখন আপনি উচ্চমাত্রায় স্টেরয়েড নিচ্ছেন তখন ভোররাত তিনটার সময়েও কেউ একজন জেগে আছে আপনার সাথে কথা বলার জন্য।’

ক্যানসার আক্রান্ত আরো যারা চিকিৎসা পেশা সংক্রান্ত ব্যক্তিরা আছেন তাদের সাথে সামাজিক মাধ্যম তাকে যুক্ত রাখে এবং এরপর থেকে এই রোগের চিকিৎসকদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলেন।

তার ক্যানসারের প্রথম দফা চিকিৎসা শেষে ডক্টর ও'রিয়ারডান সার্জন হিসেব ইপসউইচ হাসপাতালে কাজে ফিরে যান। তিনি জানান যে, তিনি অনুধাবন করতে পারেননি যে এটা ‘ইমোশনালি কতটা চ্যালেঞ্জিং’হবে।

তিনি ভেবেছিলেন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি হয়তো লোকজনকে ভিন্নভাবে সহায়তা করতে পারবেন।

‘এটা ছিলো আমার দ্বারা সবচেয়ে কঠিন কাজ। যখন আপনি কাউকে একটি খারাপ খবর জানাচ্ছেন এবং কোনো নারীকে বলছেন যে তাদের শরীরে ক্যানসার রয়েছে, এটা যে কোনোভাবেই খুবই কঠিন। কিন্তু আমি স্মরণ করতে পারি যখন আমরা খবরটা শুনছিলাম এবং প্রচণ্ড কাঁপছিলাম তখন আমাকে এবং আমার স্বামীকে কেমন দেখাচ্ছিল তা আমি পরিষ্কার দেখতে পাই।’

‘আপনাকে এমন কারো সাথে যুক্ত থাকতে হবে যারা একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে-কিন্তু আমি পারিনি কারণ তারা ছিল আমারই রোগী।’

তিনি আরো বলেন,‘আমার মাস্টেক্টমির পর প্রচণ্ড ব্যথা এবং মাঝে মাঝে অপারেশন করছিলাম। কারণ আমি খুবই সতর্ক ছিলাম এই ভেবে যে আমি হয়তো তাদের ব্যথার কারণ হবো যেটা আমার আছে এবং সে কারণে আমি সার্জারি করতে চাচ্ছিলাম না্ এটা ছিল খুব কঠিন।’

২০১৮ সালে ডক্টর ও'রিয়ারডানের ক্যানসার আবার ফিরে আসে। প্রচণ্ড ব্যথার কারণে তার পুনর্গঠিত স্তন অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেয়ার আগ দিয়ে করা এক স্ক্যানে তা ধরা পড়ে। এর ফলে একই জায়গায় দ্বিতীয় ডোজ রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।

তাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে পরবর্তীতে সে হয়তো তার হাত ঠিকভাবে নাড়াচাড়া করতে পারবেন না -কিন্তু যদি তিনি সার্জারি না করতেন, তাহলে তার ফলাফল হতো শূন্য।

আর চূড়ান্ত পরিণতি হয়েছিল আরো ক্ষতিকর। নরম টিস্যুগুলির ফাইব্রোসিস এবং টিথারিং তার কাঁধের নড়াচড়া কমিয়ে করে দেয় এবং তার মানে দাঁড়ায় তার হাতের শক্তি কমে গেছে। তিনি জানান, দ্বিতীয়বারের মতো তার ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার জন্য সব ধরনের সহায়তার চেষ্টা করেছেন তার নিয়োগ-দাতা।

‘আমি ইনটেনসিভ ফিজিওথেরাপি নিয়েছি, একজন অর্থোপেডিক সার্জনের সাথে দেখা করি কারণ আমার অনেককিছু বলার ছিল,’আমার জীবনের ২০ বছর যে কাজে আমি সময় দিয়েছি, ডিগ্রি এবং পিএইচডি, পরীক্ষার পর পরীক্ষা এবং নিজের প্রিয় বিষয়ে একজন সুদক্ষ পেশাজীবী হওয়ার জন্য বিভিন্ন কোর্স-সবকিছুর পরও সেটা আমি আবার সে কাজটি করতে পারছি না।’

নিজের পেশায় ফেরা নিয়ে অক্ষেপ করে ও'রিয়ারডান আরো বলেন, ‘ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ করতে পারছিলাম। কিন্তু নিরাপদে অস্ত্রোপচার করার মত কাজটি হয়তো আর কখনোই করা হবে না।’

কেননা আগের চেয়ে এখন ক্যানসার ফিরে আসার ঝুঁকি আরো বেশি।

মজার ব্যাপার হল, এখন তিনি এখন ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর লোকজন যেন কাজে ফিরে যেতে পারে সে বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।

তার স্বামী একজন কনসাল্ট্যান্ট সার্জন। ও'রিয়ারডান বলেন, তিনি যথেষ্ট সৌভাগ্যের অধিকারী যে তার সচ্ছলতা রয়েছে এবং বেতনভোগী হিসেবে কাজ করতে হয়না।

সম্প্রতি তিনি সামাজিক উদ্যোগ ওয়ার্কিং উইথ ক্যান্সারের একজন স্বেচ্ছাসেবী অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৭ সালে কাজে ফেরার সময় তাকে উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে তারা।

তবে নানারকম শারীরিক জটিলতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাকে, ‘আমি এখনও খুব ক্লান্তিতে ভুগি এবং আমার মস্তিষ্ককে আবারো কাজে ফেরানোর চেষ্টা করছি।’

নিজ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘আমি আগে কখনো বুঝতে পারিনি যে কারো ক্যান্সার তাকে আইনগত-ভাবে অক্ষম ভাবা হবে ইকুয়ালিটি অ্যাক্ট অনুসারে এবং আপনার নিয়োগ-দাতাকে আপনাকে কাজে ফেরানোর জন্য যুক্তিসঙ্গত সমন্বয় সাধন করতে হবে।’

বহু মানুষ ক্যানসার ধরা পড়ার পর তাদের জীবন ফিরে পেতে মরীয়া হয়ে ওঠে, কিন্তু সঠিক উপায় খুঁজে বের করা অকল্পনীয় কঠিন হতে পারে এবং অনেক নিয়োগ কর্তৃপক্ষ জানে না কিভাবে ক্যান্সার পেশেন্টকে সাহায্য করতে পারে বা কি করা উচিত।

তিনি জানান, ওয়ার্কিং উইথ ক্যানসারের বেশিরভাগ প্রশিক্ষকের শরীরে ক্যানসার রয়েছে এবং তারা জানে অধিকার সম্পর্কে, কর্মী এবং নিয়োগ-দাতাদের তারা তৈরি করে।

একজন পরামর্শক হিসেবে প্রতিবছর শত নারীকে স্তন ক্যানসারের বিষয়ে সচেতন করছেন চিকিৎসক ও'রিয়ারডান।

তিনি বলছেন, ‘আমার বই, ব্লগ, বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় এবং অ্যাম্বাসেডর হিসেবে শত শত, হাজার হাজার নারীকে সাহায্য করতে পারি।

দৈনিক গোপালগঞ্জ
দৈনিক গোপালগঞ্জ